বরিশালে ইংরেজদের লবণ ব্যবসা

Barisalpedia থেকে

ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৭৬৫ খৃৃস্টাব্দে দেওয়ানী লাভের পূর্বেই ইংরেজ বণিকরা বরিশালের বাণিজ্যের ওপর একচেটিয়া অধিকার লাভ করে। তাদের ব্যবসার মধ্যে লবণ ছিল প্রধান।


ব্যবসার সূত্রপাত

লবণ উৎপাদনের জন্য বাকেরগঞ্জ বাংলাদেশের মধ্যে বিখ্যাত ছিল। দক্ষিণ শাহবাজপুর, বাকেরগঞ্জ, ঝালকাঠি, বারৈকরণ, নেয়ামতি, সেলিমাবাদ (পিরোজপুর) বর্গা প্রভৃতি বন্দর লবণ বাণিজ্যের জন্য বিখ্যাত ছিল। দক্ষিণ শাহবাজপুর ও সেলিমাবাদের লবণ শিল্প সর্ববৃহৎ ছিল। এজন্য এ অঞ্চলের অনেক ভূমি অনাবাদী ছিল। ১৭৮৩ খ্রিস্টাব্দের ২৫ জুন কমন্স সভার লবণ রিপোর্টে দেখা যায় খাজা কাওয়ার্ক নামে এক আর্মেনিয়ান ব্যবসায়ী ১৭৭৩ খ্রিস্টাব্দে সেলিমাবাদ লবণ শিল্পের মালিক ছিলেন। ১৭৭৪ খৃৃস্টাব্দে ঢাকার চীফ মিঃ বারওয়েল বেনামে সেলিমাবাদ পরগণার লবণ শিল্পের মালিক হন। বারওয়েল উচ্চ লাভের বিনিময়ে খাজা কাওয়ার্কের নিকট সেলিমাবাদের লবণ ব্যবসা ইজারা দেন। সরকারী কর্মচারী হয়ে লবণ ব্যবসা করার জন্য মিঃ বারওয়েলকে অনেক সমালোচনা সম্মুখীন হতে হয়।


লবণ ব্যবসায়ীদের অত্যাচার

লন্ডনে ভারতীয় অফিসে রক্ষিত নথিপত্রে দেখা যায় ১৭৭৫ খৃৃস্টাব্দে মিঃ উড জয়নগর বা ঝালকাঠির লবণ এজেন্ট ছিল। লবণ এজেন্ট ও তার কর্মচারী ব্যতীত অন্য কারোর নিকট লবণ বিক্রি নিষিদ্ধ ছিল। বেপারীরা লবণ এজেন্টের নিকট হতে দাদন বা ঋণ গ্রহণ করে মোলঙ্গীদের মধ্যে বিতরণ করত। পূর্বে মোলঙ্গীরা দেশীয় বণিকদের নিকট হতে দাদন গ্রহণ করত। কিন্তু কোম্পানি দেশীয় বণিকদের নিকট লবণ বিক্রি নিষিদ্ধ করে দেয়। দেশীয় বণিকরা বরিশালের বন্দরগুলো হতে বিতাড়িত হলে ইংরেজ বণিকরা ও তাদের গোমস্তারা লবণ ব্যবসার একচ্ছত্র ক্রেতা ও বিক্রেতা হয়। কোম্পানি লবণ উৎপাদন ও ব্যবসার ওপর পূর্ণ কর্তৃত্ব করত। ফলে লবণের উৎপাদন হ্রাস পেতে থাকে এবং মূল্য বৃৃদ্ধি পায়। ১৭৪০ খৃৃস্টাব্দে এক শ’ মণ লবণের মূল্য ছিল ৪০ থেকে ৬০ টাকা এবং তা বৃদ্ধি পেয়ে ১৭৬৫ খৃৃস্টাব্দে দাঁড়ায় ১৭৮ টাকা, ১৭৭৮ খৃৃস্টাব্দে ৩১২ টাকা এবং ১৭৯৮ খৃৃস্টাব্দে ৩৮০ টাকা। লবণ চাষীরা অল্প মূল্যে লবণ বিক্রয় করত এবং জনগণ উচ্চ মূল্যে লবণ ক্রয় করত। লবণ চাষীরা দাদন ও অন্যান্য খরচ বহন করে কোন লাভ পেত না। জোর করে তাদের দ্বারা লবণ চাষ করানো হতো। এজন্য বেপারীদের অত্যাচারের ফলে লবণ চাষীরা তাদের আবাসভূমি পরিত্যাগ করে অন্যত্র চলে যায়। বেপারী বা ইজারাদাররা মোলঙ্গী ও লবণ চাষীদের অর্থ দাদন দিত। ফলে লবণ চাষীরা ক্রীতদাসে পরিণত হয়। যারা লবণ উৎপাদন করত তাদের মাহিন্দার এবং যারা দাদন দিয়ে লবণ চাষ করাত তাদের মোলঙ্গী বলা হতো। লবণ ওজনকারীদের কয়াল এবং যারা গোলাজাত করত তাদের গোলদার বলা হতো। কয়াল, বেপারী, পাইক, পেয়াদা, জমাদার, দারোয়ান প্রমুখ কৃষকদের ঠকাত। মাটি থেকে লবণ উৎপাদনের জন্য ভোলা, মনপুরা, রামনা, বরগুনা, মঠবাড়িয়া, কাঁঠালিয়া, আমতলী, খেপুপাড়া ও গলাচিপায় অনেক তাফাল নির্মাণ করা হয়। তখন লবণ পানি বঙ্গোপসাগর হতে ভিতরের নদ-নদীতে প্রবেশ করত। লবণ মাটি আহরণ করে তাফালে জ্বাল দিত। এজন্য জ্বালানির প্রয়োজন ছিল। তাই লবণ চাষের জন্য প্রচুর খাস ভূমি রাখা হতো। সুন্দরবন অঞ্চলে অনেক লবণ তাফাল ও গোলা ছিল। বরগুনার ছোট লবণ গোলা, বড় লবণ গোলা, তাফালবাড়িয়া প্রভৃতি কোম্পানি আমলের লবণ চাষের স্মৃতি বহন করে। বরিশালের উত্তরের গ্রামগুলো হতে কোম্পানির কমচারী ও ইজারাদারেরা কৃষকদের জোর করে ধরে সুন্দরবনে নিয়ে যেত এবং তাদের দ্বারা লবণ উৎপাদন করাত। তাদের জেলখানার আটক করে রাখত। বরগুনার জেলখানা গ্রামে এক সময় লবণ চাষীদের বন্দী করে রাখা হতো।


বাওয়েল ও কাওয়ার্ক বিবাদ

দক্ষিণ শাহবাজপুর ও সেলিমাবাদের লবণ শিল্প ইজারা দেয়া হতো এবং এ ইজারা নিয়ে ১৭৭৪ খৃৃস্টাব্দে ঢাকার চীফ বারওয়েল ও খাজা কাওয়ার্কের মধ্যে বিবাদ শুরু হয়। বারওয়েল ১,২৫,০০০ টাকা নিয়ে খাজা কাওয়ার্কের নিকট ইজারা দেন। কিন্তু তিনি পরে আবার এক লক্ষ টাকার বিনিময়ে অন্য একজনকে ইজারা দেন। এ নিয়ে মামলা হয় এবং বোর্ড অব ডাইরেক্টরস কাওয়ার্ককে অভিযুক্ত করে।


লবণচাষ বিষয়ে বেভারিজ

বরিশালে দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলের লবণ চৌকির তত্ত্বাবধায়কের প্রধান দপ্তর ছিল। বাংলাদেশ সচিবলায়ের লাইব্রেরীতে রক্ষিত লবণ বিভাগের নথিপত্রে বরিশালের লবণ চাষ সম্পর্কে অনেক তথ্য আছে। ১৭৯০ খ্রিস্টাব্দের ২ অক্টোবরের এক পত্রে দেখা যায় লবণ বিভাগের এজেন্টরা কামারের কাজ করাবার জন্য প্রজাদের ধরে নিয়ে যেত। তারা প্রজাদের ওপর কঠোর নির্যাতন চালাত। মিঃ বেভারিজ লিখেছেন, “লবণ চাষ প্রত্যেক স্থানে নিপীড়ন ও উচ্ছৃঙ্খলতা সৃষ্টি করে এবং ফলে ম্যাজিষ্ট্রেট ও লবণ এজেন্টের মধ্যে মনোমালিন্য দেখা দেয়। ১৮২৫ খৃৃস্টাব্দে বাকেরগঞ্জের জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট বোর্ডের নিকট এক চিঠির জবাবে লিখেছেন, আমি বিনয়ের সাথে জানাচ্ছি যে আমি এ জেলার দায়িত্বভার গ্রহণের পর হতে যে মামলার রায় হয়েছে তা প্রমাণ করে যে, লবণ কর্মচারীরা প্রজাদের ওপর জঘন্য উৎপীড়ন করছে। আমি আমার মতামত ব্যক্ত করতে দ্বিধা করব না যে, বেপারীরা মোলঙ্গীদের দাদন গ্রহণের জন্য চরম অত্যাচার করছে এবং তারা অনেকে দোষী সাব্যস্ত হয়ে শাস্তি লাভ করছে”।

লবণ শিল্পের ওপর পূর্ণ কর্তৃত্ব লাভ করে ইংরেজ বণিকরা প্রচুর মুনাফা অর্জন করে। তাদের শোষণের ফলে লবণ চাষীরা লক্ষ লক্ষ মুদ্রা বরিশাল হতে লন্ডনে নিয়ে যায়। কোম্পানির কর্মচারীরা বিলাস ও ব্যয়বহুল জীবন যাপন করত। ঝালকাঠির লবণ এজেন্ট মিঃ ইউয়ার্ড একজন অত্যাচারী বিলাসী কর্মচারী ছিলেন। তিনি এতই শৌখিন ছিলেন যে, ঝালকাঠিতে তিনি এক বৃহৎ ভবন নির্মাণ, ইউরোপিয়ান রুটি তৈরিকারক ও নাপিত নিয়োগ, এ জাতীয় কাজ করেছিলেন।


তথ্যসূত্র: ১। সিরাজ উদ্দীন আহমেদ। বরিশাল বিভাগের ইতিহাস (১ম খন্ড)। ভাস্কর প্রকাশনী, ঢাকা। ২০১০।