বরিশালের রকেট সার্ভিস

Barisalpedia থেকে

প্রায় এক শ বছর ধরে বরিশালের নদীপথের যাত্রীদের সেবা দিয়ে আসা স্টিমার সার্ভিস বরিশালের রকেট সার্ভিস নামে পরিচিত। এগুলো প্যাডেল ষ্টীমার।

গাজি রকেট .png

রকেট নির্মাণ ও রুটের ইতিহাস

কলকাতার রিচ গার্ডেন শিপইয়ার্ডে নির্মিত হতো হুইল প্যাডেল স্টিমারগুলো। ঢং যেমন রাজকীয়, নামও খানদানি। পিএস গাজী, পিএস অস্ট্রিচ, পিএস মাহসুদ তৈরি হয় ১৯২৯ সালে। পিএস লেপচা ১৯৩৮ সালে আর পিএস টার্ন ১৯৫০ সালে। এমভি সেলা তৈরি হয় ১৯৫১ সালে। ঢাকা-চাঁদপুর-বরিশাল-পিরোজপুর-বাগেরহাট-মংলা হয়ে খুলনা পর্যন্ত ছিল এর চলাচল। তবে এখন যায় মোরেলগঞ্জ পর্যন্ত। পিএস গাজী আর পিএস কিউই এখন আর বহরে নেই। গোড়ায় স্টিমারগুলো ইন্ডিয়ান জেনারেল স্টিম নেভিগেশন অ্যান্ড রেলওয়ে নেভিগেশন কম্পানি লিমিটেডের আওতায় ছিল। দেশভাগের পর দায়িত্ব নেয় পাকিস্তান রিভার স্টিমার সার্ভিস। এখন বিআইডাব্লিউটিসি এই বহর পরিচালনা করে। মহারানি ভিক্টোরিয়া, রানি এলিজাবেথও রকেট সার্ভিসে ভ্রমণ করেছেন। নকশা ঠিক রেখে বিভিন্ন সময় স্টিমারগুলো সংস্কার করা হয়েছে। ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত এগুলো ছিল স্টিমইঞ্জিন চালিত। সে আমলে নারায়ণগঞ্জের নিতাইগঞ্জ কয়লা ঘাট থেকে জ্বালানি নেওয়া হতো। এখন স্টিমারগুলো ডিজেল-চালিত। হাইড্রোলিক ও ইলেক্ট্রহাইড্রোলিক প্রযুক্তি সংযোজন করে দ্রুতগামী করা হয়েছে রকেট সার্ভিসকে। জাহাজগুলোয় প্রতিবছর তিন শর বেশি বিদেশি পর্যটক চলাচল করে। প্রথম শ্রেণির কেবিনগুলোর মাঝে বিরাট ডাইনিং টেবিল আছে। কেবিনগুলো দোতলায় এবং একদম সামনের দিকে।


জেমস জনস্টন ও স্টিমার সার্ভিস

স্টিমারগুলোর সঙ্গে জড়িয়ে আছে জেমস জনস্টনের নাম। ১৮২৯ সালে তাঁকে মেরিন বোর্ডের অধীন বাংলার নদীগুলোতে চলাচলকারী সব গণপরিবহনের অস্থায়ী নিয়ন্ত্রকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ১৮৩০ সালের দিকে তিনি সরকারকে ভারতীয় নদীগুলোতে চলাচলের উপযোগী স্টিমার নির্মাণ ও নকশা তৈরির পরামর্শ দেন। তখনো অবশ্য গঙ্গা নদীতে ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানির নিয়ন্ত্রণে কিছু স্টিমার চলত। ১৮৪৪ সালে ব্রিটিশ ব্যক্তি মালিকানাধীন দি ইন্ডিয়ান জেনারেল স্টিম নেভিগেশন (আইজিএসএন) কম্পানি এই অঞ্চলে কাজ শুরু করে। তারা নদীপথে যাত্রী পরিবহনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আঠারো শতকের মধ্যভাগে ব্রহ্মপুত্র দিয়ে নিয়মিত স্টিমার চলাচল শুরু হওয়ার কথা জানা যায়। ১৮৭৩ সালে রিভার স্টিম নেভিগেশন কম্পানি (আরএসএন) প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮৮৪ সালে বরিশাল-খুলনা রুটে প্রথম স্টিমার চালু হয়। নৌপথের এই ব্যবসা লাভজনক হওয়ায় ১৮৯৬ সালে বাংলায় অনেক স্টিমার রুট চালু হয়। ১৮৮৯ সালে আইজিএসএন ও আরএসএন এক হয়ে কাজ শুরু করে। ১৮৯৯ সালে আইজিএসএন নাম পরিবর্তন করে হয় ইন্ডিয়ান জেনারেল নেভিগেশন অ্যান্ড রেলওয়ে কম্পানি লিমিটেড। ব্রিটিশরা চা, পাটের দড়ি নদীপথে পরিবহনের জন্য স্টিমার চালুতে আগ্রহী হয়ে ওঠে। সে সময় তারা বেশ কিছু জলযান নির্মাণ করে। আসাম থেকে তাহিরপুর হয়ে ব্রহ্মপুত্র নদ দিয়ে ঢাকার দিকে একটি রুট ছিল। চট্টগ্রাম ও বরিশালের মধ্যে রুট ছিল। তবে নারায়ণগঞ্জ ও চাঁদপুরে সারা বছরই চলাচল থাকত। বর্ষার সময় অন্যান্য রুটেও চলত। আসাম পথ, চট্টগ্রাম পথ, কাছাড় পথ, উত্তর-পশ্চিম পথ ও বরিশাল পথ মোট পাঁচটি রুটে বাষ্পীয় জাহাজ চলাচলের কথা জানা যায়।


ফ্যাক্ট ফাইল

পিএস গাজী: পিএস গাজী সে সময়ের সব চেয়ে বিলাসবহুল প্যাডেল স্টিমার। একে চারবার সংস্কার করা হয়, যার মধ্যে ১৯৮৫ সালে খোলের প্লেট বদলানো উল্লেখযোগ্য। ১৯৯০ সালের শেষের দিকে আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হয় গাজী। এরপর স্টিমারটি পরিত্যক্ত ঘোষণা হলে নিলামে বিক্রি করা হয়।

অস্ট্রিচ: ১৯২৯ সালে নির্মিত। সপ্তাহে দুটি ট্রিপ দেয়। মোরেলগঞ্জ পৌঁছাতে সময় নেয় ২০ ঘণ্টা। ৯০০ জন যাত্রী ও ১৫০ টন মাল বহনের ক্ষমতা আছে অস্ট্রিচের। প্রথম শ্রেণির কেবিন আছে ১২টি। দ্বিতীয় শ্রেণিতে আছে ১০টি। তৃতীয় শ্রেণিতে যাত্রী ধরে ৮০০। গতি প্রায় ৮ নটিক্যাল মাইল।

নৌপথ

৩৫৪ কিলোমিটার যাত্রাপথে স্টিমারগুলো অতিক্রম করে বুড়িগঙ্গা, ধলেশ্বরী, মেঘনা, আড়িয়াল খাঁ, কীর্তনখোলা, বিষখালী, গাবখান চ্যানেল, সন্ধ্যা নদী, কালিগঞ্জ নদী, কচা, বালাসোয়ার, ঘাসিয়াখালীসহ মোট ১৬টি নদী।


তথ্যউৎস: Barisal – 250 Years History in Photographs শীর্ষক পেইজ।