বাকলা সমাজ
স্বাধীন চন্দ্রদ্বীপ রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা দনুজমর্দন চন্দ্রদ্বীপে হিন্দু সমাজ বিধিবিধান দিয়ে বাকলা সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন। দনুজমর্দন বল্লাল সেনের মতো বঙ্গজ কায়স্থদের সমাজ সমীকরণ করেন। বিক্রমপুর হতে সেন রাজদের পতনের পর তাদের প্রতিষ্ঠিত ‘বিক্রমপুর সামাজ’ ভেঙ্গে পড়ে। বাংলার উচ্চকোটি হিন্দুদের এই সঙ্কটময় মুহূর্তে দনুজমর্দন চন্দ্রদ্বীপে সমাজ সমীকরণ করে বঙ্গজ কায়স্থ সমাজ পুনপ্রতিষ্ঠা করেন। এ সমাজের জনপ্রিয় নাম ছিল ‘বাকলা সমাজ’। চন্দ্রদ্বীপে রাজা হইয়া দনুজমর্দন দেব প্রদেশে কায়স্থ সমাজে গোষ্ঠীপতিত্ব লাভ করেন। দনুজমর্দন নিজ রাজধানীতে কুলীন কায়স্থগণের সমীকরণ করেন। ফলশ্রুতিতে বাকলা-চন্দ্রদ্বীপ একটি প্রসিদ্ধ সমাজ স্থান হয়। দনুজমর্দন বঙ্গজ কুলীন সমাজের গোষ্ঠীপতি ছিলেন। দনুজমর্দন বঙ্গীয় কায়স্থদের অস্তিত্ব রক্ষা করে হিন্দু সমাজ ও সংস্কৃতির ইতিহাসে বিশেষ অবদান রেখেছেন। তিনি নিজে ভরদ্বাজ গোত্র দেববংশীয় মৌলিক কায়স্থ শাখাভুক্ত ছিলেন। তিনি প্রথমে বঙ্গীয় কায়স্থ সমাজ গঠন করেন। তারপর তিনি বাকলা সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি বঙ্গজ কুলীনদের ৫/৬/৭ পর্যায় নিয়ে প্রথম সমাজ সমীকরণ বা সংস্কার করেন। তার নেতৃত্বে বাকলা সমাজ বাংলাদেশে শ্রেষ্ঠ স্থান দখল করে- “চন্দ্রদ্বীপং শিরস্থান যত্র কুলীনমন্ডলং”।
এই সমাজে চন্দ্রদ্বীপের কুলীন হিন্দুরা বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ বলে বিবেচিত ছিলেন। চন্দ্রদ্বীপ স্বাধীন রাজ্য। তাই উচ্চবর্ণের হিন্দুগণ তাদের অস্তিত্ব, বর্ণ ও ধর্মকে টিকিয়ে রেখে কৌলীণত্বের শ্রেষ্ঠ স্থান অধিকার করেন। বাকলা সমাজ উত্তরে ঢাকার বিক্রমপুর, দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর, পূর্বে ভুলুয়া, সন্ধীপ ও পশ্চিমে যশোর-খুলনা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এই সীমার বাইরে কেউ বাস করলে তার কৌলীন্য নষ্ট হতো। কুলীন কায়স্থরা স্বদেশী ব্যতীত যাতে বিবাহ কার্য না করেন সে জন্য দনুজমর্দন বিশেষ নিয়ম বিধিবদ্ধ করেন। তিনি ইদিলপুরের কায়স্থদের কুলাচার্যগণকে ব্রহ্মোত্তর প্রদান করেন। ইদিলপুরের ভূমিদান গ্রহণ করে অনেক ব্রাহ্মণ ও কায়স্থ বসতি স্থাপন করেন। তারা ও তাদের বংশধররা ঘটক সর্নামত্য ব্রাহ্মণ ও কায়স্থ সমাজে বিশেষ পূজ্য। দনুজমর্দন কুলীনদের বিশুদ্ধি রক্ষা করার জন্য ব্রাহ্মণদের মধ্যে কুলাচার্য বা ঘটক এবং সর্নামত্য নামক দু’টি পদ সৃষ্টি করেন। রাজার নিমন্ত্রিত কুলীন কায়স্থরা ভোজনের সময় কে রাজার দক্ষিণে বা কে বামে বসবেন কুলগ্রন্থ দেখে তার নির্দেশ করতে দিতেন। তদনুসারে কুলীনরা ভোজন সারিতে মর্যাদা অনুসারে বসতেন। কায়স্থরা রাজপুরীতে যে অংশে ভোজন করতেন তার নাম ছিল ‘চিত্রছত্র’। মাঝখানে সমাজপতি রাজার আসন ছিল। রাজার স্থাপিত কায়স্থ সমাজের মধ্যে পুত্র-কন্যা বিবাহের পূর্বে রাজার অনুমতি নিতে হতো এবং রাজাকে রাজমধ্যস্থ নামে কর দিতে হতো। রাজার বিনানুমতিতে বিবাহ হলে দন্ডিত হতো। ব্রাহ্মণদিগকে রাজা ‘নমস্কারা নিবেদনঞ্চ বিশেষ’ পাঠে পত্র লিখতেন এবং কুলীনদের ‘সানুগ্রহ পত্রমিদং’ ইত্যাদি লিখতেন। কোন ব্রাহ্মণ বা কুলীন রাজাকে ‘আর্দ্দান শ্রী’ এভাবে লিখতে হতো। কায়স্থরা রাজসভায় উপস্থিত হলে রাজাকে কুর্নিশ করতে হতো। এ প্রথা চন্দ্রদ্বীপ রাজাদের মধ্যে বহুদিন প্রচলিত ছিল।
দনুজর্মনের আগমনের পূর্বে চন্দ্রদ্বীপে উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণ ও কায়স্থদের সংখ্যা বেশি ছিল না। চন্দ্রদ্বীপ রাজ্য প্রতিষ্ঠা ও বাকলা সমাজ গঠনের ফলে চন্দ্রদ্বীপে অনেক ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, বৈদ্য, ঘটককারিকা ও সংস্কৃত পন্ডিত চন্দ্রদ্বীপে আগমন করেন। গৌড় ও সোনারগাঁও মুসলমান সুলতানদের অধীনে থাকায় হিন্দু কুলীনরা চন্দ্রদ্বীপে আশ্রয় নেয়। চন্দ্রদ্বীপ একমাত্র হিন্দুরাজ্য বিধায় এখানে হিন্দু সাহিত্য সংস্কৃতি প্রসার লাভ করে। সমাজে ব্রাহ্মণ ও কায়স্থরা প্রধান ছিলেন। চন্দ্রদ্বীপের অধিকাংশ অধিবাসী ছিল কৃষক-শ্রমিক। তারা চন্ডাল, জেলে ও তাঁতী সম্প্রদায়ভুক্ত ছিল। সমাজে দনুজমর্দন সৃষ্ট কৌলীন্যের প্রভাব থাকায় সংখ্যাগুরু কৃষক সমাজ অর্থনৈতিক ও সামাজিকভবে নিপীড়ত হতো। সমাজের এই বৈষম্য শত শত বছর ধরে চলতে থাকে।
তথ্যসূত্র: ১। সিরাজ উদ্দীন আহমেদ। বরিশাল বিভাগের ইতিহাস (১ম খণ্ড)। ভাস্কর প্রকাশনী, ঢাকা। ২০১০।