বরিশাল ষড়যন্ত্র মামলা

Barisalpedia থেকে

বরিশালে ১৯১২ সালে বরিশাল ষড়যন্ত্র মামলা নামে একটি মামলা হয়। মামলাটি ছিল বরিশালের কতিপয় বিপ্লবী কর্তৃক পুলিশ ইনস্পেক্টর মনমোহন ঘোষকে হত্যার বিষয়ে।


মামলার পিছনের কাহিনি

এ হত্যার পিছনে ছিল ময়মনসিংহের একটি ঘটনা। অনুশীলন দলের অন্যতম নেতা ছিলেন ময়মনসিংহের ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী। পুলিশ ইন্সপেক্টর মনোমোহন ঘোষ ত্রৈলোক্যনাথকে একটি মামলায় জড়িত করার জন্য ঢাকার মাটিরপাড়া স্কুলের শিক্ষক শীতল চক্রবর্তীকে চড় দেয়। ত্রৈলোক্য এ বিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। এতে ত্রৈলোক্য খুব ব্যথিত হন। তিনি প্রতিজ্ঞা করেন মনমোহনকে মেরে এর প্রতিশোধ নিবেন। মনমোহনও তাই চাচ্ছিলেন।

এর মধ্যে মনমোহন ঘোষ বদলি হয়ে বরিশালে আসেন। ১৯১১ খ্রিস্টাব্দের ১১ ডিসেম্বর পঞ্চম জর্জের করোনেশন দিবসে বরিশাল বেল পার্কে উৎসব হয়। এ দিন সন্ধ্যার পর মনমোহন ঘোষ সদর গার্লস স্কুলের পাশ দিয়ে বাসায় ফিরছিলেন, তখন বরিশালের অনুশীলন দলের বিপ্লবীরা তাকে রিভলভারের গুলি দিয়ে হত্যা করে। গুলির শব্দ শুনে রাস্তার লোকজন দৌড়াতে থাকে। এ সুযোগে বিপ্লবীরা পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। এ ঘটনার সময় ত্রৈলোক্যনাথ ও বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বরিশালে উপস্থিত ছিলেন। ঐ বছর বরিশালে পানির কল বসানোর জন্য সুশীল ঘোষ, শশাঙ্ক ঘোষ ও তাদের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা যতীন্দ্রনাথ ঘোষ ঘটনার সময় বরিশাল ছিলেন। তারা ঢাকার অনুশীলন দলের সভ্য ছিলেন। বরিশালের দেবেন ঘোষ ও ফেগু রায়ের সাথে মিলে তারা সমিতির কাজ করতেন। ত্রৈলোক্যনাথের নেতৃত্বে দেবেন ঘোষ, গোপাল, ফেগু রায়, সুশীল ঘোষ, শশাঙ্ক ঘোষ ও যতীন ঘোষ মনোমোহন ঘোষকে হত্যা করে। খুব সম্ভব যতীন ঘোষের হাতে মনমোহন ঘোষ নিহত হয়।

মামলায় অভিযুক্তগণ

এই হত্যাকে পিছনে রেখে বিপ্লবীদের দমন করার জন্য সরকার ১৯১২ খৃৃস্টাব্দে বরিশাল ষড়যন্ত্র মামলা সৃষ্টি করে। ব্রিটিশ সরকারের অভিযোগ ছিল পূর্ব বাংলার বিভিন্ন জেলার বিপ্লবীরা বরিশালে একত্রিত হয়ে স্বাধীনতার জন্য সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করবে। সরকারের এ মামলা বরিশাল ষড়যন্ত্র ১৯১২-১৯১৩, ১২১ ধারা নামে পরিচিত। রাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধের ষড়যন্ত্র এমন অভিযোগে ৪৪ জন অনুশীলন বিপ্লবীর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা বের হয়। তাদের মধ্যে ৩৭ জন ধরা পড়েন এবং ত্রৈলোক্যনাথসহ ৭ জন পলাতক ছিলেন। এ মামলায় বরিশালে যারা জড়িত ছিলেন তারা হলেন: ১। দেবেন্দ্রনাথ ঘোষ, কাউনিয়া, ২। গোপাল মুখার্জী, কাউনিয়া, ৩। যতীন্দ্রনাথ রায় (ওরফে ফেগু রায়), কুশঙ্গল, ৪। চণ্ডী চরণ বসু, দেহেরগতি, ৫। নরেন সেন কবিরাজ, সাহসপুর, ৬। নলিনী দাশ, বাটাজোড়, ৭। গোপাল মিত্র, কাউনিয়া, ৮। নিবারণ কর, সাহসপুর, ১২। মুকুন্দ গুহ, অভয়নীল, ১০। নিশিকান্ত গুপ্ত, সিদ্ধকাঠি, ১১। যতীন্দ্র রায়, সাহসপুর, ১২। প্যারী দাস, শাহবাজপুর। তারা সকলের গ্রেফতার হয়ে বরিশাল জেলে ছিলেন।


মামলার বিচার

এ মামলায় সরকার পক্ষে উকিল ছিলেন ব্যারিষ্টার নলিনী গুপ্ত, ঢাকার রায় বাহাদুর শশাংক ঘোষ এবং বরিশালের সরকারী উকিল রাজেন্দ্র বাডুরী। আসামী পক্ষে ছিলেন বিসি চাটার্জী, বরিশালের শরৎ চন্দ্র গুহ, বরদাকান্ত বসু প্রমুখ। বিপ্লবীদের কালেক্টরেটের দালানের দোতলায় পশ্চিম পাশে বিচার হতো। শত শত পুলিশ বরিশাল শহরটি ঘিরে বাখে। সব সময় আতঙ্ক। চার বছর মামলা চলে এবং ১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দে শেষ হয়। হাইকোর্টে মামলা চলাকালে উভয় পক্ষের মধ্যস্থতায় শেষ পর্যন্ত ১২ জনকে ১ মাস হতে ৬ মাস জেল দেয়া হয়। ১৯১৫ খৃৃস্টাব্দে ত্রৈলোক্যনাথসহ ৫ জনের বিচার হয়, তিন জনের শাস্তি হয়। বরিশাল ষড়যন্ত্র মামলায় দেবেন ঘোষ, গোপাল প্রমুখ খালাস পান।


তথ্যসূত্র: ১। সিরাজ উদ্দীন আহমেদ। বরিশাল বিভাগের ইতিহাস (১ম খন্ড)। ভাস্কর প্রকাশনী, ঢাকা। ২০১০।