বরিশালের ভূমি ব্যবস্থা (মোগল যুগ)

Barisalpedia থেকে

আকবরের রাজস্বমন্ত্রী টোডরমল ১৫৮২-৮৭ সালে বাকলা-চন্দ্রদ্বীপের ভূমি ব্যবস্থা সম্পাদনা করেন। জীম্মন খাঁ নামে একজন মোগল কর্মচারী এ অঞ্চলে জরিপ ও রাজস্ব নির্ধারণ করেন। টোডরমলের ভূমি ব্যবস্থাই বাকলায় মোগলদের প্রথম ভূমি ব্যবস্থা।

ফসল, মুদ্রা ও কড়ির মাধ্যমে খাজনা পরিশোধ করা যেত। তখন বাকলার অর্থনীতি মুদ্রা ভিত্তিক ছিল না। সুতরাং ফসলের দ্বারা বেশির ভাগ রাজস্ব আদায় হতো। গ্রামে কড়ির প্রচলন বেশি ছিল। ১৮০০ সাল পর্যন্ত বাকলায় কড়ির প্রচলন ছিল। আবুল ফজলের আইন-ই-আকবরী, মিঃ গ্রান্ট ও ব্লকম্যানের বিবরণে বাকলার ভূমি ব্যবস্থা সম্পর্কে উল্লেখ আছে।


আকবরের সময়ের বন্দোবস্ত

মোগল আমলের ভূমি ব্যবস্থায় বর্তমান বরিশাল বিভাগ এবং তদসঙ্গে আরো সংযুক্ত ভূমি ৩টি সরকারে বিভক্ত ছিল। পশ্চিমাংশের নাম ছিল সরকার ফতেহাবাদ। মধ্য ও দক্ষিণ ভাগের নাম ছিল সরকার বাকলা। উত্তরাংশে সেলিমাবাদ পরগণা সরকার খলিফাতাবাদের অধীন ছিল।

সরকার বাকলার অধীনে ৪টি পরগণা ছিল। ১. বাকলা-ইসলামপুর পরগণা যার রাজস্ব ছিল ১,০৮,৬৯৯ টাকা। ২. শ্রীরামপুর পরগণা যার রাজস্ব ছিল ৬৩০০ টাকা। ৩. ইদিলপুর পরগণা যার রাজস্ব ছিল ৩৮,৮৩৫ টাকা। এবং ৪. শাহাবাজপুর পরগণা যার রাজস্ব ছিল ২৬৫২০ টাকা। বাকলার খাসভূমির মোট রাজস্ব ছিল-১,৭৬,৩৫১ টাকা। সরকার ফতেহাবাদ ও সরকার ফতেহাবাদে আরো দুটি পরগণাসহ আকবরের আমলে বাকলা-চন্দ্রদ্বীপে মোট ৬টি পরগণা ছিল।

শাহ সুজার আমলে বন্দোবস্ত

শাহ সুজার আমলে ১৬৫৮ সালে দ্বিতীয় ভূমি বন্দোবস্ত করা হয় এবং বাকলায় সরকার মুরাদখানা এবং পরগণা আকলা (গোচারণ ভূমি) ও পরগণা বানজার (বনভূমি) সৃষ্টি করা হয়।


মোগল আমলের শেষ বন্দোবস্ত

মুর্শিদ কুলি খাঁর আমলে ১৭২২ সালে ও নবাব সুজাউদ্দৌলার আমলে ১৭২৮ সালে তৃতীয় ভূমি সংস্কার করা হয়। ১৭২৮ সালে বাকলা-চন্দ্রদ্বীপে ৪টি সরকার, ১৭টি পরগণা, ৫৯টি মহল ও ২৭ জন জমিদার ছিল। ১৭২৮ সালে ভূমি রাজস্ব ছিল ২,৯০,১১১ টাকা।১


১৭২৮ সালে ভূমি বন্দোবস্ত

১৭২৮ সালে ভূমি বন্দোবস্ত অনুযায়ী বাকলা-চন্দ্রদ্বীপে মোট চারটি সরকার সৃষ্টি হয়। চারটি সরকারে তখন মোট ১৯টি পরগণা ছিল। ১। সরকার বাকলার পরগণাসমূহ: ১. ইদিলপুর (রাজস্ব ৪৭৭০৪ টাকা), ২. ইদ্রাকপুর (রাজস্ব ১০৮০৭ টাকা), ৩. বীরমোহন (রাজস্ব ৫২৮৮ টাকা), ৪. বাংড়োরা (রাজস্ব ১১০৪৪ টাকা), ৪. চন্দ্রদ্বীপ (রাজস্ব ৬৬০৮ টাকা), ৫. জাহাপুর (রাজস্ব ৬৭১ টাকা), ৬. মইজরদী (রাজস্ব ৬২৫৭ টাকা), ৭. নাজিরপুর (রাজস্ব ৬৮৯ টাকা), ৮. রামনগর (রাজস্ব ১০৯৫ টাকা), ৯. শ্রীরামপুর (রাজস্ব ৮৬০৫ টাকা), ১০. সুলতানাবাদ (রাজস্ব ৩৬৩ টাকা), ও ১১. শায়েস্তানগর (রাজস্ব ৩৯৫৬ টাকা)। মোট রাজস্ব ১,৩২,০৪৮ টাকা

২। সরকার বাজুয়ার পরগণাসমূহ: ১. বুজুর্গ উমেদপুর (রাজস্ব ৮৬৮৯ টাকা), ২. খাঞ্জাবাহাদুর নগর (রাজস্ব ৯ টাকা), ৩. জাফরাবাদ (রাজস্ব ৪০ টাকা), ৪. রফিনগর (রাজস্ব ১২৫ টাকা), ৫. শায়েস্তাবাদ (রাজস্ব ৭২৬ টাকা)। মোট রাজস্ব ৯৫৮৯ টাকা।

৩। সরকার ফতেহাবাদের পরগণাসমূহ: ১. উত্তর শাহবাজপুর (রাজস্ব ৭০৩০ টাকা), ২. দক্ষিণ শাহবাজপুর (রাজস্ব ৩৪৩২ টাকা)।

৪। সরকার খলিফাতাবাদের পরগণাসমূহ: ১. সেলিমাবাদ (রাজস্ব ৪৩১৬৬ টাকা)

১৭২৮ খ্রিস্টাব্দের পর আরও যে পরগণাসমূহ সৃষ্টি হয় সেগুলো হলো ১. গিরদেবন্দর, ২.তপ্পে সেলিমাবাদ, ৩. রতনদী-কালিকাপুর, ৪. আলিনগর, ৫. আবদুলপুর, ৬. আজিমপুর, ৭. হাবিবপুর ও ৮. আওরঙ্গপুর।

পরগণার কর বহির্ভুত ভূমি

তৎকালীন বাকলা-চন্দ্রদ্বীপের উক্ত চারটি সরকারের অধীন শাহবাজপুর ও সেলিমাবাদের নিমক মহল ভূমি রাজস্ব ব্যতীত অনেক নওয়ারা, হিস্যাজাত, লাখেরাজ ও নিষ্কর ভূমি ছিল। চন্দ্রদ্বীপ রাজা ১৬১২ সাল হতে মোগল স¤্রাটের পক্ষে মগ-পর্তুগীজদের দমনের জন্য নৌকা, নাবিক সরবরাহ ও সেনাবাহিনী রক্ষণাবেক্ষণ করতেন। স¤্রাট নৌবাহিনীর ব্যয়ভার বহনের জন্য চন্দ্রদ্বীপ রাজাকে নওয়ারা ভূমি প্রদান করেন। রাজা নিজেও নৌবাহিনী নিয়ে মোগল বাহিনীর সাথে মগদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতেন এবং এ জন্য স¤্রাট তাকে হিস্যাজাত ভূমি প্রদান করেন। রাজাকে নওয়ারা ও হিস্যাজাত ভূমির জন্য কর দিতে হতো না। হাবেলী সেলিমাবাদ পরগণার জমিদার পোনাবালিলয়ার চৌধুরীরা হিস্যাজাত ভূমি ভোগ করতেন। তারা স¤্রাটের পক্ষে সৈন্য নিয়ে মগ ও মারাঠাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন।

বাকেরগঞ্জ-পটুয়াখালী জেলায় ১১৪৩টি লাখেরাজ সম্পত্তি ছিল। দরগা, মসজিদ, মন্দির, দুর্গ প্রভৃতির সংরক্ষণের জন্য খাদেম, সেবায়েত ও কর্মচারীরা লাখেরাজ সম্পত্তি ভোগ করতেন। পীর, আউলিয়া ব্রাহম্ণ, মোগল ও নবাবের কর্মচারীরা নিষ্কর ভূমি লাভ করেন। কসবার দুধকুমার, দাউদ শাহ, চেরাগ আলম প্রমুখ আউলিযার মাজারে বাতি দেয়া ও সংরক্ষণের জন্য মোগল স¤্রাট লাখেরাজ সম্পত্তি প্রদান করেন।


পরগণার জমিদারগণ

আকবরের সময় বরিশাল বিভাগে মাত্র ৬টি পরগণা ছিল এবং নবাব সিরাজউদ্দৌলার সময় ২৮টি পরগণা ছিল। সব পরগণা চন্দ্রদ্বীপ রাজ্য থেকে সৃষ্ট। চন্দ্রদ্বীপ পরগণা মাধবপাশার রাজার অধীনে ছিল। চন্দ্রদ্বীপের পরে সেলিমাবাদ দ্বিতীয় বৃহত্তম পরগণা। রায়েরকাঠির রায়েরা এ পরগণার জমিদার ছিলেন। ইদিলপুর বা আদিলপুর একটি প্রাচীন পরগণা। এ পরগণার জমিদার ছিলেন ইদিলপুরের চৌধুরী বংশ। উত্তর শাহবাজপুরের জমিদার ছিলেন চাঁদ রায় ও তার বংশধররা। ভূষণ উল্লা ও বিজলী নারায়ণ দক্ষিণ শাহবাজপুরের প্রথম জমিদার। তাদের পরে শ্রীপুরের জমদিার আবু সাইেেদর স্ত্রী সারতাজ বিবি এ পরগণার মালিক হন। সৈয়দ আবদুল্লাহ চৌধুরী ও বরিশালের খানমবাড়ির মেহেরুন্নেসা সুলতানাবাদ পরগণার ভূস্বামী ছিলেন। জাহাপুর ও আজিমপুরের জমিদার ছিলেন মুলাদীর ইচরি ও তেরচরের দত্ত ও চৌধুরীরা। চৌধুরীদের পূর্বপুরুষ ভগবান দাশ দিল্লী থেকে চন্দ্রদ্বীপে আসেন। তার পুত্র রামেশ্বর দত্ত চন্দ্রদ্বীপ রাজার সেনাপতি ছিলেন। শায়েস্তাবাদের মীর আসাদ আলী শায়েস্তাবাদ পরগণা, গৈলার দাশেরা বাঙ্গড়োরা, রতেœশ্বর রায় রতনদী কালিকাপুর ও পোনাবালিয়ার চৌধুরী বংশ তপ্পে সেলিমাবাদ পরগণার জমিদার ছিলেন।


পরগণার নামকরণ

স¤্রাট জাহাঙ্গীরের নাজির উলফত গাজীর নামে নাজিরপুর, সুজাউদ্দিনের সেনাপতি মীর হাবিবের নামে হাবিবপুর, শায়েস্তাখানের পুত্র বুজুর্গ উমেদ খাঁর নামে বুজুর্গ উমেদপুর, রাজা বল্লভের কর্মচারী রামনারায়ণের পুত্রের নামে রামনগর পরগণা সৃষ্টি হয়। আওরঙ্গজেবের নামে আওরঙ্গপুর ও তার পৌত্র আজিম শাহের নামে আজিমপুর ও দরবেশ মাহমুদ ইদ্রাকের নামে ইদ্রাকপুর পরগণা সৃষ্টি হয়।

মোগল আমলের এই ভূমি ব্যবস্থা ইংরেজ আমলে প্রশাসনিক সংস্কারের সাথে ধীরে ধীরে ভিন্নরূপ পরিগ্রহ করে।



তথ্যসূত্র: ১। সিরাজ উদ্দীন আহমেদ। বরিশাল বিভাগের ইতিহাস (দ্বিতীয় খণ্ড)। ভাস্কর প্রকাশনী, ঢাকা। ২০১৫