বাকলা-চন্দ্রদ্বীপের পরগণাসমূহ

Barisalpedia থেকে
Spadmin (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ২৩:৩০, ২৬ অক্টোবর ২০১৭ পর্যন্ত সংস্করণে (১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সময় বরিশালের পরগণাসমূহ)

(পরিবর্তন) ←পুর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ→ (পরিবর্তন)

বরিশালের অর্থাৎ মোগল আমলের বাকলা-চন্দ্রদ্বীপের ভূমি ব্যবস্থায় প্রথম সরকার ও পরগণাভিত্তিক প্রশাসন শুরু হয় টোডরমলের ভূমি সংস্কারের মধ্য দিয়ে। তবে মোগল আমলেই বরিশালের সরকার ও পরগণার সংখ্যা আকবরের সময় থেকে শুরু করে মেষ মোগল সম্রাট পর্যন্ত অনেকবার পরিবর্তিত হয়েছে। আকবরের আমলে ছিল তিনটি সরকার ও ৬টি পরগণা আর ১৭২৮ সালের পরে সরকার দাড়ায় ৪টি এবং পরগণা ২৮টি।


আকবরের সময়ের পরগণা

মোগল আমলের ভূমি ব্যবস্থায় বর্তমান বরিশাল বিভাগ এবং তদসঙ্গে আরো সংযুক্ত ভূমি ৩টি সরকারে বিভক্ত ছিল। পশ্চিমাংশের নাম ছিল সরকার ফতেহাবাদ। মধ্য ও দক্ষিণ ভাগের নাম ছিল সরকার বাকলা। উত্তরাংশে সেলিমাবাদ পরগণা সরকার খলিফাতাবাদের অধীন ছিল।

সরকার বাকলার অধীনে ৪টি পরগণা ছিল। ১. বাকলা-ইসলামপুর পরগণা যার রাজস্ব ছিল ১,০৮,৬৯৯ টাকা। ২. শ্রীরামপুর পরগণা যার রাজস্ব ছিল ৬৩০০ টাকা। ৩. ইদিলপুর পরগণা যার রাজস্ব ছিল ৩৮,৮৩৫ টাকা। এবং ৪. শাহাবাজপুর পরগণা যার রাজস্ব ছিল ২৬৫২০ টাকা। বাকলার খাসভূমির মোট রাজস্ব ছিল-১,৭৬,৩৫১ টাকা। সরকার ফতেহাবাদ ও সরকার ফতেহাবাদে আরো দুটি পরগণাসহ আকবরের আমলে বাকলা-চন্দ্রদ্বীপে মোট ৬টি পরগণা ছিল।


শাহ সুজার আমলে পরগণা

শাহ সুজার আমলে ১৬৫৮ সালে দ্বিতীয় ভূমি বন্দোবস্ত করা হয় এবং বাকলায় সরকার মুরাদখানা এবং পরগণা আকলা (গোচারণ ভূমি) ও পরগণা বানজার (বনভূমি) সৃষ্টি করা হয়।


মোগল আমলের শেষ বন্দোবস্ত

মুর্শিদ কুলি খাঁর আমলে ১৭২২ সালে ও নবাব সুজাউদ্দৌলার আমলে ১৭২৮ সালে তৃতীয় ভূমি সংস্কার করা হয়। ১৭২৮ সালে বাকলা-চন্দ্রদ্বীপে ৪টি সরকার, ১৭টি পরগণা, ৫৯টি মহল ও ২৭ জন জমিদার ছিল। ১৭২৮ সালে ভূমি রাজস্ব ছিল ২,৯০,১১১ টাকা।


১৭২৮ সালের ভূমি বন্দোবস্তের পরে পরগণা

১৭২৮ সালে ভূমি বন্দোবস্ত অনুযায়ী বাকলা-চন্দ্রদ্বীপে মোট চারটি সরকার সৃষ্টি হয়। চারটি সরকারে তখন মোট ১৯টি পরগণা ছিল। ১। সরকার বাকলার পরগণাসমূহ: ১. ইদিলপুর (রাজস্ব ৪৭৭০৪ টাকা), ২. ইদ্রাকপুর (রাজস্ব ১০৮০৭ টাকা), ৩. বীরমোহন (রাজস্ব ৫২৮৮ টাকা), ৪. বাংড়োরা (রাজস্ব ১১০৪৪ টাকা), ৪. চন্দ্রদ্বীপ (রাজস্ব ৬৬০৮ টাকা), ৫. জাহাপুর (রাজস্ব ৬৭১ টাকা), ৬. মইজরদী (রাজস্ব ৬২৫৭ টাকা), ৭. নাজিরপুর (রাজস্ব ৬৮৯ টাকা), ৮. রামনগর (রাজস্ব ১০৯৫ টাকা), ৯. শ্রীরামপুর (রাজস্ব ৮৬০৫ টাকা), ১০. সুলতানাবাদ (রাজস্ব ৩৬৩ টাকা), ও ১১. শায়েস্তানগর (রাজস্ব ৩৯৫৬ টাকা)। মোট রাজস্ব ১,৩২,০৪৮ টাকা

২। সরকার বাজুয়ার পরগণাসমূহ: ১. বুজুর্গ উমেদপুর (রাজস্ব ৮৬৮৯ টাকা), ২. খাঞ্জাবাহাদুর নগর (রাজস্ব ৯ টাকা), ৩. জাফরাবাদ (রাজস্ব ৪০ টাকা), ৪. রফিনগর (রাজস্ব ১২৫ টাকা), ৫. শায়েস্তাবাদ (রাজস্ব ৭২৬ টাকা)। মোট রাজস্ব ৯৫৮৯ টাকা।

৩। সরকার ফতেহাবাদের পরগণাসমূহ: ১. উত্তর শাহবাজপুর (রাজস্ব ৭০৩০ টাকা), ২. দক্ষিণ শাহবাজপুর (রাজস্ব ৩৪৩২ টাকা)।

৪। সরকার খলিফাতাবাদের পরগণাসমূহ: ১. সেলিমাবাদ (রাজস্ব ৪৩১৬৬ টাকা)

১৭২৮ খ্রিস্টাব্দের পর আরও যে পরগণাসমূহ সৃষ্টি হয় সেগুলো হলো ১. গিরদেবন্দর, ২.তপ্পে সেলিমাবাদ, ৩. রতনদী-কালিকাপুর, ৪. আলিনগর, ৫. আবদুলপুর, ৬. আজিমপুর, ৭. হাবিবপুর ও ৮. আওরঙ্গপুর।


১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সময় বরিশালের পরগণাসমূহ

১। চন্দ্রদ্বীপ ২,৩২,৯৭৯ একর ১,৩৪,৭৩৬ টাকা ২। সেলিমাবাদ ২,৪৬,৫০৫ একর ৯৮,২৩৪ টাকা ৩। বুজুর্গ উমেদপুর ২,৪৩,৮৮৭ একর ১,৯৩,১৮১ টাকা ৪। দক্ষিণ শাহবাজপুর ১,০৯,১৩৮ একর ৬৩,৪৩৩ টাকা ৫। ইদিলপুর ৭৮,৫৩১ একর ৪৭,৬৬২ টাকা ৬। নাজিরপুর ৬২,৭৯৩ একর ৩৬,৭১৮ টাকা ৭। বাংগরোড়া ৬৪,০৮৩ একর ১৯,৯২০ টাকা ৮। সৈয়দপুর ৬৪,৫৭১ একর ৬,৫৪০ টাকা ৯। হাবিবপুর ৫৯,৬৫২ একর ১,৯৬৯ টাকা ১০। সুলতানাবাদ ৪৬,২৩৯ একর ২৫,৭৪৭ টাকা ১১। রতনদী কালিকাপুর ৩৭,৯২০ একর ২৬,৪১৬ টাকা ১২। আওরঙ্গপুর ৩৪,৫৬৪ একর ১৬,৬১০ টাকা ১৩। উত্তর শাহবাজপুর ২২,১৮০ একর ১৭,৭৯১ টাকা ১৪। হাবেলী সেলিমাবাদ - ১,৩৩৫ টাকা ১৫। শায়েস্তানগর ১৭,৯১৭ একর ১৬,৩৩৫ টাকা ১৬। আজিমপুর ১৩,৯৮৯ একর - ১৭। শাহজাদপুর ১৩,১৮১ একর ৭,৭৪১ টাকা ১৮। কৃষ্ণদেবপুর ১১,৪২৫ একর ৮৪০ টাকা ১৯। ইদ্রাকপুর ১০,০০৩ একর ৪,৪০১ টাকা ২০। শায়েস্তাবাদ ৯,২২০ একর ২০৩ টাকা ২১। রামনগর ৮,১৯৩ একর ৭,৩৮৬ টাকা ২২। খাঞ্জে বাহাদুর নগর ৮,১৮৫ একর ৮,৪৮৭ টাকা ২৩। বৈকুণ্ঠপুর ৬,৭৮৬ একর ২,৬৪৭ টাকা ২৪। শ্রীরামপুর ৬,৫৫৫ একর ৮,৩৪৫ টাকা ২৫। তপ্পে বাহাদুরপুর ৬,১২১ একর ৪,৯১৩ টাকা ২৬। বীরমোহন ৫,৩২৮ একর ৬১০ টাকা ২৭। রসুলপুর ৫,১০০ একর ৩,৩১৬ টাকা ২৮। তপ্পে আলী নগর ৫,০৩৬ একর ১,৫৭৮ টাকা ২৯। দুর্গাপুর ৫,৬১৭ একর ৪৭৮৬ টাকা ৩০। আবদুল্লাপুর - - ৩১। কাসিমনগর ৪৪৩৮ একর ১৬৩৪ টাকা ৩২। কাদিরাবাদ ৩৬২৮ একর ১৮০২ টাকা ৩৩। কাসিমপুর শিলাপট্টি ৩৮৫৩ একর ২৫০৪ টাকা ৩৪। তপ্পে হাবেলী ১৯৮৬ একর ১১২২ টাকা ৩৫। জাহাপুর ১৭৫৮ একর ৮৯২ টাকা ৩৬। তপ্পে ছবিপুরকালা ১৪৪৫ একর ১৪৯৩ টাকা ৩৭। তপ্পে বীরমোহন ১৩২০ একর ৩২৭ টাকা ৩৮। তপ্পে লক্ষ্মীদিয়া ৪২৫ একর ৬০৪২ টাকা ৩৯। গিরদে বন্দর ৬৮ একর ৫৩ টাকা ৪০। মৈজারদী - ৩১৯৭ টাকা ৪১। বিজয়নগর ১০০ একর ১৩৪ টাকা ৪২। রামহরিতাজ ৮৮ একর ১১৯ টাকা ৪৩। চরকলমী ৬৮ একর ৯৫ টাকা ৪৪। তেলিহাতি ১৭৩৫১ একর ৪৪৩ টাকা ৪৫। গোপালপুর মৃজানগর ১৪০৫৬ একর ৭০২৮ টাকা ৪৬। সুলতান খারুরিয়া ১০৫৫১ একর ১৯৮৪ টাকা ৪৭। কামরাপুর টেপা, ঢাকা ১৬১২ একর ৬৫২ টাকা ৪৮। মকিমাবাদ, ঢাকা ১৬১১ একর ২৩৬ টাকা ৪৯। শিবপুর (ফরিদপুর) ১৪০৯ একর ১১৬ টাকা ৫০। সুজানগর ১৬৬৩ একর ১৫২৯ টাকা ৫১। ফতেজাংপুর ৫৩৭ একর ৫৯ টাকা ৫২। রাজনগর (ফরিদপুর) ৪২৫ একর ৩২২৭ টাকা ৫৩। শায়েস্তানগর (নোয়াখালী) ৩৪৩ একর ১৭২ টাকা ৫৪। মাদিয়াপুর ২১৩ একর ৫৭ টাকা ৫৫। মকিমপুর যশোর ১৭৬ একর ১৭১ টাকা ৫৬। কোটালীপাড়া ৮৪ একর ৩ টাকা ৫৭। গিরদে বন্দর (ফরিদপুর) ৬২ একর ১১ টাকা ৫৮। আমিরাবাদ (ঢাকা) ৩ একর ১ টাকা ৫৯। তপ্পে আমিরাপুর - - ৬০। নদী শিকস্তি ৩৬৬৬৯ একর। ৬০টি পরগণার মোট ভূমি ১৫,৫০,০০০ একর এবং মোট খাজনা ৮,২৩,৬৬৫ টাকা।

পরগণার জমিদারগণ

আকবরের সময় বরিশাল বিভাগে মাত্র ৬টি পরগণা ছিল এবং নবাব সিরাজউদ্দৌলার সময় ২৮টি পরগণা ছিল। সব পরগণা চন্দ্রদ্বীপ রাজ্য থেকে সৃষ্ট। চন্দ্রদ্বীপ পরগণা মাধবপাশার রাজার অধীনে ছিল। চন্দ্রদ্বীপের পরে সেলিমাবাদ দ্বিতীয় বৃহত্তম পরগণা। রায়েরকাঠির রায়েরা এ পরগণার জমিদার ছিলেন। ইদিলপুর বা আদিলপুর একটি প্রাচীন পরগণা। এ পরগণার জমিদার ছিলেন ইদিলপুরের চৌধুরী বংশ। উত্তর শাহবাজপুরের জমিদার ছিলেন চাঁদ রায় ও তার বংশধররা। ভূষণ উল্লা ও বিজলী নারায়ণ দক্ষিণ শাহবাজপুরের প্রথম জমিদার। তাদের পরে শ্রীপুরের জমদিার আবু সাইেেদর স্ত্রী সারতাজ বিবি এ পরগণার মালিক হন। সৈয়দ আবদুল্লাহ চৌধুরী ও বরিশালের খানমবাড়ির মেহেরুন্নেসা সুলতানাবাদ পরগণার ভূস্বামী ছিলেন। জাহাপুর ও আজিমপুরের জমিদার ছিলেন মুলাদীর ইচরি ও তেরচরের দত্ত ও চৌধুরীরা। চৌধুরীদের পূর্বপুরুষ ভগবান দাশ দিল্লী থেকে চন্দ্রদ্বীপে আসেন। তার পুত্র রামেশ্বর দত্ত চন্দ্রদ্বীপ রাজার সেনাপতি ছিলেন। শায়েস্তাবাদের মীর আসাদ আলী শায়েস্তাবাদ পরগণা, গৈলার দাশেরা বাঙ্গড়োরা, রতেœশ্বর রায় রতনদী কালিকাপুর ও পোনাবালিয়ার চৌধুরী বংশ তপ্পে সেলিমাবাদ পরগণার জমিদার ছিলেন।


পরগণার নামকরণ

স¤্রাট জাহাঙ্গীরের নাজির উলফত গাজীর নামে নাজিরপুর, সুজাউদ্দিনের সেনাপতি মীর হাবিবের নামে হাবিবপুর, শায়েস্তাখানের পুত্র বুজুর্গ উমেদ খাঁর নামে বুজুর্গ উমেদপুর, রাজা বল্লভের কর্মচারী রামনারায়ণের পুত্রের নামে রামনগর পরগণা সৃষ্টি হয়। আওরঙ্গজেবের নামে আওরঙ্গপুর ও তার পৌত্র আজিম শাহের নামে আজিমপুর ও দরবেশ মাহমুদ ইদ্রাকের নামে ইদ্রাকপুর পরগণা সৃষ্টি হয়।

মোগল আমলের এই ভূমি ব্যবস্থা ইংরেজ আমলে প্রশাসনিক সংস্কারের সাথে ধীরে ধীরে ভিন্নরূপ পরিগ্রহ করে।



তথ্যসূত্র: ১। সিরাজ উদ্দীন আহমেদ। বরিশাল বিভাগের ইতিহাস (দ্বিতীয় খণ্ড)। ভাস্কর প্রকাশনী, ঢাকা। ২০১৫