বি. এম. স্কুল

Barisalpedia থেকে

বরিশালের ঐতিহাসিক ও অন্যতম সেরা স্কুল বি. এম. স্কুলের নাম আদিতে ছিল ব্রজমহোন ইনস্টিটিউট। পরবর্তীতে এর নাম হয় বি. এম. স্কুল বা ব্রজমোহন স্কুল। ১৮৮৪ সালে মহাত্মা অশ্বিনীকুমার দত্তের উদ্যোগে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়।


প্রতিষ্ঠার ইতিহাস

দীর্ঘ দিন ধরে বরিশাল জেলা স্কুল ছিল বরিশালের একমাত্র উচ্চ ইংরেজী বিদ্যালয়। ১৮৮০ খৃৃস্টাব্দে বরদা প্রসন্ন রায় বরিশাল পুরাতন হাটখোলায় একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু স্কুলটি স্বল্পকালের মধ্যে বন্ধ হয়ে যায়। বরিশাল জেলা স্কুলের ছাত্রসংখ্যা ৬০০-এর অধিক হলে বিদ্যালয় সম্প্রসারণের জন্য সরকারের নিকট আবেদন করা হয়। সরকার অস্বীকৃতি জানিয়ে নতুন বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কথা বলে। তৎকালীন জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট রমেশ চন্দ্র দত্ত অশ্বিনী কুমারকে একটি উচ্চ ইংরেজী বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য উৎসাহ দেন। ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দের ২০ জনু অশ্বিনী কুমার দত্ত বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য বিজ্ঞাপন প্রচার করেন। তিনি পিতার নামে বিদ্যালয়ের নাম রাখলেন ব্রজমোহন ইনস্টিটিউট। ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দের ২৭ জুন ৮৪ জন ছাত্র নিয়ে বিদ্যালয়ের কাজ শুরু হয়। তখন বরিশালে আরেকটি স্কুল এত প্রয়োজনীয় ছিল যে, দ্বিতীয় দিনেই স্কুলের ছাত্রসংখ্যা দাঁড়ায় ১১৪, তৃতীয় দিনে দাঁড়ায় ১৭৯ এবং চতুর্থ দিনে তা হয়ে দাঁড়ায় ২৩৪। ১৮৮৫ খ্রিস্টব্দের ৩১ মার্চ ছাত্র সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৭৫ এবং ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দের ৩১ মার্চ ছাত্র ছিল ৪৪২ জন।

বরিশাল জেল রোডে হরি ঘোষের ভাড়াটিয়া পাকা বাড়ি ও তৎলংলগ্ন টিনের ঘরে প্রথম স্কুলটি বসে। উকিল পূর্ণচন্দ্র চক্রবর্তী বিদ্যালয়ের প্রথম প্রধান শিক্ষক নিযুক্ত হন। কামিনী কুমার দত্ত, মন্মথ নাথ লাহিড়ী, কামিনী কান্ত বিদ্যারত্ন, খোসাল চন্দ্র রায়, রাখাল চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রসিক লাল রায়, রাম চন্দ্র দাশগুপ্ত প্রতিষ্ঠাকালে স্কুলের শিক্ষক নিযুক্ত হন। ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দের শেষভাগে কালীপ্রসন্ন ঘোষ সহকারী শিক্ষক নিযুক্ত হন। পূর্ণচন্দ্র চক্রবর্তীর পরে কালীপ্রসন্ন ঘোষ প্রধান শিক্ষক নিযুক্ত হন।


বিদ্যালয়ের প্রাথমিক সংকট

১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দে বঙ্গভঙ্গ রদ আন্দোলনে অশ্বিনী কুমার দত্তের আহŸানে ব্রজমোহন বিদ্যালয় ও ব্রজমোহন কলেজের ছাত্র ও শিক্ষকগণ ঝাঁপিয়ে পড়ে। ছাত্ররা রিজলী সার্কুলার ভঙ্গ করে স্বদেশী আন্দোলনে যোগ দেয় তখন স্কুল ও কলেজের বিরুদ্ধে কতিপয় অভিযোগ উত্থাপন করা হয় এবং মঞ্জুরি কেড়ে নেয়ার চেষ্টা চলে। ১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দে বিশ্ববিদ্যালয় নতুন বিধি প্রবর্তন হলে পেসিডেন্সি কলেজের অধ্যক্ষ হেরম্ব চন্দ্র মিত্র বিদ্যালয় পরিদর্শন করে সুনাম করে বির্পোট দেন। কিছুদিন পরে ঢাকা বিভাগের স্কুলের সহকারী ইন্সপেক্টর ডাঃ পি চ্যাটার্জী বিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে কতকগুরো অভিযোগ উত্থাপন করেন। স্কুল কর্র্তৃপক্ষ অভিযোগ মিথ্যা বলে জানায়। তখন কলিকাতা বিশ্ববিদ্যলয় বিচারপতি গুরুদাশ বন্দ্যোপাধ্যায় নেতৃত্বে তদন্ত কমিটি নিয়োগ করে। এবারও বিদ্যালয় সরকারী হস্তক্ষেপ থেকে রক্ষা পায়।

স্কুলের শিক্ষক ও শিক্ষা

এ স্কুলে ছাত্রদের ২০টি উপদেশ পালন করতে হতো। অশ্বিনী কুমার নিজে লণ্ঠন হাতে নিয়ে ছাত্রদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে লেখাপড়ার সংবাদ নিতেন। তাঁর আদর্শে মুগ্ধ হয়ে খুলনার চিরকুমার জগদীশ, সত্যনিষ্ঠ, কালীপ্রসন্ন, কালীশ চন্দ্র, অক্ষয় কুমার সেন, সত্যানন্দ, মনোমোহন চক্রবর্তী, সতীশ চন্দ্র, ব্রজেন্দ্রনাথ, ক্ষেত্রনাথ ঘোষ অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে স্কুলের শিক্ষকতা করেন। অশ্বিনী কুমারের ‘সত্য প্রেম পবিত্রতা’র পতাকাতলে একত্রিত হয়ে শিক্ষকগণ বিএম স্কুলকে বঙ্গে বিখ্যাত বিদ্যায়তনে পরিণত করেন। অধ্যাপক কানিংহাম ব্রজমোহন বিদ্যালয় পরিদর্শন করে বিস্মিত হয়ে লিখলেন, “বঙ্গদেশে ব্রজমোহন বিদ্যালয়ের মতো উৎকৃষ্ট বিদ্যালয় থাকতে বাঙালী ছাত্ররা অক্সফোর্ড, ক্যামব্রিজে বিদ্যা শিক্ষা করবার জন্য কেন যায় আমি তা বুঝি না।” ১৮৯৭-৯৮ খ্রিস্টাব্দের সরকারী বার্ষিক শিক্ষা বিবরণীতে শিক্ষা বিভাগের কর্তৃপক্ষ লিখেছেন, “ The School is unrivalled in point of discipline and efficiency. It is an institution that ought to serve as a model to all schools- Government and private”। প্রত্যেক পরীক্ষায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শতকরা হিসেবে শীর্ষস্থান অধিকার করত। ১৮৮৯ খৃৃস্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশিকা পাসের হার ছিল শতকরা ২২ জন এবং বিএম স্কুলের পাসের হার ছিল শতকরা ৮২ জন।


স্কুলের প্রধান শিক্ষকগণ

১৮৮৪ হতে ১৯৮৪ এক শ’ বছর ধরে এ বিদ্যালয়টি একটি আদর্শ বিদ্যানিকেতন হিসেবে পরিগণিত হয়ে আসছে। স্কুলের দ্বিতীয় প্রধান শিক্ষক কালীশ চন্দ্র বিদ্যাবিনোদ সম্পর্কে ঐতিহাসিক সুখ্যাতি রয়েছে। তিনি ১২৬৭ বাংলা সনে রামচন্দ্রপুরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৩২১ বঙ্গাব্দের ৩১ শ্রাবণ দেহত্যাগ করেন। তিনি বিএম স্কুলের দরিদ্রবান্ধব সমিতি পরিচালনা করে সুখ্যাতি অর্জন করেন। তার কলেরা রোগীর সেবা দেখে এক বিদেশী বলেছিলেন, বিদেশে মরণ হলে যেন বরিশালে হয়।” তার মৃত্যুর পর ঋষিতুল্য জগদীশ আচার্য্য স্কুলের প্রধান শিক্ষক নিযুক্ত হন। তিনি ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দের ২ মে বাগেরহাটে জন্মগ্রহণ করেন। জনগণের চাপে বিএম স্কুলকে ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে জাতীয় বিদ্যালয়ে পরিণত করা হয়। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হলেন অমৃত লাল দাশগুপ্ত এবং টেকনিক্যাল বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নিযুক্ত হলে নগেন্দ্র বিজয় ভট্টাচার্য।

ব্রজমোহন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকবৃন্দ: ১. পূর্ণচন্দ্র উকিল ১৮৮৪; ২. কালীশ চন্দ্র গুহ ১৮৮৫-১৯০০; ৩. জগদীশ আচার্য ১৯০১-২১; ৪. অমৃত লাল দাশগুপ্ত ১৯২১-৪৭; ৫. যোগেশ চট্টোপাধ্যায় ননীবাবু ১৯৪৭-৫৭; ৬. সত্যপদ ঘোষ ১৯৫৭-৫৮; ৭. জয়ন্ত কুমার দাশগুপ্ত ১৯৫৮-৭৫।


উপসংহার

এ বিদ্যালয়ের ছাত্রদের প্রকৃত মানুষ হিসেবে গঠন করা হতো। মহাত্মা অশ্বিনীকুমার দত্ত একবার বলেছিলেন, ‘ব্রজমোহন বিদ্যালয়ের ইতিহাসই আমার জীবনচরিত’।



তথ্যসূত্র: ১। সিরাজ উদ্দীন আহমেদ। বরিশাল বিভাগের ইতিহাস (১ম খন্ড)। ভাস্কর প্রকাশনী, ঢাকা। ২০১০।