বরিশাল সিটি কর্পোরেশন

Barisalpedia থেকে

সিটি কপোরেশন ভবন.jpg


সিটি কর্পোরেশন রূপে আত্মপ্রকাশের ইতিহাস

বরিশাল সিটি কর্পোরেশন স্থাপনকল্পে ২০০১ সালের ৯ এপ্রিল ১৯ নম্বর আইন অনুমোদিত হয়। ২০০১ সালের ২৫ জুলাই বরিশাল পৌরসভা সিটি করপোরেশনে উন্নীত হয়। তবে কীর্তনখোলা নদীর তীরে অবস্থিত এ শহরটির জনবসতির ইতিহাস একেবারে হালের নয়। ১৮০১ সালে বাকেরগঞ্জ জেলা সদর বরিশালে স্থানান্তর করার মাধ্যমে শহর হিসেবে এর যাত্রা শুরু হলেও এর ভূগঠন অনেক প্রাচীন কালের। সিটি করপোরেশনের উত্তরে চরবাড়িয়ার মঠবাড়ীতে প্রাপ্ত ২টি স্তম্ভ প্রমাণ করে যে বারো ও তেরো শতকে বরিশালে লোক বসতি ছিল। শহরের আলেকান্দা, সাগরদী ও বগুড়া গ্রামের ভূগঠন সুলতানী আমল হতে রয়েছে। করপোরেশনের উত্তর অংশের ভূগঠন প্রাচীন কালের।

বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের সীমা: পৌরসভাকালীন বরিশাল শহরের আয়তন ছিল ২৫ বর্গকিলোমিটার। ২০০১ সালে বরিশাল সিটি করপোরেশন আইনে আরো ২০ কিলোমিটার অন্তর্ভূক্ত করা হয়। বর্তমান ৪৫ বর্গকিলোমিটার নতুন এলাকা অনুযায়ী এর সীমা হলো- উত্তরে: গণপাড়া, মাতাসার, পুরানপাড়া, সাওয়াসার, উলানখালী। দক্ষিণে: দপদপিয়া মৌজা। পূর্বে: কীর্তনখোলা, মৌজা চরবদনা। পশ্চিমে: কলাডেমা, চহুতা, করমজা, ডেফুলিয়া, ইন্দ্রকাঠি, হরিণা ফুলিয়া, জাগুয়া ও তাজকাঠি। ভৌগোলিক গণিত অনুযায়ী বরিশাল সিটি কর্পোরেশন বিষুবরেখার উত্তরে ২২.৩৭ ডিগ্রি এবং ২২.৪৩ ডিগ্রি অক্ষাংশ এবং গ্রীনিচের পূর্বে ৯০.১০ ডিগ্রি এবং ৯০.৩২ ডিগ্রি দ্রাঘিমার মধ্যে অবস্থিত।

সিটি কর্পোরেশন হিসেবে বর্তমান অবকাঠামো: নগরীতে ৩৬১ কিলোমিটার সড়ক আছে। তন্মধ্যে ১২ কিলোমিটার সিমেন্ট, ৮৫ কিলোমিটার বিটুমিন, ২৫ কিলোমিটার হেরিংবন, ৬৩ কিলোমিটার সুরকি এবং ১৭৬ কিলোমিটার কাঁচা রাস্তা। পয়ঃনিস্কাশনের জন্য শহরে ১৬৫ কিলোমিটার ড্রেন আছে। ৩টি পার্ক আছে: বেলপার্ক, লেডিস পার্ক ও শিশুপার্ক। অনেক পুকুর ও দীঘি আছে, যেমন: পরেশা সাগর, বিবির পুকুর, পুলিশ ক্লাব পুকুর, রাখাল বাবুর পুকুর, বিএম কলেজ পুকুর প্রভৃতি।

বরিশাল শহরের নামকরণ: বরিশাল প্রাচীন চন্দ্রদ্বীপের একটি উন্নত জনপদ। মোগল ও নবাবী আমলে বরিশালে বাণিজ্য বন্দর ছিল। তবে এর পূর্ব নাম ছিল গিরদে বন্দর। লবণ ব্যবসাকে কেন্দ্র করে গিরদে বন্দরের উৎপত্তি। পরবর্তীতে বন্দরের লবণ চৌকির সাথে সম্পৃক্ত হয়ে এর নাম পরিবর্তিত হয় বলে অনুমিত। দক্ষিণ বাংলার সবচেয়ে বড় লবণ চৌকি ছিল এখানে। লবণকে ইংরেজিতে সল্ট বলা হয়। গিরদে বন্দরে বড় সল্ট চৌকি অবস্থিত ছিল। হিন্দুস্তানী ভাষায় বড়ি মানে বড়। এই হিন্দুস্তানী ‘বড়ি’ এবং ইংরেজি ‘সল্ট’ থেকে বরিশাল নামকরণ হয়েছে বলে অনেকে অনুমান করেন। গভর্নর ভেন্সিটাটের নিকট ১৭৬২ সালে লেখা নবাব মীর কাশিমের পত্রে প্রথম বরিশাল নামের উল্লেখ দেখা যায়।


শহরে উত্তরণ ও পৌরসভার ইতিহাস

প্রথম টাউন কমিটি: ১৭৯৭ সালে বাকেরগঞ্জ জেলা সৃষ্টি হয়। ১৮০১ সালে জেলা সদর বাকেরগঞ্জ হতে বরিশালে স্থানান্তর করা হয়। জেলার নাম বাকেরগঞ্জ হলেও জেলা সদর বরিশালে অবস্থিত থাকায় জেলাটি বরিশাল নামেই পরিচিত হতে শুরু করে। ১৮৬৯ সালে ৬ নম্বর আইনের আওতায় ১৮৬৯ সালে বরিশাল টাউন কমিটি সৃষ্টি হয়। ১৮৬৯ সালে নিম্নলিখিত ব্যক্তিদের নিয়ে টাউন কমিটি গঠিত হয়। ১. মি. জেসি প্রাইজ, জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, সভাপতি; ২. মি. ব্রাউন, অতিরিক্ত জেলা জজ, সহ-সভাপতি; ৩. আর জি ম্যাথিউ, পৌর চিকিৎসক, সচিব; ৪. ডব্লিউ এল ওয়েন, সদস্য; ৫. দুর্গামোহন দাস, সদস্য; ৬. চণ্ডীচরণ রায়, সদস্য; ৭. তোফায়েল আহমেদ, সদস্য; ৮. ই. ব্রাউন, সদস্য; ও ৯. স্বরূপচন্দ্র গুহ, সদস্য।

পৌরসভাকালে শহরের অবস্থা ও উন্নয়ন: ১৮৭৬ সালে বরিশাল টাউন কমিটি বরিশাল পৌরসভায় উন্নীত হয়। পৌরসভায় ১০ জন নির্বাচিত, ৪ জন মনোনীত, একজন পদাধিকারবলে সদস্য ছিলেন। চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হতেন। তখন শহরে ৩০৪২টি হোল্ডিং ছিল। কর থেকে বছরে ৭০০০ টাকা আদায় হতো। ১৯১৪ সালে পৌরসভার আয়তন ছিল ৭.৫ বর্গমাইল। করদাতার সংখ্যা ছিল ৩৩৮২ জন। ১৮৯১ হতে ১৯০০ সাল পর্যন্ত পৌরসভার গড় আয় ছিল ২২৬৭৫ টাকা। ১৯১৪ সালে আয় ছিল ৬০৩২৪ টাকা এবং ব্যয় হয় ৫৬২৩২ টাকা।

পানির ব্যবস্থা: ১৯১১ থেকে ১৯১৯ সালে বরিশাল পৌরসভায় পানীয়জলের ব্যবস্থা করা হয়। ২৬০০০ টাকা ব্যয়ে আমানতগঞ্জে পানির কল স্থাপন করা হয়। নদীর পানি এনে বিশুদ্ধ করে শহরে সরবরাহ করা হতো। পানীয়জলের কল স্থাপনে সরকার ৬০ হজার টাকা, জেলা বোর্ড ৩৫ হাজার টাকা প্রদান করে এবং চাঁদা বাবদ ৩০ হাজার টাকা আদায় হয়। নবাব আব্দুল গণিও চাঁদা দেন।

বিদ্যুৎ ব্যবস্থা: ১৯৩৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বরিশাল শহরে প্রথম বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়। ইতিপূর্বে স্টীমার ঘাটে আরএসএন এবং আইজিআর স্টীমার কোম্পানি ১৯২৯ সালে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে। ১৯৩০ সালের পূর্বে শহরে যাতায়াতের জন্য একমাত্র ঘোড়ার গাড়ি ছিল। তারপর টানা রিকশা এবং ১৯৪০ সালের পর রিকশা চালু হয়। জেলা প্রশাসক সাইকেলে অফিসে যেতেন। ১৯৪৭ সালের পূর্বে ২-৩টি গাড়ি শহরে চালু ছিল। বিনোদনের জন্য শহরে ২টি সিনেমা হল-জগদীশ থিয়েটার, দিপালী ছায়া মন্দির চালু হয়।

দেশ বিভাগোত্তর ও স্বাধীনতা পরবর্তী বরিশাল পৌরসভা

১৯৫৯ সালের মৌলিক গণতন্ত্র আদেশে ১৯৬০ সালে মিউনিসিপ্যাল প্রশাসন অধ্যাদেশ অনুসারে বরিশাল মিউনিসিপ্যাল কমিটি গঠন করা হয়। এ সময় অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করত। ১৬টি ইউনিয়ন কমিটি ছিল। প্রত্যেক ইউনিয়নে একজন কমিশনার নির্বাচিত হতো এবং তারা একজন ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত করতো। ১৯৬৯-৭০ সালে মিউনিসিপ্যাল কমিটির আয় ছিল ২০ লাখ টাকা এবং কর থেকে আদায় ছিল ৭,৮৭,০০০ টাকা।

স্বাধীনতার পর লোকাল কাউন্সিল এন্ড মিউনিসিপ্যাল কমিটি সংশোধন আদেশ ১৯৭২ জারি করা হয়। এ আদেশ অনুসারে বরিশাল মিউনিসিপ্যাল কমিটির স্থলে বরিশাল পৌরসভা গটন করা হয়। ১৯৭৩ সালে নির্বাচনে আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহ ও ডাঃ এম এ আজিজ চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ১৯৭৪ সালে পৌরসভার আয়তন ছিল ৯ বর্গমাইল এবং লোকসংখ্যা ছিল ৯৮ হাজার। পৌরসভার হোল্ডিং ছিল ৬৩১৩, পাকা রাস্তা ৫৫.৭৫ বর্গমাইল। ১৯৭৬ -৭৭ সালে আয় ছিল ৪৩১৫৮০৫ টাকা।


বরিশাল পৌরসভার চেয়ারম্যানদের ও সিটি কর্পোরেশনের মেয়রদের তালিকা

১. প্যারিলাল রায়, উকিল, ১৮৮৫-১৮৮৮; ২. দ্বারকানাথ দত্ত, ১৮৮৯-১৮৯২; ৩. অশ্বিনীকুমার দত্ত, ১৮৯৩-১৯০৯; ৪. ড. তারিনী কুমার গুপ্ত, ১৯১০-১৯১৯; ৫. নিবারণচন্দ্র দাশগুপ্ত, উকিল, ১৯২০-১৯৩৪; ৬. শরৎচন্দ্র গুহ, উকিল, ১৯৩৫-১৯৪০; ৭. বরদাকান্ত ব্যানার্জী, উকিল, ১৯৪১-১৯৪৫; ৮. মোফাজ্জল হক, উকিল, ১৯৪৬-১৯৬২; ৯. খান বাহাদুর হাশেম আলী খান, ১৯৫২-১৯৫৪; ১০. মোফাজ্জল হক, উকিল, ১৯৫৪-১৯৫৮; ১১. অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক, ১৯৫৮-১৯৭২ (পদাধিকারবলে চেয়ারম্যান); ১২. আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ, ১৯৭৩-১৯৭৫; ১৩. ডাঃ এম. এ. আজিজ, ১৯৭৫-১৯৭৮; ১৪. এডভোকেট আব্দুর রহমান বিশ্বাস, ১৯৭৮-১৯৮২; ১৫. গোলাম মাওলা, ১৯৮৫-১৯৯০; ১৬. এম এ কামাল, ১৯৯১-২০০২; ১৭. মোঃ আহসান হাবিব কামাল, মেয়র, ২৫-০৭-২০০২ থেকে ১৪-০৪-২০০৩; ১৮. আলহাজ্ব এ্যাড: মোঃ মজিবর রহমান সারোয়ার ২৪-০৪-২০০৩ থেকে ২১-০-২০০৭ (প্রথম নির্বাচিত মেয়র); ১৯. আওলাদ হোসেন (দিলু) ভারপ্রাপ্ত মেয়র, ২২-০৭-২০০৭ থেকে ১০-০৯-২০০৮; ২০. শওকত হোসেন হিরণ ১১-০৯-২০০৮ থেকে জুন ২০১৩; ২১. মোঃ আহসান হাবিব কামাল, ২০১৩ থেকে...।


সিটি করপোারেশনের ব্যবস্থাপনা

২০০১ সালের সিটি করপোরেশন আইনে একজন মেয়র ও একজন ডেপুটি মেয়রের পদ ছিল। কিন্তু ২০০২ সালের সংশোধনীর ফলে ডেপুটি মেয়র পদ বিলুপ্ত করা হয়। মেয়র, সাধারণ আসনে ৩০ জন এবং মহিলা সংরক্ষিত আসনে ১০ জন কমিশনার সিটি করপোরেশনের প্রশাসনে দায়িত্ব নিয়োজিত আছেন। ২০০৩ সালের মার্চ মাসে মেয়র ও ৪০ জন কমিশনার নির্বাচিত হন। সরকার কর্তৃক নিয়োগকৃত একজন মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা করপোরেশনের নির্বাহী দায়িত্ব পালন করেন। ব্যবস্থাপনার জন্য করপোরেশনকে কয়েকটি বিভাগে বিভক্ত করা হয়। সিটি করপোরেশনের প্রশাসনিক বিভাগ ও জনবল হলো: ১. মেয়র, ২. সচিব, ৩. একান্ত সচিব, ৪. সহকারী একান্ত সচিব, ৫. প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, ৬. উপসচিব, ৭. ম্যাজিস্ট্রেট, ৮. মুখ্য রাজস্ব কর্মকর্তা, ৯. কর কর্মকর্তা, ১০. পূর্ত বিভাগ, ১১. প্রধান প্রকৌশলী, ১২. তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী, ১৩. নির্বাহী প্রকৌশলী, ১৪. প্ল্যানিং সেল, ১৫. পরিচ্ছন্নতা বিভাগ, ১৬. জনস্বাস্থ্য বিভাগ, ১৭. প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা, ১৮. স্বাস্থ্য কর্মকর্তা, ১৯. পানি সরবরাহ বিভাগ।


তথ্যসূত্র: ১। সিরাজ উদ্দীন আহমেদ। বরিশাল বিভাগের ইতিহাস (দ্বিতীয় খণ্ড)। ভাস্কর প্রকাশনী, ঢাকা। ২০১৫।