মনোরঞ্জন গুপ্ত

Barisalpedia থেকে

সশস্ত্র বিপ্লবী ও আইন সভার সদস্য। মনোরঞ্জন গুপ্ত ১৮৯০ সনের ৭ই মার্চ গৌরনদী থানার সরিকল ইউনিয়নের আধুনা গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি বাটাজোড় স্কুল হতে মেট্রিক, বিএম কলেজ হতে আই এ ও বিএ পাশ করেন (১৯১৪)। হীরালাল দাসগুপ্ত তার বাল্য বন্ধু। তারা স্বামী প্রজ্ঞানন্দ সরস্বতীর নিকট বিপ্লবী দিক্ষা গ্রহণ করেন। বিএ পাশ করার পরে তিনি কোলকাতায় চলে যান। এর আগ পর্যন্ত বরিশাল জেলার বিভিন্ন স্থানে যে তিনটি ডাকাতি হয় তার প্রত্যেকটিতে তিনি অংশগ্রহণ করেন। তাঁর পরিচালনায় ৬/১১/১৯১৫ তারিখে কোলকাতা মসজিদবাড়ি স্ট্রিটে একটি বাড়িতে পুলিশ ইনস্পেক্টর গিরীন মুখার্জি নিহত হন এবং ১২.১৯১৫ তারিখে করপোরেশন স্ট্রিটের এক সোনার দোকানে ডাকাতি হয়। প্রথম ঘটনায় তাঁর সঙ্গে ছিলেন ভূপতি মজুমদার ও আলিপুর দুয়ারের প্রখ্যাত ডাক্তার ব্রজেন্দ্রনাথ দত্ত। বিপ্লবী নরেন ঘোষ চৌধুরীর অতি ঘনিষ্ঠ সহকর্মীরূপে বহু রোমহর্ষক কাজের অংশীদার ছিলেন। ১৯১৬ খৃস্টাব্দে তিন আইনে গ্রেপ্তার হয়ে রাজবন্দি হিসাবে সাড়ে চার বছর জেলে আটক থাকেন। ছাড়া পেয়ে ১৯২০ খৃস্টাব্দে অরুণচন্দ্র গুহর সহযোগিতায় কলকাতার হ্যারিসন রোডে প্রজ্ঞানানন্দ সরস্বতীর নাম অনুসারে ‘সরস্বতী লাইব্রেরি’ স্থাপন করেন। বই বিক্রির ভার নিলেন বিপ্লবী কিরণচন্দ্র মুখোপাধ্যায়। ১৯২১ খৃস্টাব্দে অসহযোগ আন্দোলনকালে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন তাঁর ও জিতেন্দ্রনাথ দত্তের উপর বরিশালের আন্দোলন সংগঠনের ভার অর্পণ করেন। শ্রীসরস্বতী প্রেসের তিনি অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। ১৯২৩ খৃস্টাব্দে প্রেসের কাজ আরম্ভ করে তিনি তাঁর প্রথম ম্যানেজার হন। ওই বছরই নেতৃস্থানীয় আরও অনেকের সঙ্গে তিনিও গ্রেপ্তার হয়ে ১৯২৮ খৃস্টাব্দে ছাড়া পান। ওই বছরে কলকাতায় অনুষ্ঠিত কংগ্রেস অধিবেশনে তিনি খাদি প্রদশর্নীর সম্পাদক ছিলেন। এই সময়ে সত্যেন্দ্রচন্দ্র মিত্র, হরিকুমার চক্রবর্তী ও প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষের সঙ্গে মিলে তিনি ‘বেঙ্গল ইন্সিয়োরেন্স অ্যান্ড রিয়াল প্রপার্টি কোম্পানি’ নামে এক জীবনবিমা কোম্পানির পরিচালন-ভার গ্রহণ করেন এবং এই কোম্পানির কাজে ১৯২৯ খৃস্টাব্দে মাদ্রাজ শাখার সেক্রেটারি হিসাবে বৎসরাধিকাল মাদ্রাজে কাটান। ১৯২৯ সনে তিনি লাহোর কংগ্রেস অধিবেশনে যোগ দেন। ১৯২৯ খৃস্টাব্দে লাহোর কংগ্রেসে পূর্ণ স্বাধীনতার প্রস্তাব পাশ হয়। এরপরই তিনি ও অন্যান্য বিপ্লবীরা সুভাষ চন্দ্রের নেতৃত্বে মিলিত হয়ে দাবি করতে আরম্ভ করেন যে এই পূর্ণ স্বাধীনতার দাবিতে এখনই কংগ্রেসের আন্দোলন আরম্ভ করতে হবে। ১৮.৪.১৯৩০ খৃস্টাব্দে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার আক্রমণের ঘটনাকে উপলক্ষ্য করে শ্রীসরস্বত প্রেস থেকে মুদ্রিত ও প্রকাশিত ‘স্বাধীনতা’ সাপ্তাহিকে ভূপেন্দ্রকুমার দত্তের ‘ধন্য চট্টগ্রাম’ প্রবন্ধের জন্য সরকার পত্রিকাটি বেআইনি ঘোষণা করে ও প্রেসের কাছ থেকে দু-হাজার টাকা জামানত নেয়। এই সময় দলের ডা. নারায়ণ রায় প্রমুখের চেষ্টায় বোমা তৈরীর কাজ সফলতার সাথে এগিয়ে চলতে থাকে। প্রত্যেক জেলার ইউরোপিয়ান ম্যাজিস্ট্রেটের বাড়ি অথবা সেখানের ইউরোপিয়ানদের ক্লাবে বোমা ফেলে তাদের আতঙ্কিত করে ইংরেজদের দেশ ছাড়া করার যে রাজনৈতিক চাপ-সৃষ্টির কার্যসূচি তখন নেয়া হয়, তাতে তাঁর অবদান অনেকখানি।১৯৩০ সনে কলকাতায় পুলিশ কমিশনার টেগার্ট সাহেবের উপর আক্রমণ চালান। ফেরারি অবস্থায় গ্রেফতার হন এবং ১৯৩৮ সনে মুক্তি লাভ করেন। ঐ বছর যুগান্তর দলভুক্ত সকলের মিলিত সিদ্ধান্ত অনুসারে খবরের কাগজে বিবৃতির মাধ্যমে বিপ্লবী গুপ্ত সমিতির পরিসমাপ্তি করা হলে তিনি কংগ্রেসে যোগ দেন। তিনি ১৯৪০ থেকে ১৯৪৬ সন পর্যন্ত বন্দী ছিলেন। কারাগারে থেকে তিনি ১৯৪৬ সনের নির্বাচনে প্রার্থী হলেন। তিনি বিপুল ভোটে এমএলএ পদে জয়লাভ করেন। তিনি ১৯৫০ সনে বরিশালে দাঙ্গার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেন। ১৯৫৪ সনে কলকাতায় চলে যান এবং সেখানে পশ্চিমবঙ্গের উচ্চ আইনসভায় ১৫ বছর এমএলসি ছিলেন। তিনি কয়েক খানা গ্রন্থ রচনা করেছেন: ‘সমবায়মূলক সাধারণতন্ত্র ও বিশ্বরাজনীতি’, Philosophy of co-opeartion, ‘বিপ্লবীর জীবনস্বপ্ন মবায় সমাজ’, ‘রবীন্দ্র চিত্রকলা’, ‘যারা হারিয়ে গেল’, ‘মেকিয়াভেলির রাজনীতি’ ইত্যাদি। তিনি ১৯৭৪ সনে দেহ ত্যাগ করেন।



তথ্যসূত্র: ১। রফিকুল ইসলাম। বরিশাল দর্পণ। ঢাকা, ১৯৯০। ২। বাঙালি চরিতাভিধান,প্রথম খণ্ড। সাহিত্য সংসদ, কোলকাতা।