বরিশাল হিতৈষী

Barisalpedia থেকে

বরিশাল হিতৈষী বরিশালের সবচেয়ে দীর্ঘজীবী সাপ্তাহিক পত্রিকা। এটি ১৮৯৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং ১৯৬০ এর দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত বেঁচেছিল। প্রথমে এটি অর্ধসাপ্তাহিক ছিল এবং এর সম্পাদক ছিলেন রাজমোহন চট্টোপাধ্যায়। পরে সম্পাদক দুর্গামোহন সেনের হাতে এটি সাপ্তাহিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে এবং দুর্গামোহন সেনই এর প্রায় সারাজীবনের সম্পাদক ছিলেন। পত্রিকাটির অফিস ছিল শ-রোডে।

১৯০৬ সালে বরিশালের বঙ্গীয় প্রাদেশিক সম্মেলনের প্রথম অধিবেশনের কয়েক সপ্তাহ আগে ‘ন্যাশনাল মেশিন প্রেস’ এর মালিকগণ ৫০টাকা সহ প্রেসটি শ্রী দুর্গামোহন সেনকে দান করেন এবং পন্ডিত রাজমোহন চট্টোপাধ্যায় ও তার পত্রিকা ‘বরিশাল হিতৈষী’র স্বত্বাধিকার দুর্গামোহন সেনকে প্রদান করেন। বঙ্গীয় প্রাদেশিক সম্মেলনের কয়েক সপ্তাহ আগে পত্রিকাটি অর্ধ-সাপ্তাহিক হিসেবে প্রকাশিত হতো। যদিও সম্মেলনের অব্যবহিত পরে পত্রিকাটি নিয়মিত সাপ্তাহিকে রূপান্তরিত হয়। প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায়, প্রথমে রাজমোহন চট্টোপাধ্যায়, প্রিয়নাথ গুহ, তারপরে দুর্গামোহন সেন, এরপরে প্রাণকুমার সেন এবং সবশেষে দুর্গামোহন সেনের পুত্র বিমল সেন পত্রিকাটি সম্পাদন করেন। তবে এ বিষয়ে সামান্য মতভেদ আছে।

দুর্গামোহন সেনের পুত্র বিমল সেন ২৫. ৭. ১৯৯১ তারিখে এক চিঠিতে জানিয়েছেন ‘১৯৫৮ সনের সেপ্টেম্বর মাসে পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাকে গ্রেফতার করা হয়। আমার সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘বরিশাল হিতৈষী’র একটি সম্পাদকীয় আপত্তিকর বলিয়া আমাকে ১ বৎসর সশ্রম কারাদন্ড দেওয়া হয়। ১৯৫৪-১৯৫৬ সন পর্যন্ত ‘বরিশাল হিতৈষী’র সম্পাদক ছিলাম। ‘বরিশাল হিতৈষী’র প্রতিষ্ঠা হয় ১৮৯৮ সালে। প্রথম সম্পাদক ছিলেন মহাত্মা অশি^নীকুমার দত্ত। কয়েক মাস পরেই সম্পাদনার দায়িত্বে আসেন আমার পিতৃদেব দুর্গামোহন সেন। ১৯৫০ সনে বাবা পশ্চিমবঙ্গে চলিয়া আসার পর তিন-চার বৎসর প্রাণকুমার সেন সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন।’ অবশ্য অশি^নীকুমার দত্ত এর সম্পাদক ছিলেন এমন কথার ঐতিহাসিক ভিত্তি খুঁজে পাওয়া যায় না।

এ পত্রিকাটি প্রায় ৭০ বৎসর যাবৎ প্রকাশিত হয়েছিল। স্বদেশী আন্দোলনসহ ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনে ‘বরিশাল হিতৈষী’র ভূমিকা ছিল। চারণ কবি মুকন্দ দাস নিয়মিত এই পত্রিকাটিতে নিবন্ধাদি লিখতেন। সুরেশচন্দ্র গুপ্ত এই পত্রিকাটির সাথে দীর্ঘকাল ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। মূলত তিনি পত্রিকার সম্পাদকীয় লিখতেন। ‘বরিশাল হিতৈষী’র সম্পাদকীয়গুলো ছিল মুখরোচক এবং পথ নির্দেশক। জে. সি. জ্যাক পত্রিকাটির প্রচার সংখ্যা ৬০০ বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন। পত্রিকাটি সম্পাদকীয় কলামের শিরোনামায় থাকতো একটি কবিতা। ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় এর প্রকাশকাল বৈশাখ ১৩০৩ বলে উল্লেখ করেছেন। পত্রিকাটির প্রকাশকাল সম্পর্কে ১৩০৬ সনের ৩২শে জ্যৈষ্ঠ সাপ্তাহিক ‘অনুসন্ধান’ পত্রিকায় লেখা হয়েছে: ‘বরিশালের হিত সাধনে তৃতীয় বর্ষ অতিক্রম করিয়া চতুর্থ বর্ষে পদার্পন করিয়াছে দেখিয়া, আমরা পরম সুখী হইলাম।’ ১৩০৬ সনের ৩২শে জ্যৈষ্ঠ মানে হলো ১৪ জুন ১৮৯৯। উক্ত তারিখে চতুর্থ বছরে পদার্পণ করলে হিসেবমতে পত্রিকাটির প্রতিষ্ঠাকাল দাঁড়ায় ১৮৯৬ সালের জুন মাস।

‘স্বাধীনতা সংগ্রামে বরিশাল (২য় খন্ড)’ গ্রন্থে দেখা যায় বর্ণিত আছে যে, বরিশালের বিকনা গ্রামের বসন্ত রায় ছিলেন আমেরিকায়। তথায় তিনি India League গঠন করেছিলেন। তার মুখপত্র ছিল Indian Freedom। এই পত্রিকার ‘বরিশাল হিতৈষী’র সঙ্গে বিনিময় ব্যবস্থা ছিল। বিপ্লবী শৈলেন্দ্রনাথ ঘোষ দেশে ফিরে এসে ব্রজমোহন কলেজের অধ্যক্ষ হয়েছিলেন। তিনি এক সভায় বলেছিলেন- ‘আমরা আমেরিকায় বসে বরিশালের দুটি নামই জানতাম। একটি অশি^নীকুমার, দ্বিতীয়টি ‘বরিশাল হিতৈষী’র সম্পাদক দুর্গামোহন সেন’।

ইংল্যান্ডের ইন্ডিয়া হাউজ’-এ বরিশাল হিতৈষী’ সম্পর্কে তৎকালীন ম্যাজিষ্ট্রেট রিপোর্ট পাঠিয়েছিলেন- ‘Kashipur Nibashi’ is a most loyal paper, But unfortunately ‘Barishal Hitaishi’ the most objectionable paper read everywhere’. মাসিক প্রবাসী পত্রিকায় শ্রী ননীমাধব চৌধুরী লিখেছেন: ‘তদানীন্তন কালে দেশে চরমপন্থী কাগজ বেশী ছিল না। বারীন্দ্রকুমার ঘোষের ‘যুগান্তর’, মনোরঞ্জন গুহঠাকুরতার ‘আত্মশক্তি’, বিপিনচন্দ্র পালের ‘নিউ ইন্ডিয়া’, এবং বরিশালের দুর্গামোহন সেনের ‘বরিশাল হিতৈষী’ ছাড়া’।

‘বরিশাল হিতৈষীর’ সম্পাদক দুর্গামোহন সেন মহাশয় বি. এল. পরীক্ষা দিতে কলকাতা গেলে নরেন বাবু অনেক সময়ই সম্পাদকীয় প্রবন্ধ লিখতেন। এই সময়ে বাংলা ১৩১৪ সনে (১৯০৭) ‘আমাদের শক্তি কোথায়’ নামে নরেনবাবুর একটি প্রবন্ধের জন্য দুর্গামোহন সেন মহাশয় সম্পাদক হিসেবে রাজদ্রোহের অভিযোগে অভিযুক্ত হন ও এক বছরের কারাদন্ড লাভ করেন। প্রিন্টার হিসেবে আশুতোষ বাগচী ছয় মাসের কারাদন্ডে দন্ডিত হন। বলা বাহুল্য যে দুর্গামোহন বাবু সে প্রবন্ধের লেখক না হলেও ঐ প্রবন্ধ প্রকাশের সমুদয় দায়িত্ব নিজ স্কন্ধে গ্রহণ করেছিলেন। প্রবন্ধলেখকের নাম দুর্গামোহন বাবু প্রকাশ করেননি। দুর্গামোহন বাবুর জেলে থাকা কালে তাঁর অবর্তমানে শ্রী ভবরঞ্জন মজুমদার ও বরিশালের লব্ধ প্রতিষ্ঠিত উকিল শ্রীবরদাকান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় পত্রিকাটি পরিচালনা করতেন। বিভিন্ন সময় এ পত্রিকাটির সঙ্গে ওতপ্রতভাবে যারা জড়িত ছিলেন তাদের মধ্যে চারনকবি মুকুন্দ দাস, ভবরঞ্জন মজুমদার, বরদাকান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়, নরেন্দ্রনাথ সেন, ললিতমোহন সেন, সুরেশচন্দ্র গুপ্ত প্রমুখের নাম উল্লেখ করবার মতো। মুকুন্দ দাস যে এ পত্রিকায় লিখতেন তার প্রমাণ পাওয়া যায় ‘স্বাধীনতা সংগ্রামে বরিশাল (১ম খন্ড) গ্রন্থে। সেখানে আছে ‘বরিশাল হিতৈষী’ পত্রিকার প্রবীণ সম্পাদক দুর্গামোহন সেন মহাশয় বলেছিলেন- মুকুন্দকে দিয়ে বরিশাল হিতৈষীতে লেখানোটা সহজ কিন্তু তাকে পাওয়াই শক্ত। একদিন জোর করে তাকে ধরে হাতে কাগজ কলম দেওয়া হল। দ্রæত লেখনিতে মুকুন্দের হাত থেকে যা বেরুল তা প্রকাশযোগ্য সুন্দর এক প্রবন্ধ।

১৯৯৭ সালের নভেম্বর ডিসেম্বর সংখ্যা ‘নিরীক্ষা’ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘বাংলাদেশের সংবাদপত্রের ইতিহাস’ (১৭৮০-১৯৪৭)’ শীর্ষক রাচনায় ‘বরিশাল হিতৈষী’ সম্পর্কে লেখা হয়েছে: ‘বাংলা সাপ্তাহিক। প্রচার সংখ্যা ৫০০। বার্ষিক মূল্য ৩ টাকা। সম্পাদক ও মালিক ছিলেন দুর্গামোহন সেন। প্রকাশক ও মুদ্রাকর ধীরেন্দ্রনাথ সেন, বরিশাল ন্যাশনাল মেশিন প্রেস, বাখরগঞ্জ। প্রকাশনা ও মুদ্রণের তারিখ জানা যায় নি। ‘আপত্তিকর’ প্রকাশনার জন্য পত্রিকাটিকে আবার সতর্ক করে দেয়া হয়। আই.পি.ওর ৩(৩) সেকশন বলে প্রেস রক্ষকের কাছ থেকে ১০০০ টাকা জামানত দাবী করা হয়। ১৩-৭-৩২ তারিখে পত্রিকাটিকে আবার সতর্ক করে দেয়া হয়। পত্রিকার সম্পাদক উক্ত ভারতীয় দন্ড বিধির ১২৪ ক ধারা মোতাবেক সশ্রম কারাদন্ড ভোগ করেন এবং ১৯৩৪ সনের আইন অমান্য আন্দোলন মামলায় আবার তিন মাসের সাধারণ কারাদন্ড ভোগ করেন। ‘সেকগাড়স’ শীর্ষক একটি নিবন্ধের জন্য ১৮-১-৩৩ তারিখে পত্রিকাটিকে সতর্ক করে দেয়া হয়। ৬-৯-৩৯ তারিখের সংখ্যায় ‘পরার্থে যুদ্ধ’ এবং ‘আবারো কামান গর্জন’ শীর্ষক দুটি নিবন্ধ ছাপানোর কারনে বরিশালের ডিষ্ট্রিক্ট ম্যাজিষ্ট্রেটকে ১৪-৯-৩৯ তারিখে পত্রিকাটিকে সতর্ক করে দিতে বলা হয়।’



তথ্যসূত্র: তপংকর চক্রবর্তী। বরিশালের সংবাদ ও সাময়িকপত্র। বাংলা একাডেমি। ২০০১।