বরিশালে ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও আন্দোলন

Barisalpedia থেকে

১৭৫৭ খৃৃস্টাব্দে পলাশী যুদ্ধের পর থেকে সিপাহী বিদ্রোহ পর্যন্ত একশ’ বছরব্যাপী ইংরেজ কোম্পানির শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে বরিশালের কৃষক ও সাধারণ মানুষেরা বার বার বিদ্রোহ করেছে এবং তারা কয়েকটি রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে। তাদের বীরত্ব ও জাতীয় চেতনাবোধকে ইংরেজ সরকার ও তাদের তাবেদার ভূস্বামীরা অপব্যাখ্যা দিয়ে বিভিন্ন সময়ে তাদের চরিত্রের ওপর মিথ্যা কলঙ্ক আরোপ করার চেষ্টা করেছে। এতদিন জাতীয় ইতিহাস রচিত হয়নি। তাই স্বাধীনতা আন্দোলনে এই বিদ্রোহী বীরদের সঠিক মূল্যায়ন হয়নি।


রাজবল্লভের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ

পলাশী যুদ্ধের পরপরই বাকেরগঞ্জের কৃষকরা বুজুর্গ উমেদপুর পরগণার জমিদার রাজা রাজবল্লভকে খাজনা দিতে অস্বীকার করে। রাজবল্লভ বিদ্রোহী কৃষকদের দমন করার জন্য বান্ডেল হতে একদল পর্তুগীজ নিয়ে আসেন। পর্তুগীজরা আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে বিদ্রোহী কৃষকদের দমন করে।


ইংরেজ বণিকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ

উত্তরবঙ্গের ফকির আন্দোলনের মতো ১৮ শতকে বরিশালে কৃষক বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে। ইংরেজ বণিকরা বরিশালের নদীপথে ঢাকা ও কলকাতায় যাতায়াত করত। বিদ্রোহীরা বণিকদের বানিজ্যতরী আক্রমণ করে কয়েকজন ইংরেজ বণিক ও অনেক গোমস্তাকে হত্যা করে। ১৭৬৪ খৃৃস্টাব্দে ক্যাপ্টেন রোজ নৌকায় বাকেরগঞ্জ বন্দরে যাচ্ছিল। তখন বিদ্রোহী কৃষকরা নৌকা আক্রমণ করে ক্যাপ্টেন রোজকে হত্যা করে। গভর্নর ভ্যান্সিটার্ট রোজের হত্যাকারদের দমন করার জন্য মুর্শিদাবাদের নবাবকে অনুরোধ জানায়। বাংলাদেশের বরিশালেই প্রথম কোনো ইংরেজ বণিক বিদ্রোহীদের হাতে নিহত হয়।

মজনু শাহের নেৃতত্বে যখন ময়মনসিংহে ফকির বিদ্রোহ চলছে, তখন বরিশালের একদল বিদ্রোহী ইংরেজ রেসিডেন্টকে আক্রমণ করে। গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেষ্টিংস এক পত্রে উল্লেখ করেছেন যে, ১৭৬৪ খৃৃস্টাব্দে বি্েরদাহী ফকির সম্প্রদায় বরিশালের ইংরেজ রেসিডেন্টের বাসগৃহ আক্রমণ করে। আক্রমণ ব্যর্থ হলেও বিদ্রোহীরা তাদের আন্দোলন অব্যাহত রাখে। ১৭৮৮ খৃৃস্টাব্দে গৌরনদীর নিকটে বিদ্রোহীরা ইংরেজ বণিক মি. বার্গকে হত্যা করে। সিলেটের কালেক্টর মি. উইলিস বরিশালের নদীপথে যাচ্ছিল। বিদ্রোহী কৃষকরা তার নৌকা আক্রমণ করে। উইলিস নদীর তীরে অবতরণ করে পালিয়ে যায়। ঢাকার কালেক্টটর মি. ডে বিদ্রোহীদের দমন করার জন্য একদল সিপাহী প্রেরণ করেন। তাদের সাথে সংঘর্ষে এ জেলার বিদ্রোহীদের অনেকে ধরা পড়ে এবং তাদের ঢাকা, মুর্শিদাবাদ ও বরিশালের জেলখানায় বছরের পর বছর বন্দী করে রাখা হয়।


মোলঙ্গীদের বিদ্রোহ ১৭৫৭-১৮৩১

প্রাচীনকালে থেকে বরিশালের জনগণ সমুদ্রজল ও লবণ মিশ্রিত মাটি রোদে শুকিয়ে লবণ তৈরি করত। এক সময় বরিশালের লবণ দিয়ে সারা বংলার চাহিদা মিটানো যেত। লবণ লাভজনক দেখে পলাশীর যুদ্ধের পর ইংরেজ বণিক ও কর্মচারীরা বিনা শুল্কে বরিশালে লবণ ব্যবসা শুরু করে। ঝালকাঠিতে ইংরেজ লবণ এজেন্ট বাস করত। ইংরেজ এজেন্ট দেশীয় কৃষকদের বিনা অনুমতিতে লবণ তৈরি বন্ধ করে দেয়। ঝালকাঠির বৈদারাপুর গ্রামে এক কৃষক পরিবার নিষেধ ভঙ্গ করে লবণ উৎপাদন করে। ফলে এক ইংরেজ কর্মচারী বৈদারাপুর গমন করে এবং অত্যাচার শুরু করে। এ সংবাদ শুনে কৃষকরা ইংরেজ সাহবেকে আক্রমণ করে এবং তাকে ধরে লবণের তাফালে ফেলে দিয়ে হত্যা করে।

মোলঙ্গীরা এজেন্টের নিকট থেকে দাদন নিয়ে কৃষকদের দিত এবং উৎপাদিত লবণ এজেন্ট ছাড়া অন্যত্র বিক্রি করতে পারত না। যে সকল কৃষক লবণ উৎপাদন করত তাদের মাহিন্দার বলা হতো। এজেন্ট ও ইজারাদারেরা লবণ পেয়াদা দিয়ে মোলঙ্গী ও কৃষকদের ওপর অত্যাচার চালাত। তাদের অত্যাচারে মোলঙ্গী ও কৃষকরা গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যেত। ১৮১৮ খৃৃস্টাব্দে মনপুরা দ্বীপের ৩৫০টি পরিবার অত্যাচার সহ্য করতে পেরে অন্যত্র পালিয়ে যায়। কোম্পানির বণিকরা জোর করে কৃষকদের সুন্দরবনে ধরে নিয়ে যেত এবং তাদরে দিয়ে লবণ তৈরি করাত। দক্ষিণ বরিশালের নিপীড়িত কৃষকরা আইন উদ্দিন সিকদারের নেতৃত্বে ইউরোপীয় ও তাদের আমলাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ১৮০০ খৃৃস্টাব্দে দক্ষিণ শাহাবাজপুরে বিদ্রোহী লবণ কৃষকরা গ্রীক লবণ ব্যবসায়ী মি. ডেমেট্রিয়াসের কুঠি আক্রমণ করে। কালারাজ তার প্রাণ রক্ষা করে। কিন্তু ডেমেট্রিয়াসের কর্মচারী প্যালিওলগাস বিদ্রোহীদের হাতে প্রাণ হারায়। জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট মি. মিডলটন আলিয়ার খাঁর অধীনে একদল সিপাহী পাঠিয়ে ৩১৪ জন কৃষককে গ্রেফতার করে।

ইদিলপুর ও উত্তর শাহবাজপুরের বিদ্রোহ উত্তর শাহবাজপুরের জমিদার লালরাম চৌধুরী কৃষকদের উৎপীড়ন করে কোম্পানির রাজস্ব দিতে অস্বীকার করে। ফলে ঢাকার এ্যাটর্নি পিটের সাথে লালরামের বিবাদ শুরু হয়। ১৭৭৭ খৃৃস্টাব্দে লালরাম ঢাকার পিটের কোর্ট আক্রমণ করে। কোর্ট ধ্বংস করার অভিযোগে সরকার লালরামকে গ্রেফতার করে। ইদিলপুরের জমিদার রামকান্ত ইরেজ ব্যবসায়ীদের অত্যাচারে অতীষ্ঠ হয়ে একদল বিদ্রোহী নিয়ে ঢাকার সোনারগঞ্জের ইংরেজ ফ্যাক্টরি ধ্বংস করে দেয়। কোম্পানি রামকান্তকে গ্রেফতার করে ঢাকা, মুর্শিদাবাদ ও বাকেরগঞ্জ জেলে ৬ বছর বন্দী করে রাখে।


শরিকলের যুদ্ধ-১৭৭৯

পলাশী যুদ্ধের পর নবাব সিরাজউদ্দৌলার একদল সৈন্য বরিশালের নাজিরপুর পরগণায় আশ্রয় নেয়। নাজিরপুর পরগণার জমিদার সৈয়দ ইমামউদ্দিন চৌধুরীর প্রেরণায় পলাশীর সৈন্যরা গৌরনদীর শরিকলে একটি দুর্গ নির্মাণ করেন। সৈয়দ ইমাম উদ্দিন ইংরেজ কোম্পানিকে খাজনা দেয়া বন্ধ করে দেন। গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেষ্টিংসের নির্দেশে ঢাকার এ্যাটর্নি পিট ১৭৭৭ খৃৃস্টাব্দে ইমাম উদ্দিনকে বন্দী করে কলকাতায় পাঠিয়ে দেয়। ১৭৭৭ খ্রিস্টাব্দের ১৮ সেপ্টেম্বর ঢাকার প্রাদেশিক কাউন্সিলের সদস্য মি. রোজ সৈয়দ ইমামউদ্দিনের মুক্তির জন্য হেষ্টিংসের নিকট আবেদন জানায়।৬ মুক্তি পেয়ে ইমামউদ্দিন যুদ্ধের প্রস্তুতি নেন। তিনি বাড়ির চারদিকে পরিখা খনন করেন এবং সশস্ত্র কৃষকদের সংঘবদ্ধ করেন। ইংরেজ সরকার ইমামউদ্দিনের বিদ্রোহের সংবাদ পেয়ে একদল সিপাহী প্রেরণ করেন এবং তারা শরিকল দুর্গ আক্রমণ করে। এক তীব্র সংঘর্ষের পর শরিকল দুর্গের পতন হয়। অতঃপর ইংরেজ সিপাহীরা সৈয়দ ইমামউদ্দিনের নলচিড়ার খানাবাড়ি আক্রমণ করে। কামানের গোলার আঘাতে বাড়ির ভবন ধ্বংস হয়ে যায়। কামানের গোলার আঘাতে ধ্বংসপ্রাপ্ত একটি দেয়াল খানাবাড়িতে এখনও আছে। নলচিড়া মিয়া বাড়িতে কয়েকটি কামান ছিল। পরাজয়ের পর কয়েকটি কামান দীঘিতে ফেলে দেয়া হয়। শরিকল বন্দরের পশ্চিম পাশে দুর্গের ধ্বংসাবশেষ আজও অতীতের স্মৃতি বহন করছে।


১৭৮৭ খ্রিস্টাব্দের দুর্ভিক্ষ ও কৃষক বিদ্রোহ

১৭৮৭ খৃৃস্টাব্দে বাকেরগঞ্জে এক ভীষণ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। খাজনার ভয়ে শত শত লোক ঘরবাড়ি ছেড়ে সুন্দরবনে আশ্রয় নেয়। কৃষকরা জমিদার ও কোম্পানির রাজস্ব কর্মচারীদের অত্যাচার হতে বাঁচার জন্য অস্ত্র ধারণ করে। বুজুর্গ উমেদপুরের তালুকদার আইনউদ্দিন সিকদার ও হায়াত মাহমুদ বিদ্রোহী কৃষকদের ঐক্যবদ্ধ করেন। আইনউদ্দিন সিকদার বাকেরগঞ্জ থানার নেয়ামতি গ্রামে বাস করত। ১৭৮৭ খৃৃস্টাব্দে প্লাবনে একদিকে লবণ উৎপাদন ব্যাহত হয়, অন্যদিকে কৃষকের ফসল নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু তবু কোম্পানির কর্মচারী ও গোমস্তারা কৃষকদের ওপর নিপীড়ন চালায়। আইনউদ্দিন সিকদার তার বাহিনী নিয়ে ইংরেজ বণিক ও গোমস্তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। সরকার আইনউদ্দিন সিকদারকে ডাকাত আখ্যা দিয়ে ১৭৮৯ খৃৃস্টাব্দে রাতের অন্ধকারে তার বাড়ি আক্রমণ করে এবং তাকে বন্দী করে। গ্রেফতারের পর আইনউদ্দিন সিকদারের কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। স্থানীয় লোকদের মতে, কোম্পানির সিপাহীরা আইনউদ্দিন সিকদারকে হত্যা করে বিষখালী নদীতে ফেলে দেয়। মি. বেভারিজ বলেছেন যে, তাকে নির্বাসনে দেয়া হয়েছিল।

কড়াপুরের হায়াত মাহমুদ চন্দ্রদ্বীপ ও বুজুর্গ উমেদপুর পরগণার একজন জমদিার ছিলেন। তিনি তার বাহিনী নিয়ে কোম্পানির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন এবং তাদের বরিশালের নদীপথে যাতায়াত প্রায় বন্ধ করে দেন। তাই ইংরেজ কোম্পানি তাকে ডাকাত সর্দার আখ্যা দেয়। কোম্পানির সিপাহীরা তাকে ১৭৮৯ খৃৃস্টাব্দে গ্রেফতার করে। ঢাকার নায়েব নাজিম হায়াত মাহমুদকে ১৭৯০ খৃৃস্টাব্দে যাবজ্জীবন কারাদ- দেয়। গভর্নর জেনারেল লর্ড কর্নওয়ালিস বিদ্রোহী যোদ্ধা হায়াত মাহমুদকে প্রিন্স অব ওয়েলস দ্বীপে নির্বাসন দেয় এবং তার জমিদারী কেড়ে নেয়। ১৮০৬ খৃৃস্টাব্দে তিনি মুক্তিলাভ করে কড়াপুরে ফিরে আসেন।


বলখী শাহের বিদ্রোহ ও স্বাধীনতা ঘোষণা

পিরোজপুরের এক কৃষক পরিবারে বলখী শাহের জন্ম। উচ্চারণ অপভ্রংশে তাঁর নাম বালকী শাহ, বুলাকী শাহ ইত্যাদিরূপে লিখিত হয়েছে। দক্ষিন শাহবাজপুরে তার সম্পত্তি ছিল। ১৭৮৭ খৃৃস্টাব্দে দুর্ভিক্ষপীড়িত কৃষকদের নিয়ে তিনি একটি দুর্ধর্ষ বাহিনী গঠন করেন। তিনি ইংরেজ বণিক ও জমিদারদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। তিনি ঝালকাঠি থানার সুগন্ধা বা সুগন্ধিয়া গ্রামে দুর্গ নির্মাণ করেন। বলখী শাহ সুজাবাদের কেল্লা হতে কয়েকটি কামান সংগ্রহ করেন। দুর্ভিক্ষপীড়িত কৃষকরা সুজাবাদ ও ইন্দ্রপাশা দুর্গের অনেক সৈন্য বলখী শাহের পতাকাতলে আশ্রয় নেয়। বিদ্রোহী কৃষকদের নিয়ে বলখী শাহ সুগন্ধায় একটি শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। তিনি দুর্গের মধ্যে একটি কামানশালা ও একটি গোলাবারুদ তৈরির কারখানা স্থাপন করেন। কামারশালায় বল্লম ও তরবারি তৈরি হতো। ১৭৯২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারির এক পত্রে ইংরেজ কালেক্টর বলখী শাহরে বিদ্রোহের বর্ণনা দিয়েছেন।১০ তারবর্ণনায় দেখা যায় বলখী শাহের সুগন্ধার দুর্গে ৭টি কামান ও ১২টি মাস্কেট বন্দুক ছিল। সর্বদা বন্দুকধারী সৈন্য দুর্গ পাহারা দিত। কয়েকজন সর্বদা গোলাবারুদ তৈরি করত। বলখী শাহ ১৭৯২ খৃৃস্টাব্দে স্বাধীনতা ঘোষনা করলেন। তিনি প্রচার করলেন ‘ফিরিঙ্গীদের রাজত্ব শেষ হয়ে গেছে’। তিনি কৃষকদের খাজনা দিতে নিষেধ করেন এবং জমিদারের নায়েব ও গোমস্তাদের বন্দী করেন। একজন নায়েব কোনরকমে পালিয়ে গিয়ে বলখী শাহের বিদ্রোহের কথা সরকারকে জানিয়ে দেয়। তারপর জমিদার ও ইংরেজ সরকারের সিপাহীরা সুগন্ধিয়ার দুর্গ আক্রমণ করে। যুদ্ধে বলখী শাহের কৃষক বাহিনী পরাজয় বরণ করে। সুগন্ধিয়ার দুর্গের পতন হলে বলখী শাহ্ আত্মগোপন করেন।

বরিশাল জেল বিদ্রোহ-১৮১২ অনেক বিদ্রোহী কৃষককে ইংরেজ সরকার ডাকাতি মামলায় অভিযুক্ত করে বরিশাল জেলখানায় বন্দী করে রাখে। ১৮১২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জেলবন্দীরা বাকেরগঞ্জের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মি. বেটিকে আক্রমণ করে। একজন জমাদার বেটির প্রাণ রক্ষা করে। বেটির আদেশে প্রাদেশিক ব্যাটেলিয়নের সিপাহীরা নিরস্ত্র বন্দীদের ওপর গুলিবর্ষণ করে অনেককে হত্যা ও আহত করে। সরকারী হিসেবে ১২ জন বন্দী গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়। বিদ্রোহী বন্দীদের ভয়ে মি. বেটি ও সিপাহীরা পালিয়ে যায়। বন্দীরা জেলখানা ভেঙ্গে ফেলে এবং আগুন দিয়ে জেলখানা পুড়িয়ে ফেলে। অধিকাংশ বন্দী পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়।


ফরাজী আন্দোলন

উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় ফরাজী আন্দোলন। ফরাজী আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা হাজী শরীয়তুল্লাহ। ফরাজী আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল মুসলমান সমাজের কুসংস্কার দূর করা, অন্যদিকে অত্যাচারী জমিদার ও ইংরেজদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা। হাজী শরীয়তুল্লাহ ১৭৮১ খৃৃস্টাব্দে মাদারীপুর মহকুমার মুলফতগঞ্জ থানার বাহাদুরপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। মুলফতগঞ্জসহ মাদারীপুর ১৮৭৩ খৃৃস্টাব্দে পর্যন্ত বাকেরগঞ্জ জেলার অন্তর্গত ছিল। দক্ষিণবঙ্গে বিশেষ করে ফরিদপুর ও বরিশালের হাজার হাজার কৃষক ফরাজী আন্দোলনে যোগ দেয়। শরীয়তুল্লাহ ১৮৪০ খৃৃস্টাব্দে ৫৯ বছর বয়সে বাহাদুরপুরে দেহ ত্যাগ করেন। তার মৃত্যুর পর তার পুত্র দুদু মিয়া ফরাজী আন্দোলনের নেতৃত দেন। তিনি ১৮০৮ খৃৃস্টাব্দে জন্মগহ্রণ করেন। তিনি জমিদারদের খাজনা প্রদান বন্ধ করে দেন। তার অধীনে ৮০ হাজার কৃষক ছিল। হিজলা, মেহেন্দীগঞ্জ, মুলাদী, গৌরনদী, বাকেরগঞ্জ, ভান্ডারিয়ার হাজার হাজার কৃষক তার শিষ্য ছিল। ১৮৪৬ খ্রিস্টাব্দের ৫ ডিসেম্বর পীর দুদু মিয়ার ৫০০ কৃষক মাদারীপুরের পঞ্চচরের মিঃ ডানলপের নীলকুঠি আক্রমণ করে এবং তার গোমস্তা কাঞ্জিলালকে ধরে নিয়ে যায়। বিদ্রোহীরা কাঞ্জিলালকে গলাচিপার মৌডুবি চরের নিকটে হত্যা করে বঙ্গোপসাগরে ফেলে দেয়। ১৮৫৭ খৃৃস্টাব্দে সিপাহী যুদ্ধের সময় দুদু মিয়াকে ব্রিটিশ সরকার বন্দী করে এবং ১৮৬২ খ্রিস্টাব্দের ২৪ মে তিনি ঢাকার বংশাল রোডে প্রাণ ত্যাগ করেন।


সিংখালীর কৃষক বিদ্রোহ-১৮৫৪

বাকেরগঞ্জ জেলার মঠবাড়িয়া ও ভান্ডারিয়া নিয়ে পরগণা সৈয়দপুর গঠিত ছিল। সৈয়দপুর পরগণার দশ আনার মালিক ছিল ঢাকার মিত্রজিত সিং এবং দু’আনার মালিক ছিল বিরজা রতন দাস। ফরিদপুর জোর গেরদা নিবাসী শেখ দৌলত মিত্রজিতদের অধীনে তালুক লাভ করে ভান্ডারিয়ার সিংখালী গ্রামে জঙ্গল আবাদ করে বসতি স্থাপন করেন। তার পুত্র শেখ গগন মিয়া ও মোহন মিয়া। খালের পশ্চিম পাড়ে গগন মিয়া ও পূর্ব পাড়ে মোহন মিয়া ১৭ হাত পরিখা খনন করে ৪০ একর ভূমির ওপর বসতবাড়ী নির্মাণ করেন। তালুকের দখল নিয়ে মিত্রজিত ও বিরজা রতন দাসের পরিবারের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে বিবাদ ছিল। গগন ও মোহন অনেক কৃষক পরিবারকে নিয়ে সুন্দরবন আবাদ করেন। কিন্তু মিত্রজিত গগন, মোহন ও কৃষকদের নামে ভূমি কবলিয়াত দিতে অস্বীকার করেন। তখন গগন ও মোহনের নির্দেশে কৃষকরা মিত্রজিতদের খাজনা দেয়া বন্ধ করে দেয়।

মিত্রজিত তালুক মদন ঘোষকে বন্দোবস্ত দেন। মদন ঘোষের কর্মচারী ছিল মঠবাড়িয়া থানায়। গগন ও মোহন মদন ঘোষের লম্বা টিকি কেটে দেয় এবং তাকে সিংখালী নিয়ে যায়। মদন ঘোষের টিকি কাটা হতে মঠবাড়িয়ার ঘোষের টিকিকাটা গ্রামের নামকরণ হয়েছে। মদন ঘোষকে টুকরা টুকরা করে কেটে হত্যা করা হয়। মদন ঘোষের খুন মামলায় গগন, মোহনের যাবজ্জীবন সাজা হয় এবং আন্দামানে দ্বীপান্তর হয়। সেখানে জেল সুপারের স্ত্রী সর্পাঘাতে মরণাপন্ন হয়। গগন তাকে ওঝালি করে ভাল করে তোলে এবং পুরস্কারস্বরূপ ৫ বছর পরে উভয় ভ্রাতা মুক্তি লাভ করে। বিরজা রতন দাসের অনুগ্রহ লাভ করে গগন, মোহন তাদের তালুক উদ্ধার করে। তাদের বাড়ির পার্শ্ববর্তী লুফা, কাজী, মৃধা ও চোকদারদের পূর্বপুরুষ গগন, মোহনদের বাহিনীর বিভিন্ন দায়িত্বে নিয়োজিত ছিল।

অনন্যোপায় হয়ে মিত্রজিত সিং কোম্পানির সাহায্য কামনা করেন। পুলিশ কয়েকবার গগন ও মোহনকে গ্রেফতার করতে আসে। কিন্তু তারা ব্যর্থ হয়ে ফিরে যায়। গগন, মোহন মিত্রজিতদের সৈয়দপুর পরগণার দশ আনা দখল করে নেয়। তারা কৃষকদের নিকট হতে লুফা বা টর্চ সালামী আদায় করে একটি শক্তিশালী বাহিনী গঠন ও সুরক্ষিত দুর্গ নির্মাণ করেন। জমিদার ইংরেজ সরকারের সৈন্য ও পুলিশ নিয়ে প্রজাদের ওপর নির্যাতন চালাত। ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারিতে বাকেরগঞ্জের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মিঃ হ্যারিসন দেশীয় পুলিশ ও একদল ইংরেজ সৈন্য নিয়ে সিংখালী গমন করেন। তারা পাড়েরহাটের অপর পাড়ে তেলিখালী অবতরণ করেন। ঘোড়ায় চড়ে ম্যাজিস্ট্রেট সিংখালী চলছেন। ইতিমধ্যে গগন, মোহন জঙ্গল হতে গুলি করে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের মাথার টুপি উড়িয়ে দেন। উভয়পক্ষে তীব্র লড়াই হয়। গগন, মোহন তাদের বাড়ি ছেড়ে দিয়ে জঙ্গলে আশ্রয় নিয়ে যুদ্ধ করে। মিঃ হ্যারিসন গগন, মোহনের পরিত্যক্ত বাড়ি দেখতে পান। যুদ্ধ করার জন্য গগন ও মোহনের বাড়ি যেভাবে সুরক্ষিত করা হয়েছে তা দেখে হ্যারিসন বিস্মিত হয়েছেন। ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দের ২৮ ফেব্রুয়ারি লিখিত পত্রে হ্যারিসন সিংখালী গমন ও সংঘর্ষের বিবরণ দিয়েছেন।

হ্যারিসনের পর মিঃ আলেকজান্ডার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হয়ে আসেন। তিনি গগন ও মোহনকে গ্রেফতার করার জন্য তিন থানার পুলিশ ও শত শত চৌকিদার প্রেরণ করেন। তারা পরাজিত হয়ে ফিরে আসে। এ সংবাদে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আলেকজান্ডার ক্ষিপ্ত হয়ে পড়েন। তিনি নিজে অনেক পুলিশ ও ইংরেজ সৈন্য নিয়ে সিংখালী গমন করেন। তাকে সমর্থন করতে এগিয়ে আসেন মোরেলগঞ্জের মিঃ মোরেল ভ্রাতৃদ্বয় ও তাদের বাহিনী। আলেকজান্ডার তার ১৯ ডিসেম্বর তারিখে লিখিত পত্রে সিংখালীর ঘটনার বিবরণ দিয়েছেন। তিনি তার বাহিনী নিয়ে দু’মাইল হেঁটে খাল অতিক্রম করে মোহনের বাড়ি পৌঁছেন। হঠাৎ ঢাল, লেজা নিয়ে গগন, মোহন মিঃ আলেকজান্ডারকে আক্রমণ করে। উভয়পক্ষে সংঘর্ষ শুরু হয়। ঘটনাস্থলে ১৭ জন বিদ্রোহী কৃষক নিহত হয়। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোহনের বাড়ি দখল করার চেষ্টা করলে বিদ্রোহীরা ভিতর হতে গুলিবর্ষণ করে। তখন পুলিশ বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট তাড়াতাড়ি মোহনের বাড়ি ত্যাগ করে পালিয়ে যান। পালিয়ে যাবার সময় তিনি পুলিশ বাহিনীকে মৃতদেহগুলো আনার নির্দেশ দেন। কিন্তু পুলিশ প্রাণভয়ে পলায়ন করে। গগন, মোহন ১৭ জন বিদ্রোহী কৃষকের মৃতদেহ উদ্ধার করে মোহনের বাড়ির দরজায় কবর দেয়। এখনো তাদের কবরগুলো বাঁধানো আছে এবং সেগুলোতে নামফলক আছে।

ইংরেজ প্রশাসন জমিদারদের সাথে একত্র হয়ে কৃষকদের ওপর অমানুষিক অত্যাচার করাতে থাকে। শেষ পর্যন্ত গগন ও মোহন কোর্টে উপস্থিত হয়। সরকার তাদেরকে ৮টি মিথ্যা মামলায় অভিযুক্ত করে। বাকেরগঞ্জের জেলা মিঃ স্টিয়ার ১৮৫৪ খ্রিস্টাবেদর ১৪ সেপ্টেম্বর এবং ১৮৫৫ খ্রিস্টাবেদর ৫ জানুয়ারি গগন ও মোহনের বিরুদ্ধে আনীত মামলার রায় দেয় এবং উভয় ভ্রাতাকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড প্রদান করে। এরপর তারা ৬০ বছর বেঁচে ছিল এবং ৩০ বছর কারাগারে ছিল। শেষ জীবনে মুক্তি পেয়ে সিংখালী ফিরে আসে। তাদের বংশধররা সিংখালী গ্রামের মিয়াবাড়িতে বাস করছে।



তুষখালীর কৃষক বিদ্রোহ-১৮৩০-১৮৭০

মঠবাড়িয়ার তুষখালী অর্ধ শতাব্দী ধরে কৃষক বিদ্রোহের কেন্দ্র ছিল। সৈয়দপুর পরগণার জমিদার মিত্রজিতদের দখল করে সুন্দরবনের কমিশনার ডেমপেয়ার ১৮৩০ খৃৃস্টাব্দে তুষখালী বাজেয়াপ্ত করে নেয় এবং টাকীর জমিদার দেবনাথের নিকট ইজারা দেয়। ইজারা প্রথার ফলে কৃষকদের কয়েক গুণ রাজস্ব বেশি দিতে হয়। কৃষকরা ইজারাদারদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। টাকীর জমিদার পরে অত্যাচারী মোড়লদের নিকট তুষখালী বন্দোবস্ত দেয়। কৃষকরা মোড়লদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে খাজনা দেয়া বন্ধ করে দেয়। শেষ পর্যন্ত সরকার বাধ্য হয়ে ১৮৭১ খৃৃস্টাব্দে মোড়লদের দখল হতে তুষখালী বাজেয়াপ্ত করে নেয় এবং খাস ভূমি হিসেবে রাজস্ব আদায় করে।


১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের সিপাহী বিদ্রোহ

১৮৫৭ খৃৃস্টাব্দে সিপাহী বিদ্রোহের সময় বাকেরগঞ্জ জেলায় উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। অনেক জমিদার তালুকদার গোপনে সিপাহীদের অর্থ সাহায্য করে। ঢাকার সিপাহীরা বরিশাল শহর আক্রমণের পরিকল্পনা করে। সিপাহীদের আগমনের সংবাদ শুনে বরিশালের ইংরেজ অধিবাসী ও কর্মচারীরা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির লোন অফিসে আশ্রয় নেয় এবং অনেকদিন ভীত অবস্থায় দিনযাপন করে। যুদ্ধের পরে সরকার অনেক জমিদার ও তালুকদারকে বিদ্রোহী সিপাহীদের সাথে যোগাযোগ ছিল বলে হয়রানি করে।১৪


নীল চাষীদের সংগ্রাম

১৭৭৭ খৃৃস্টাব্দে লুই বান্না নামক একজন ফরাসী বাংলাদেশে প্রথম নীল চাষ আরম্ভ করে এবং তার পর নীল চাষ বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। ইংল্যান্ডের বস্ত্র শিল্পের জন্য রং সরবরাহ হতো বাংলাদেশ থেকে। ১৮২৬ খৃৃস্টাব্দে বাকেরগঞ্জে নীল চাষ শুরু হয়। শায়েস্তাবাদ, কাগাশুরা, কাশিপুর, পঞ্চকরণ, চরামদ্দি ও বারৈকরণে নীল চাষ হতো। নীল চাষ বরিশালের কৃষকদের ভূমিদাসে পরিণত করে। ন্যাথালিয়ান মনরো ও মি. কলভিন বরিশালের প্রধান নীল কুঠিয়াল ছিল। এ জেলার কৃষকরা নীল চাষের বিরোধিতা করে। কৃষকদের ভয়ে তারা নীল চাষ বন্ধ করে পালিয়ে যায়। ১৮৬০-৬১ খৃৃস্টাব্দে যশোর ও কুষ্টিয়ায় নীল চাষীদের বিদ্রোহ দেখা দেয়। কিন্তু বাকেরগঞ্জে সিপাহী যুদ্ধের পূর্বে নীল চাষীরা বিদ্রোহ করেছিল। ঝালকাঠিতে নীলকুঠি ছিল। বিদ্রোহী নীল চাষীরা নীল কুঠির সাহেবকে আক্রমণ করে এবং তার শিরñেদ করে ফেলে। ঝালকাঠি সরকারী স্কুলের নিকট তার সমাধি ছিল।


বিপ্লবী আশু আকন্দের নেতৃত্বে কৃষক বিদ্রোহ

১২৮৬ সন বা ১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দে আশু আকন্দের নেতৃত্বে মেহেন্দিগঞ্জ থানায় কৃষক বিদ্রোহ ঘটে। বাংলাদেশে কৃষক আন্দোলনে আশু আকন্দের অবদান ও আত্মত্যাগ অতুলনীয়। তার মতো কোন কৃষক নেতা নিষ্ঠুরভাবে মৃত্যুবণ করেননি। তাকে উলানিয়ার জমিদাররা ফুটন্ত তেলের কড়াইতে ভেজে হত্যা করেছে। মেহেন্দিগঞ্জ থানার চাঁদপুর গ্রামে আশু আকন্দের জন্ম।

আশু আকন্দের পূর্ব পুরুষ শেখ কুতুবউদ্দিন একজন প-িত ও ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি ছিলেন। তার পুত্র শেখ মোহন বিশ্বস্ত হিসেবে খ্যাত ছিলেন। লোকে তাকে মোহন শেখ বিশ্বাস বলত। শেখ মোহনের পুত্র জহিরুদ্দিন আকন। তার পুত্র আশু আকন্দ একজন উচ্চ শিক্ষিত যুবক ছিলেন।

উনিশ শতকের মধ্যভাগে উলানিয়ার জমিদারদের কৃষক নির্যাতন ও শোষণ চরমে পৌঁছে। আশু আকন্দ জমিদারদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। ১২৮৬ সনে (১৮৭৯ খৃৃস্টাব্দে) আশু আকন্দ উলানিয়া ও পার্শ্ববর্তী ২২টি গ্রামের কৃষকদের সংঘবদ্ধ করেন। তার আহবানে কৃষকরা উলানিয়া জমিদারদের খাজনা দেয়া বন্ধ করে দেয়। আশু আকন্দের চাঁনপুর গ্রামকে কেন্দ্র করে আন্দোলন তুঙ্গে ওঠে। এ কারণে চাঁদপুরের অপর নাম জোট চাঁনপুর। ২২টি গ্রামের কৃষক নেতাদের সভা আহবান করেন এবং ১০ সদস্যের কমিটি গঠন করেন। তারা মসজিদে প্রতিজ্ঞা করে যে, তারা অত্যাচারী জমিদারদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার জন্য ঐক্যবদ্ধ থাকবে। জমিদারদের নায়েব, পেয়াদা ও লাঠিয়ালদের আক্রমণ আশু আকন্দের নেতৃত্বে বিদ্রোহী কৃষক সমাজ প্রতিহত করে। উলানিয়ার জমিদাররা আশু আকন্দকে ২২ মৌজার তালুক প্রদানের প্রস্তাব দিলে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন।

জমিদার বিদ্রোহী প্রজাদের জমি নিলামে দেয়। প্রজারা ঐক্যবদ্ধ থাকায় নিলামী জমি ক্রয়ের কোন ক্রেতা পাওয়া যায়নি। নিলাম বিক্রি কার্যকর করার জন্য সরকার ১০ জন শিখ সৈন্য প্রেরণ করে। জমিদার প্রথমে নাপিতের বাড়ি আক্রমণ করে। পূর্বের সিদ্ধান্ত অনুসারে নন্দবাসী পাল সঙ্কেত দিলে হাজার হাজার লোক নাপিতের বাড়ি আসে। জমিদারের বাহিনী গুলি করে কয়েকজন কৃষককে হত্যা করে। কিন্তু জনতার কাছে জমিদারদের বাহিনী পরাজিত হয়ে শিখ সৈন্যসহ পালিয়ে যায়। জমিদার মামলা করে। কিন্তু কোন প্রজা আশু আকন্দের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেয়নি।

জমিদার আশু আকন্দের বন্ধু ভবতোষ তরফদারকে তালুক প্রদানের লোভ দেখিয়ে বশীভূত করে। ভবতোষ আশু আকন্দকে তার বাড়িতে দাওয়াত দেয়। ১২৮৬ সনের ১৫ ফাল্গুন আশু আকন্দ ২ জন সাথী নিয়ে ভবতোষের বাড়ি যায়। সংবাদ পেয়ে জমিদার সৈন্য ও কুকুর নিয়ে আশু আকন্দকে আক্রমণ করে। ভবতোষের স্ত্রী ষড়যন্ত্রের কথা আশু আকন্দকে জানিয়ে দিলে তিনি ঘোড়ায় উঠে পালিয়ে যান। কিন্তু পথে খেজুর গাছে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যান। জমিদার ও কুকুর তাকে ঘিরে ফেলে। জমিদার তাকে বন্দী করে বাড়ি নিয়ে যায়। সংবাদ শুনে হাজার হাজার লোক জমিদার বাড়ি আক্রমণ করে। জমিদার বাহিনী গুলি করলে তারা পিছু হাটতে বাধ্য হয়। তারা থানায় মামলা করে। পুলিশ আসে ৭ দিন পর। পুলিশ তৎক্ষণাৎ আশু আকন্দকে উদ্ধারে কোন চেষ্টা করেনি।

আশু আকন্দকে বন্দী করে জমিদারের লোকেরা তার ওপর অমানুষিক নির্যাতন করে। প্রথমে তার পায়ের আঙ্গুল কেটে ফেলা হয়, শরীরে চামড়া উঠিয়ে লবণ দেয়, চোখ উপড়ে ফেলে। অবশেষে গরম তেলের কড়াইতে তাকে ছেড়ে দেয়। কই মাছের মতো তাকে ভাজা হয়। তার দেহ অবশেষে মাটিতে পুঁতে ফেলা হয়। তার মৃতদেহের কোন সন্ধান পাওয়া যায়নি।

আশু আকন্দের স্ত্রী আতরজান বিবি মামলা করে। মামলায় কিছু হয়নি। তবে জমিদারী কোর্ট অব ওয়ার্ডের নিকট অর্পণ করে প্রজাদের সান্ত¦না দেয়া হয়। আশু আকন্দের এক কন্যা ছিল। কন্যার বংশধর জীবিত আছে। আশু আকন্দের ভাইয়ের পৌত্র জীবিত আছে। জমিদার কর্তৃক আশু আকন্দকে নির্মমভাবে হত্যা তৎকালীন বাংলায় আলোড়ন সৃষ্টি করে। জমিদারদের নির্যাতনের প্রতিবাদ করায় আশু আকন্দকে প্রাণ দিতে হলো। সরকার এ নির্মম হত্যার কোন বিচার করেনি। বিদ্রোহী কৃষক সমাজ নীরবে নিভৃতে আশু আকন্দের জন্য কেঁদেছে। আজও এ অঞ্চলের মানুষ আশু আকন্দের বীরত্বের কথা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে।


উপসংহার

ইংরেজ কোম্পানি কৃষকদের সকল সম্পত্তি হতে বঞ্চিত করে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত সৃষ্টি করে। রাজস্ব আদায় ও বিদ্রোহী কৃষকদের দমনের জন্য কোম্পানি কোর্ট, জেলখানা ও পুলিশ ব্যবস্থা চালু করে। জেলা, মহকুমা ও থানা স্থাপনের উদ্দেশ্য ছিল বিদ্রোহ দমন। কৃষকরা অনুনয়-বিনয় করে যখন তাদের দাবি আদায় করতে ব্যর্থ হতো, তখন তারা অস্ত্র হাতে তুলে নিতো এবং সরকার ও জমিদার তাদের ডাকাত বলে আখ্যায়িত করতো। মিঃ রেলী জেলাবাসীদের দাঙ্গাবাজ ও ডাকাত বলে আখ্যায়িত করেছে। মিঃ জে সি জ্যাক রেলীর মন্তব্যের প্রতিবাদ করে বলেছেন যে, ইংরেজ শাসনের প্রথমদিকে জমিদাররা কোন আইন মেনে চলত না। তাই এ অবস্থায় জনগণ দাঙ্গাবাজ হলে তাতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। মূলত ইংরেজ শাসনের হাত হতে বাঁচার জন্য কৃষকরা কোম্পানি আমলে হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছিল। ১৮ শতকে এ সংগ্রামের উদ্দেশ্য ছিল ইংরেজ শাসন ও সামন্ত প্রথার উচ্ছেদ। বরিশালের কৃষক বিদ্রোহ, সিপাহী বিদ্রোহ প্রভৃতি উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন ও জাতীয়তাবাদের বৈপ্লবিক রূপ নিয়েছে। স্বাধীনতা সংগ্রামে বরিশালের কৃষক বিদ্রোহের অবদান চিরদিন উজ্জ্বল হয়ে থাকবে।


তথ্যসূত্র: সিরাজ উদ্দীন আহমেদ। বরিশাল বিভাগের ইতিহাস (১ম খণ্ড)। ভাস্তর প্রকাশনী। ২০১০।