বরিশাল অঞ্চলে মগ ও পর্তুগিজদের আক্রমণ

Barisalpedia থেকে

ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকে বাকলা-চন্দ্রদ্বীপ জুড়ে ছিল পর্তুগিজ ও মগদের অত্যাচার ও আক্রমণের বিভীষিকা। এই বিভীষিকায় এতদঞ্চলের মানুষ এলাকা ছেড়ে এমনভাবে দলে দলে পালিয়েছিল যে ১৭৩৭ সালের এক রেকর্ডে দেখা যায় দক্ষিণাঞ্চলের মঠবাড়িয়া, পাথরঘাটা, ভাণ্ডারিয়া, আমতলী, বরগুনা, গলাচিপা, বামনা, রাজাপুর, বেতাগী ইত্যাদি অঞ্চলে কোনো মানুষের বসতিই ছিল না।


আক্রমণের প্রাথমিক পর্ব

১৫৯০ খৃস্টাব্দে পর্তুগিজ সেনা নায়ক ডি সুজা এক সময়ের বাকলার অংশ সন্দ্বীপ অবরোধ করে। ১৬০২ সালে শ্রীপুরের রাজা কেদার রায়ের পর্তুগিজ সেনাপতি মান্টারগিলের অধিবাসী কার্ভালো সন্দ্বীপ দখল করে। মোগল শাসনকর্তা ফতে খা কার্ভালোকে বাধা দেন। তখন চট্টগ্রাম থেকে ইমানুয়েল ডি মেটোস এসে কার্ভালোকে সাহায্য করে এবং সন্দ্বীপে দুর্গ নির্মাণ করে। আরাকানের রাজা মেংরাড জাগনী পর্তুগিজদের সন্দ্বীপ দখলে শঙ্কিত হয়ে অনেক পর্তুগিজ হত্যা করে, কার্ভালোকে পরাজিত করে এবং ধর্মযাজক ফার্নান্ডেজকে বন্দী করে। কার্ভালো পালিয়ে গেলে যশোরে প্রতাপাদিত্য তাকে হত্যা করে। এরপর রাজা মেংরাড জাগনী পর্তুগিজদেরকে শাহবাজপুরে বসতি গড়ে দেবার লোভ দেখিয়ে বাকলায় আক্রমণ করে। বাকলার রাজা রামচন্দ্র আরাকানী রাজা মেংরাড জাগনীসহ পর্তুগিজ বাহিনী তাড়িয়ে দেন।


সেবাস্তিয়ানের আক্রমণ

কার্ভালোর পরে গুরুত্বপূর্ণ পর্তুগিজ জলদস্যুর নাম গঞ্জালেস সেবাস্তিয়ান। ১৬০৫ সালে ভাগ্যের অন্বেষণে সে বাংলাদেশে আসে। বাকলার রাজা রামচন্দ্রের সাথে সম্পাদিত মৈত্রী চুক্তির অধীনে সে বাকলার রাজার সহায়তা নিয়ে সন্দ্বীপ দখল করে। চুক্তি ছিল সন্দ্বীপ দখল করতে পারলে প্রাপ্য রাজস্বের অর্ধেক সে রামচন্দ্রকে দিবে। এই শর্ত ভঙ্গ করে সে বরং বাকলা আক্রমণ করে শাহবাজপুর ও পাতিলভাঙ্গা দখল করে নয়ে। মোগল শাসন কর্তা ফতে খা ভোলার নিকট যুদ্ধে গঞ্জালেসের কাছে পরাজিত ও নিহত হন। রাজা রামচন্দ্র তাকে শাহবাজপুর তথা বাকলা থেকে তাড়াতে সমর্থ হন। ১৬০৯ সালে গঞ্জালেস ফতে খার ভাইকে হত্যা করে পুনরায় সন্দ্বীপ দখল করে। ১৬১৫ সালে আরাকান রাজা মেং খামাং গঞ্জালেসকে হত্যা করে সন্দ্বীপ তাদের দখলে নেয়।


মগ দস্যু মেং খামাং এর আক্রমণ

মেং খামাং ১৬২০ সালে বাকলায় আক্রমণ করে। ১৬২১ সালে মেং খামাং শাহবাজপুরে অনেকটা অত্যাচারের মগ রাজত্ব কায়েম করে। ভোলা, মেহেন্দীগঞ্জ, বাউফল, গলাচিপা, হিজলা, মুলাদী ইত্যাদি স্থানে হাজার হাজার ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয়, শত শত লোক হত্যা করে। মগ জলদস্যুরা নলছিটি থানায় মগর গ্রামে বসতিও স্থাপন করেছিল। তারা সেখানে আধা মাইলব্যাপী মাটির এক দুর্গ নির্মাণ করেছিল। মগরা বাটাজোর গ্রামে একটি দীঘি পর্যন্ত খনন করেছিল যা এখনো মগের আন্ধি নামে পরিচিত।


পর্তুগিজ জলদস্যুদের বসতি স্থাপন

পর্তুগিজ জলদস্যুরাও অনেক জায়গায় তখন বসতি ও কুঠি স্থাপন করেছিল। মনপুরা থানার মাঝগ্রামে তাদের কুঠি ছিল। রামনাবাদ নদীর তীরে পাটুয়া গ্রামে পর্তুগিজদের কুঠি ছিল। পাটুয়া শব্দটি পর্তুগিজের অপভ্রংশ এবং এখান থেকে পটুয়াখালি। আমতলী থানার কচুপাত্রায়ও পর্তুগিজদের একটি আড্ডা খানা ছিল। কচুপাত্র নদীতে সেটি বিলীন হয়ে গেছে। পর্তুগিজ ও মগদের অত্যাচারে পুরো দক্ষিণাঞ্চল একসময় বিরানভূমিতে পরিণত হয়েছিল। ১৬৩৭ সালের এক রেকর্ডে দেখা যায় গোটা দক্ষিণাঞ্চলে তখন কোনো বসতি ছিল না। পর্তুগিজদের একদল অবশ্য বাকেরগঞ্জের পাদ্রীশিবপুরে স্থায়ী হয়ে যায়। বরিশাল শহরের প্রাচীন দালানগুলো তাদের নির্মিত। শিবপুর বিল্ডিং বা সদর উত্তর মহকুমা প্রশাসকের দপ্তর তাদের প্রাচীনতম দালান। কয়েকজন পর্তুগিজ ব্যবসায়ী ও জমিদার বরিশালে প্রসিদ্ধি লাভ করেন। মি. গমেজ, মি. প্যারারা ও মি. ডি সিলভা তাদের অন্যতম।



তথ্যসূত্র: ১। সিরাজ উদ্দীন আহমেদ। বরিশাল বিভাগের ইতিহাস (প্রথম খন্ড)। ভাস্কর প্রকাশনী, ঢাকা। ২০১০।