বরিশাল মুক্ত দিবস
বরিশাল শহর পাকহানাদার মুক্ত হয় ১৯৭১ সালের ৮ ডিসেম্বর। এটি বরিশাল মুক্ত দিবস হিসেবে সবার কাছে পরিচিত।
নভেম্বর মাসে মুক্তিযোদ্ধারা বরিশাল, পটুয়াখালী রিভিন্ন রণাঙ্গণে সুশিক্ষিত এবং সুসজ্জিত পাক সেনাদের বিরুদ্ধে কয়েকটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করে তাদের শক্তি ও বীরত্বের পরিচয় দেয়। এ মাসে অধিক সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা মুজিবনগর থেকে বরিশাল আগমন করে। মুক্তিযোদ্ধারা কয়েকশ’ ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করে। নভেম্বর মাসের পূর্বে মুক্তিযোদ্ধাদের স্থায়ী ক্যাম্প ছিল না। পাক সেনাদের আক্রমণের ভয়ে তারা এক জায়গায় বেশি দিন থাকতো না। কিন্তু নভেম্বর মাস হতে তারা অনেকগুলো স্থায়ী ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করে। মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পগুলোর মধ্যে ছিল বরাকোটা, বিন্না, শরিকল, পাদ্রীশিপপুর, কেউন্দিয়া, শ্যামপুর, দুধাল, চরামন্দি, কামারখালী, বিনয়কাটি, চাঁদপাশা, আগরপুর, ঠাকুর মল্লিক, বদরটুনী, পয়সারহাট প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। একমাত্র ভোলয় ৪৮টি ক্যাম্প ছিল। সুন্দরবনে ক্যাপ্টেন জিয়াউদ্দিনের অধীনে অনেক ক্যাম্প ছিল। তারা প্রধান ক্যাম্প ছিল বগী। বরাকোটা যুদ্ধের পর ক্যাপ্টেন ওমর তার ক্যাম্প স্বরূপকাঠি থানার বিন্না গ্রামে স্থানান্তর করেন। নভেম্বর মাসে তিনি তাঁর ক্যাম্প পাদ্রীশিবপুরে নিয়ে আসেন। পাদ্রীশিবপুরের ফাদার জার্মান ছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাণপুরুষ। তার সেবায় সকল মুক্তিযোদ্ধা ছিল মুগ্ধ। ৪ অক্টোবর ২০০ মুজিববাহিনী যশোর হয়ে বরিশাল ও ফরিদপুরে আসছিল। কিন্তু পাক বাহিনীর বিমান হামলায় অনেকে নিহত হয়। আবদুর রব সেরনিয়াবাতের পুত্র আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ একদল মুজিব বাহিনী নিয়ে গোপালগঞ্জ হয়ে গৌরনদী আসেন। কোতোয়ালির মনসুরুল আলম মন্টু, ঝালকাঠির সঞ্জীব, গৌরনদীর ফজলুর রহমান, বাকেরগঞ্জের এনায়েত, স্বরূপকাঠির মহসীন, পটুয়াখালী শহরের মোশারেফ, সর্দার রশীদ, আমতলীর গাজী আনোয়ার, গলাচিপার বারেক ঢালী প্রমুখ মুজিব বাহিনীর অধিনায়ক ছিলেন। তাদের সাথে পয়সারহাটে পাক বাহিনীর যুদ্ধ হয়। আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ গৌরনদী অঞ্চলে কয়েকটি আক্রমণ পরিচাণনা করেন। কমান্ডার নিজামুদ্দীন ও হাসনাত গৌরনদী থানা আক্রমণ করেন। কিন্তু ক্যাপ্টেন কাহার মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ প্রতিহত করে। ১৮ ডিসেম্বর ক্যাপ্টেন কাহার নুরুল ইসলাম মঞ্জুর নিকট আত্মসমর্পণ করেন।
১৯৭১ সালের ২১ নভেম্বর মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনী মিত্রবাহিনী গঠন করে। তারা একযোগে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে। পাক সেনারা ১৬ নভেম্বর হতে বরিশাল, পটুয়াখালীর ক্যান্টনমেন্টে সীমাবদ্ধ থাকে। ৩০ নভেম্বরের মধ্যে প্রায় সকল থানা মুক্তিযোদ্ধারা দখল করে নেয়। ৩ ডিসেম্বর পাক ভারত যুদ্ধ শুরু হয়। ৬ ও ৭ ডিসেম্বর বরিশাল ও রহমতপুর বিমান ঘাঁটিতে মিত্র বাহিনী বোমা বর্ষণ করে। ৮ ডিসেম্বর সকাল ১০ টায় বরিশালে পাক সেনারা কার্ফু দেয়। যশোর ও খুলনা থেকে পাক সেনারা পালিয়ে আসে এবং তারা কয়েকটি লঞ্চে ঢাকা অভিমুখে যাবে। বরিশাল ওয়াপদা অফিসের পাকসেনা বেলা ১১টার মধ্যে লঞ্চে আরোহণ করে। তারা ১২টার মধ্যে লঞ্চ ও স্টিমারযোগে বরিশাল ত্যাগ করে। তাদের মধ্যে বরিশাল শান্তি কমিটির সম্পাদক সাজাহান চৌধুরী চলে যান। এদিকে সঙ্গে সঙ্গে মিত্রবাহিনীর বিমান হামলা চলতে থাকে। সাজাহান চৌধুরীর লঞ্চটি চাঁদপুরের পশ্চিম তীরে ফরিদপুরের চরে ৯ ডিসেম্বর বিমানের হামলায় ধ্বংস হয়। তিনি সেখানে মারা যান। গ্রামবাসীরা পরে তাকে নদীর তীরে কবর দেয়। পাক সেনাদের কয়েকটি লঞ্চ বরিশাল শহর থেকে ১৫ দূরে নন্দীবাজারের নিকট বিমান হামলায় আক্রান্ত হয়। লঞ্চ ডুবে গেলে পাক সেনারা পশ্চিম পারে ঠাকুর মল্লিক ও পূর্ব পারে নন্দীরবাজারে ওঠে। সংবাদ পেয়ে আগরপুর হতে নূর হোসেন কমান্ডার ও হাজার হাজার গ্রামবাসী ছুটে আসে। নূর হোসেন অনেক পাক সেনা হত্যা করে। গ্রামবাসীরা তাদের দা দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে। এমনকি মেয়েরা ঝাড়ু দিয়ে তাদের পিটায়।
১৯৭১ সালের ৮ ডিসেম্বর বরিশাল স্বাধীন হয়। ৮ ডিসেম্বর বরিশাল মুক্ত দিবস। বেলা ১১টার পরই জনগণ জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে। রাজাকার, আলবদর, শান্তি কমিটির দালালেরা দ্রুত পালাতে থাকে। সকল বাসভবনে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়তে থাকে। ৮ ডিসেম্বর বিকালে সুলতান মাস্টার তার বাহিনী নিয়ে শহর উঠে পড়ে। ১০ ডিসেম্বর ক্যাপ্টেন শাহজাহান ওমর শহরে আসে। তারপর সকল মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার তাদের দল নিয়ে শহরে আসতে থাকে। চারদিকে বিজয় উল্লাস। আবার অনেকে প্রিয়জনদের হারানো ব্যথায় আনন্দাশ্রু ফেলছে। মুক্তিযোদ্ধারা দালালির অভিযোগে শর্ষিনার পীর মওলানা আবু জাফর মুহম্মদ সালেহ, মুসলিম লীগনেতা সৈয়দ মুহম্মদ আফজাল, আবদুর রব, শমসের আলী, সুলতান সর্দার, ইলিয়াস মাস্টারকে গ্রেফতার করে। অনেক দালালকে মৃত্যুদ- দেয়া হয়। তখন জেলার শাসন নিয়ে সমস্যা হয়। সংগ্রাম কমিটির সভাপতি আবদুর রহমান বেসামরিক প্রশাসনের দায়িত্ব পালন করতে থাকেন। তার দপ্তর ছিল পেশকার বাড়িতে নুরুল ইসলাম মঞ্জুরের বাসায়। কিন্তু ক্যাপ্টেন শাহজাহান ওমর দাবি করলেন সাব-সেক্টর কমান্ডার হিসেবে তিনি জেলায় প্রধান। ১৭ ডিসেম্বর নুরুল ইসলাম মঞ্জুর ৫০০ মুক্তিযোদ্ধাসহ বরিশাল শহরে পৌঁছেন এবং তিনি সাময়িকভাবে জেলার প্রশাসন পরিচালনার ভার গ্রহণ করেন।
১৮ ডিসেম্বর মেজর এম এ জলিল বরিশাল পৌঁছলে তাকে প্রাণঢালা অভ্যর্থনা দেয়া হয়। ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা আন্দোলনে যেমন বরিশালের কাজী বাহাউদ্দীন ও মহিউদ্দীনের নাম সুপরিচিত ছিল তেমনি ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা সংগ্রামে নুরুল ইসলাম মঞ্জু ও মেজর এমএ জলিল খ্যাতি লাভ করেন। ২১ ডিসেম্বর হেমায়েত উদ্দীন খেলার মাঠে বিজয় উপলক্ষে বিরাট জনসভা হয়। নুরুল ইসলাম মঞ্জু ও মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারগণ বক্তৃতা দেন।
তথ্যসূত্র: ১। সিরাজ উদ্দীন আহমেদ। বরিশাল বিভাগের ইতিহাস (দ্বিতীয় খন্ড)। ভাস্কর প্রকাশনী, ঢাকা। ২০১৫