বরিশাল শহর

Barisalpedia থেকে
Spadmin (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ১০:২৯, ৪ নভেম্বর ২০১৭ পর্যন্ত সংস্করণে (গির্জা মহল্লা ও বিবির পুকুর)

(পরিবর্তন) ←পুর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ→ (পরিবর্তন)

১৬০২ খৃৃস্টাব্দে রাজা রামচন্দ্র মাধবপাশায় রাজধানী প্রতিষ্ঠা করেন। রাজধানীকে কেন্দ্র করে গিরদে বন্দর গড়ে ওঠে। এই গিরদে বন্দরই বরিশাল শহরের ভিত্তি। সুগন্ধা নদীর তীরে ১৭ শতকে বন্দর গড়ে ওঠে।


আদিরূপ

বাকলা লবণ উৎপাদন ও ব্যবসায়ের জন্য সুলতানী আমল হতে বিখ্যাত ছিল। মোগল আমলে লবণ ব্যবসায়ীদের নিকট হতে শুল্ক আদায় করা হতো। শুল্ক আদায়ের প্রধান চৌকি ছিল এই গিরদে বন্দরে। বরিশালের পূর্ব নাম ছিল গিরদে বন্দর। গিরদে বন্দরে প্রথমে মোলঙ্গী বা লবণ ব্যবসায়ী ও জেলেরা বাস করত। উত্তরে চকের পুল, দক্ষিণে জেলা স্কুলের খাল এবং পশ্চিমে সদর রোড পর্যন্ত বরিশাল মৌজা বা গিরদে বন্দর বিস্তৃত ছিল। গিরদে বন্দর বা বরিশালের আয়তন ছিল ৬৮ একর।


বন্দরের সম্প্রসারণ ও জনবসতি

১৭ শতকের শেষভাগে কাউনিয়া, আলেকান্দা, বগুড়া ও সাগরদী গ্রামে জনবসতি গড়ে ওঠে। কাউনিয়ার ভূগঠন প্রাচীন কালে হয়েছে। আলেকান্দা, বগুড়া ও বরিশালের ভূগঠনও প্রাচীনকালে হয়েছে। আলেকান্দা, বগুড়া ও বরিশালের ভূগঠন সম্ভবত সুলতানী আমলে হয়েছে। প্রথমে এখান লবণ ব্যবসায়ীরা লবণ গোলাজাত করে রাখত এবং তা বিভিন্ন স্থানে রপ্তানি করত। ১৭ শতকে এখানে ইউরোপীয় বণিকরা বাণিজ্য করত। মোগল ও নবাবী আমলে বণিকদের নিকট হতে শুল্ক আদায় করা হতো। লবণ ব্যবসায়ীদের বড় কেন্দ্র গিরদে বন্দর। এখানে ছিল বড় বড় লবণের গোলা এবং দক্ষিন বাংলার লবণ শুল্ক আদায়ের বড় চৌকি। ইউরোপীয় বণিকরা গিরদে বন্দরকে বরিসল্ট বলত। বরিসল্ট পরিবর্তিত হয়ে বরিশাল হয়েছে বলে অনেকের ধারণা।


আলেকান্দা, সাগরদী ও কাউনিয়া গ্রামের উদ্ভব

১৮ শতকের মধ্যভাগে কয়েকটি পরিবার আল ও বাঁধ দিৈেয় একটি পাড়া বা কান্দা গড়ে তোলে। এ কারণে নাম হলো আলেকান্দা। সুগন্ধা নদীতে আলেকান্দার পশ্চিম পাশে যে দ্বীপটি সৃষ্টি হয় তার নাম হয় সাগরদ্বীপ বা সাগরদী। সাগরদী গ্রামে একটি পুকুর খননকালে মাটির নিচে নৌকা ও মাছ ধরার জালের চিহ্ন এবং আলেকান্দায় আর একটি পুকুর খননকালে মাটির গভীরে মানুষের মাথায় খুলি পাওয়া গেছে। বেলস পার্কের পশ্চিম পাশে পুকুর খননের সময় লোহার নোঙ্গর পাওয়া যায়। এ থেকে ধারণা করা হয় গ্রামগুলো একদা সুগন্ধা নদীর অংশ ছিল। কাউনিয়া গ্রামটি পুরনো। চন্দ্রদ্বীপ রাজার কোন প্রতিনিধি এ গ্রামে একদল নৃত্যশিল্পী রেখে তাদের নৃত্য উপভোগ করতেন। কাউন শব্দের অর্থ নৃত্য। সুতরাং নৃত্যশিল্পীদের নামানুসারে কাউনিয়া হয়েছে।


বিভিন্ন গ্রামের পুরনো পরিবার ও পুরাকীর্তি

কাউনিয়া গ্রামে কয়েকটি পুরনো কীর্তি আছে। কাউনিয়ার জানকি সিং রোডে এক গম্বুজবিশিষ্ট একটি মসজিদ আছে। জনৈক মোহাম্মদ বাকের ১৭৮৬ খৃৃস্টাব্দে এ মসজিদটি নির্মাণ করেন। সম্ভবত তিনি ঢাকার নায়েব নাজিমের কর্মচারী বা স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি ছিলেন। কালু খানের পূর্বপুরুষ ১৮ শতকের প্রথমভাগে আলেকান্দায় বসতি স্থাপন করে। তাদের বাড়ির সামনে নবাবী আমলে নির্মিত এক গম্বুজবিশিষ্ট একটি মসজিদ আছে। কাউনিয়ার খান পরিবার ১৭ শতকের মধ্যভাগে আগমন করে। তাদের আদি পুরুষ বিক্ষু খান। তিনি চন্দ্রদ্বীপ রাজার কর্মচারী ছিলেন। বিক্ষু খানের পৌত্র আজমত খান চেরাগী ও তালুক লাভ করেন। তারা কাউনিয়া মৌজার ৪০০ একর ভূমির মালিক ছিলেন। আজমত খানের পুত্র চান খান। কাউনিয়ার চানখার পুল তার নামানুসারে। এ বাড়িতে ১৮ শতকের নির্মিত দু’টি জোড় মসজিদ ও দুর্গের ভগ্নাবশেষ আচে। বাড়ির সিংহদ্বার ও একটি ভবন ১৯ শতকের প্রথম ভাগে নির্মিত।

আলেকান্দার মিয়া পরিবার- পলাশীর যুদ্ধের পর পর কয়েকজন ইলাম ধর্ম প্রচারক বরিশাল বন্দরে আগমন করেন এবং তারা কাউনিয়া, ফকিরবাড়ী ও আলেকান্দায় স্থায়ীভাবে বাস করেন। সৈয়দ লাল ও সৈয়দ আরিফ নামে দুই ভাই মধ্যপ্রাচ্য হতে আলেকান্দায় আগমন করেন। আলেকান্দায় মিরা পরিবার তাদের বংশধর। ১৮০১ সালের পরে জেলা সদরের কর্মচারী হিসেবে দক্ষিণ আলেকান্দার আবদুল লতিফ খান, আমির আলী খান, মোহাম্মদ আলী সর্দার পূর্ব-পুরুষ জেলা দপ্তর প্রতিষ্ঠালগ্নে ভূমি লাভ করে শহরে বসতি স্থাপন করে।

ফকিরবারড়ীর ফকির পরিবার- শাহ করিম বকস বাগদাদ হতে ১৮ শতকে বরিশালে আগমন করেন এবং শহরের মধ্যস্থলে ধর্ম সাধনা শুরু করেন। তার পিতা শাহ কুতুব উদ্দীন বাগদাদী। রহমতপুরের জমিদার চন্দ্রকান্ত চক্রবর্তী ১৮০৩ খৃৃস্টাব্দে শাহ করিম বকসকে ৮.৫৭ একর নিষ্কর সম্পত্তি প্রদান করেন। দলিলে লেখা আছে “পুরুষানুক্রমে দরগায় তৈল বাতি দিয়া পুত্র পৌত্রাদিসহ ভোগ দখল করিতে থাক ও দোয়া করিও বহুত।” ১৮১৭ খৃৃস্টাব্দে তিনি ফকিরবাড়ীর মসজিদ নির্মাণ করেন। শাহ করিম বক্স ফকির নামে পরিচিত ছিলেন এবং তার নামানুসারে ফকিরবারড়ী নাম হয়েছে। মসজিদের দক্ষিণ পাশে তাঁর সমাধি আছে। তাঁর পুত্র আব্দুর রহমান, আব্দুল ওয়াহেদ ও আব্দুর রহিম। আব্দুর রহমানের পুত্র শাহ আব্দুল্লা। তার পুত্র শাহ আব্দুল নূর ও আব্দুল কুদ্দুস।

ভাটিখানার মল্লিক পরিবার- ভাটিখানা রোডে পূর্ব হতে কয়েকটি পরিবার বাস করত। এখানে জনৈক মল্লিকের নির্মিত তিনটি মসজিদ আছে। এ মসজিদগুলো ১৯ শতকের প্রথম ভাগে নির্মিত। জনৈক মল্লিক গুপ্তধন পেয়ে আল্লাহ, হজরত আলী ও বিবি ফাতেমার নামে তিনটি মসজিদ নির্মাণ করেন। একটি মসজিদ ধ্বংস হয়েছে এবং দু’টি মসজিদে এখনও নামাজ পড়া হয়। ভাটিখানা রাস্তার নামকরণ সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে এখানে মদ তৈরির ভাট ছিল।

সাগরদীর মল্লিক পরিবার- ১৮০১ সালের পরে জেলা সদরের কর্মচারী হিসেবে সাগরদীর মল্লিকবাড়ীর পূর্ব-পুরুষরা জেলা দপ্তর প্রতিষ্ঠালগ্নে ভূমি লাভ করে শহরে বসতি স্থাপন করে।


সরকার কর্তৃক বরিশাল মৌজা ক্রয়

গিরদে বন্দর বা বরিশালের আয়তন ছিল ৬৮ একর। বরিশাল মৌজার তালুকের নাম হরি রাধা নাথ দাস-মল্লিক দেবীচরণ ও অন্যান্য। ১৮৩১ খৃৃস্টাব্দে ইংরেজ সরকার মালিক রামকানাই রায়ের নিকট হতে বরিশাল মৌজা ক্রয় করে। তখন৪ কাউনিয়ার আয়তন ৪১৪.৪৫ একর, বগুড়া আলেকান্দা ১০৪১.৭৪ একর, আমানতগঞ্জ ৪৬৪.৬৭ একর এবং সাগরদী ১০৪১.৭৪ একর মোট ৩৮৫৬.৬৩ একর নিয়ে বরিশাল শহর গড়ে ওঠে। ১৮০১ খ্রিস্টাব্দের পূর্বে এখানে ইংরেজদের স্থায়ী বসতি ছিল না। তবে কয়েকজন ইংরেজ ও পর্তুগীজ বণিক কুঠি নির্মাণ করে বাস করত। কুঠিগুলো হলো শিববাড়ির বিল্ডিং, বেতার ভবনের ভিতরে কয়েকটি ভবন, পুলিশ সুপারের ভবন।

বরিশালে যখন সদর দপ্তর প্রতিষ্ঠা করা হয়, তখন এ ভবনগুলোতে অফিসের কাজ শুরু হয়। আবার অনেকে বলেন জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট বেটীর নামে ভাটিখানা হয়েছে। ১৮০০ খৃৃস্টাব্দে বর্তমান বিরশালে জনবসতি কম ছিল। মৌজা বরিশালে কোন স্থায়ী বাসিন্দা ছিল না। কাউনিয়া মৌজার জেলের পুলের নিকট একদল মৎস্যজীবী বাস কতর, তাদের নামানুসারে জালিয়াপুল হয়েছে। বরিশাল, কাউনিয়া, আলেকান্দা ও আমানতগঞ্জে মুসলমান অধিবাসী ছিল। পলাশী যুদ্ধের পর কয়েকটি মুসলমান পরিবার আলেকান্দা, বগুড়া ও কাউনিয়ায় বসতি স্থাপন করে। তখন বর্তমান বরিশাল শহরে সর্বমোট এক হাজারের বেশি লোক ছিল না। অধিকাংশ এলাকা জঙ্গলে আবৃত ছিল। তাহলে দেখা যায় ১৮০১ খ্রিস্টাব্দের পূর্ব হতে বরিশাল একটি বিখ্যাত বন্দর ছিল। জেলা দপ্তর প্রতিষ্ঠার পর শহরের গুরুত্ব বৃদ্ধি পেতে থাকে।


জেলা-শহর হিসেবে বরিশাল

১৮০১ খ্রিস্টাব্দের ২৯ এপ্রিল ঢাকা কোর্ট অব সারকুইট বরিশালে জেলা দপ্তর প্রতিষ্ঠার জন্য গভর্নর জেনারেলের নিকট সুপারিশ করে। গভর্নর জেনারেল লর্ড ওয়েলেসলি তাদের সুপারিশ অনুমোদন করেন। ১৮০১ খ্রিস্টাব্দের ১ মে নিজামত আদালত জেলা দপ্তর বাকেরগঞ্জ হতে বরিশালে স্থানান্তরের নিদের্শে দেয়। তিনি নিজামত আদালতের নির্দেশে জেলা দপ্তর ১৮০১ খৃৃস্টাব্দে বাকেরগঞ্জ হতে বরিশালে স্থানান্তরিত করেন। জেলা ম্যাজিষ্ট্রেটের দপ্তর বর্তমান টেলিফোন অফিসের আঙ্গিনায় প্রতিষ্ঠা করা হয়। জেলা ম্যাজিষ্ট্রেটের বাসভবন দপ্তর হিসেবে ব্যবহৃত হতো। তখন পৃথক দপ্তর চিল না। তার বাসবভবনে প্রত্যেক সপ্তাহে বিচার করা হতো। শিবপুর বিল্ডিং (সদর উত্তর মহকুমা প্রশাসকরে দপ্তর) কিছুদিনের জন্য জেলখানা হিসেবে ব্যবহার করা হয়। উইন্টল ১৮০২ খ্রিস্টাব্দের ৭ জানুয়ারি সরকারের নিকট এক পত্রে বলেছেন, “বরিশালে সদর দপ্তর স্থানান্তরের আদেশ বাস্তবায়ন করতে যেয়ে জঙ্গল পরিষ্কার, জেলখানা ও অন্যান্য ভবন নির্মাণ করে নতুন শহরে সূচনা করা হয় এবং তাতে অনেক সময় লেগে যায়।”৫ তিনি কয়েকটি পুকুর খনন করে নিচু ভূমি উঁচু করান। তিনি বান্দ রোড ও বাটার খালের ওপর একটি পুল নির্মাণ করান। বরিশাল হতে খাজাঞ্চি রাস্তা (দপদপিয়া) পূর্ব হতে ছিল।

চকবাজার- জেলা সদর স্থাপনের পরে বিক্রমপুর হতে ব্যবসায়ীরা বরিশালে ব্যবসা করতে আসে এবং চকবাজারে তারা স্থায়ী দোকান নির্মাণ করে। তাই চকবাজারের একাংশ ঢাকাইয়া পট্টি নামে খ্যাত ছিল।

কীর্তনখোলা নদীর নামকরণ- কীর্তনখোলা নদীর তীরে বরিশাল শহর। কিন্তু কীর্তনখোলা নাম ১৯ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত শোনা যেত না। এমনকি ১৮৭৫ খৃৃস্টাব্দে বেভারিজ নদীর নাম বরিশাল নদী বলেছেন। প্রকৃতপক্ষে বরিশাল বা কীর্তনখোলা নামের পূর্বে এ নদীর নাম সুগন্ধা ছিল। বরিশাল শহর পত্তন হলে নদীর তীরে হাটখোলায় কীর্তন শুরু হয়। হাটখোলার এই কীর্তন থেকে নদীর নাম হয় কীর্তনখোলা।


শহরে মসজিদ-মন্দির-গির্জা নির্মাণ

মন্দির- বরিশাল চক বাজারে হিন্দু বণিকরা প্রথমে ব্যবসা ও বসবাস শুরু করে। তাদের উদ্যোগে ১৮২২ খৃৃস্টাব্দে চকবাজারে মদন মোহনের মন্দির নির্মাণ করা হয়। মদন মোহনের মন্দিরটি শহরের সবচেয়ে পুরনো মন্দির। এ মন্দিরে পাথরে মদন মোহনের ও পিতলের রাধা রানীর মূর্তি ও দোল পূজার জন্য পঞ্চরতœ আছে। ১৮৫৮ খৃৃস্টাব্দে চামার পট্টিতে কালী ও শিব মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়। কলসকাঠির জমিদার মন্দিরের জন্য দেবোত্তর প্রদান করেন।৬ কবি ঈশ্বর গুপ্ত ১৮৫৬ খৃৃস্টাব্দে বরিশাল শহর পরিদর্শন করেন। তিনি শহরে ৮টি মন্দিরের নাম উল্লেখ করেছেন। এগুলো হলো মদন মোহন (চকবাজার), জগন্নাথ (সদর রোড), পাষাণময়ী কালী (কালীবাড়ী রোড), তালতলার কালী (সদর রোড), খালধারের কালী (বাজারখোলা), গাংধারের কালী (চামারপট্টি), জীবনসিংহ বাবুর কালী (কাউনিয়া)। চামার পট্টির মন্দিরের ভবন ১৮৫৮ খৃৃস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হলেও মন্দির তার কয়েক বছর পূর্বে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।

মসজিদ- ফকিরবাড়ী মসজিদের পরে চকের এবাদুল্লাহ মসিজদ প্রতিষ্ঠিত হয়। ঢাকার ব্যবসায়ী জনাব এবাদুল্লাহ এ মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ১৮৪২ খৃৃস্টাব্দে এ মসজিদের ভিত্তি স্থাপন করেন। তখন মসজিদটি কাঁচাঘর ছিল। জৌনপুরী পীর মাওলানা হাফেজ আহম্মদ মসজিদ নির্মাণে সহায়তা করেন। বর্তমান মসজিদ ১৯৫২ খৃৃস্টাব্দে নির্মিত হয়।


গির্জা মহল্লা ও বিবির পুকুর

১৯ শতকের প্রথম ভাগে খ্রিস্টান মিশনারিরা বরিশাল আগমন করে। তারা বরিশাল শহরে এক নতুন অধ্যায় সৃষ্টি করে। কথিত আছে উইলিয়াম কেরী পর্তুগীজদের নিকট থেকে একটি মুসলমান মেয়েকে উদ্ধার করে তাকে লালন-পালন করে এক মসুলমান যুবকের নিকট বিয়ে দেন। এ মেয়ের নাম ছিল জিন্নাত বিবি। কেরী তাকে জেনেট বলে ডাকতেন। কেরী জেনেটের নামে শহরের গির্জা মহল্লা নিয়ে একটি তালুক ক্রয় করেন। এ তালুকের নাম ছিল জিন্নাত বিবি মহল্লা। ১৯০০-১৯০৮ খ্রিস্টাব্দের ভূমি জরিপে জিন্নাত বিবি ও কেরীর নামে উল্লেখ আছে। কেরী সাহেব অবিভক্ত বাংলার মন্ত্রী হাশেম আলী খানের বাড়ির পশ্চিম পাশে একটি কাঠের গির্জা নির্মাণ করেন। এটাই শহরের প্রথম গির্জা। জিন্নাত বিবি হাশেম আলী খানের বাড়ির ভূমির মালিক ছিলেন এবং সেখানে তার বাসগৃহ চিল। জিন্নাত বিবি জনগণের জলকষ্ট নিবারনের জন্য সদর রোডের পূর্ব পাশে একটি পুকুর খনন করেন। এ পুকুর বিবির পুকুর নামে পরিচিত। জিন্নাত বিবি ১৯ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত জীবিত ছিলেন। তার কোন সন্তান ছিল না। জিন্নাত বিবি পুকুরের পশ্চিম পারে বাস করতেন। সেখানে পরবর্তীকালে খান বাহাদুর হাশেম আলী খান তার বাসগৃহ নির্মাণ করেন। জিন্নাত বিবির একটি পালক পুত্র ছিল। জিন্নাত বিবির মৃত্যুর পর তার সম্পত্তি নিলামে বিক্রি হয়। এ সম্পত্তি এ্যাংলিক্যান চার্চ ও বামনার চৌধুরীরা ক্রয় করে। এ্যাংলিকান এই গির্জার নামে গির্জা মহল্লা হয়েছে।

শহরের ইংরেজ বাসিন্দাগণ

জমিদার ডি সালভা, জন ফ্রান্সিস প্যারেরা, জন স্মীথ গিল ও ব্রাউন শহরের প্রধান ইউরোপীয় অধিবাসী ছিলেন। প্যারেরা প্রথম জীবনে সরকারী কর্মচারী ছিলেন। তিনি প্যারেরা রোডে বাস করতেন। তার কন্যাদ্বয় ও জামাতারা বিবির পুকুরের পূর্ব পাশে পুরাতন টেলিগ্রাফ অফিস ও ডাকবাংলোর নিকট বাস করতেন। মি. প্যারেরা ১৮৩৪ খৃৃস্টাব্দে ৭০ বছর বয়সে বরিশালে মারা যান। জন স্মীথ গিল একজন ব্যবসায়ী ছিলেন এবং ১৮২২ খ্রিস্টাব্দের ৮ ফেব্রুয়ারি দেহ ত্যাগ করেন। ব্রাউন পরিবার গিলের বংশধর। জন গিল শহরের প্রথম ইউরোপীয় বাসিন্দা। মি. জে. জে. জর্ডন একজন জমিদার ছিলেন। তিনি যে রাস্তার পাশে বাস করতেন তা জর্ডন রোড নামে পরিচিত। তার পুত্র এ.জে.এস. জর্ডন ১৮৪৫ খৃৃস্টাব্দে দেহত্যাগ করেন। খ্রিস্টান কবর স্থানে তার সমাধি আছে। রেভারেন্ড এস ব্যারেরিও কনষ্টানটাইন, প্যানটলী (মৃত্যু ১৮৪৪), শাম ডাগোষ্টা, কয়েনব্রা (মৃত্যু ১৮৫৬), রবার্ট মোরেল, জন ম্যাকরা বিউস (মৃত্যু ১৮২৩), চার্লস উইলিয়মস প্রমুখ ইউরোপীয় জমিদার ও বণিক বরিশালে বাস করতেন এবং তাদের মৃত্যুর পর বরিশালে সমাধিস্থ করা হয়।


শহরের সার্বিক চিত্র

১৮১১ খৃৃস্টাব্দে শহরে ৩৭৮টি গৃহ ছিল। শহরে ১৩ জন চৌকিদার ও একজন জমাদার ছির। ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দের ২৫ ফ্রেবুয়ারির এক অগ্নিকা-ে শহরের অনেক ঘরবাড়ি পুরে যায়। ১৮৪৭ খৃৃস্টাব্দে বরিশাল হাসপাতাল নির্মিত হয়। ১৮৫৪ খৃৃস্টাব্দে স্থানীয় জনগণের উদ্যোগে একটি পাবলিক লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠিত হয়। বলা হয়ে থাকে যে, জেলা জজ মি. কেমপ লাইব্রেরীটি প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু এ কথা সত্য নয়। কারণ তিনি ১৮৫৫-৫৬ খৃৃস্টাব্দে বরিশালে জেলা জজ ছিলেন। খুব সম্ভব তিনি পাবলিক লাইব্রেরী ভবন নির্মাণে উদ্যোগ নিয়েছিলেন। ১৮৫৭ খ্রি শহরে অধিবাসীদের সংখ্যা প্রায় ১০ হাজার ছিল। সুলতানাবাদের জমিদার মেহেরুন্নেছা খানম বরিশাল শহরে বাস করতেন। তিনি ১৯ শতকের মধ্যভাগে বরিশালে আগমন করেন। তাদের বাড়ি খানমবাড়ি নামে পরিচিত। শায়েস্তাবাদের জমিদার তোজাম্মেল আলী, চরামদ্দির আছমত আলী, লাখুটিয়ার রাজচন্দ্র রায়, কাজী আকরাম প্রমুখের পরিবার বরিশালে বাস করতেন। এছাড়া অনেক উক্তির, মোক্তার ও জমিদার শহরের অস্থায়ী বাসিন্দা ছিলেন। তারা মাঝে মাঝে শহরে বাস করতেন।

মোটের উপর কোম্পানি আমলে বরিশাল শহর অনুন্নত ছিল। পানীয়জল ও বিদ্যুতের বন্দোবস্ত ছিল না। সকলে পুকুরের পানি ব্যবহার করত। তখন জীবন ছিল গ্রামমুখী। শহরে বাস করার প্রবণতা তখনও গড়ে উঠেনি।



তথ্যসূত্র: ১। সিরাজ উদ্দীন আহমেদ। বরিশাল বিভাগের ইতিহাস (১ম খণ্ড)। ভাস্কর প্রকাশনী, ঢাকা। ২০১০।