বরিশালের প্রলয়ঙ্করী ঝড়সমূহ

Barisalpedia থেকে

বরিশালের আর এক নাম ঝড়ের দেশ। প্রাচীনকাল হতে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছাসে বরিশাল বারবার ক্ষত্রিগস্ত হয়েছে। ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের ঝড়ে বাংলার ২ লক্ষ লোক নিহত হয়। ১৮৩৭ খৃৃস্টাব্দে ঝড়ে বরিশালের দক্ষিণাঞ্চল জনশূন্য হয়ে পড়ে। ১৭৬২ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে ঝড়-বৃষ্টিসহ ভূমিকম্প হয়েছিল।


১৭৮৭ খ্রিস্টাব্দের ঝড় ও প্লাবন

১৭৮৭ খ্রিস্টাব্দের ঝড় ও প্লাবন বরিশালের ইতিহাসে এক করুণ অধ্যায়। ১৭৮৭ খ্রিস্টাব্দের প্লাবনের ফলে আড়িয়াল খাঁ নদী থেকে প্রবাহিত একটি খাল এক রাতে মেঘনার সাথে মিলিত হয়ে নয়াভাঙ্গানী সৃষ্টি করে। নয়া ভাঙ্গানীকে হরিনাথপুর নদীও বলা হয়। ১৭৮৭ খৃৃস্টাব্দে প্লাবনে বাকেরগঞ্জের সমস্ত ফসল নষ্ট হয়ে যায় এব শুরু হয় স্মরণকালের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। ঢাকার কালেক্টর ১৭৯০ খ্রিস্টাব্দের ৬ এপ্রিল রাজস্ব বোর্ডের নিকট লিখিত এক পত্রে এ দুর্ভিক্ষের এক বিবরণ দিয়েছে।১২ “স্মরণাতীতকালের সবচেয়ে ভয়াবহ দুর্যোগ যা এ জেলার উপর দিয়ে বয়ে যায়, তাতে ৬০ হাজারের উর্ধে (মিঃ ডেরহিসেবে) ঘরবাড়ি ধ্বংস হয় বা বাধ্য হয়ে কোন রকমে বেঁচে থাকার জন্য মানুষেরা ঘরবাড়ি ছেড়ে চলে যায়। ১৭৯৭ খ্রিস্টাব্দের ৯ ফেব্রুয়ারির এক পত্রে ঢাকার কালেকটর আর্মষ্ট্রং বাকেরগঞ্জ জেলার ইদিলপুর পরগণায় প্লেগ রোগের উল্লেখ করেছেন। প্লেগ রোগে এ পরগণায় ৪০০ হতে ৫০০ লোক প্রাণ হারায়। একমাত্র ইদিলপুরের সর্বেশ্বর পাল নামে এক ব্যবসায়ীর পরিবারে ১১ দিনের মধ্যে ১৭ জন প্রাণ হারায়।


১৮২২ খ্রিস্টাব্দের ৬ জুনের ঝড়

কোম্পানি আমলে বাকেরগঞ্জ জেলার সবচেয়ে স্মরনীয় ঘটনা ১৮২২ খ্রিস্টাব্দের ৬ জুনের ঝড় যা আজও ১২২৯ সনের বন্যা বলে পরিচিত। এ বন্যার সময় মি. কার্ডডিউ বাকেরগঞ্জের ভারপ্রাপ্ত কালেক্টর ছিলেন। তিনি ১৮২২ খ্রিস্টাব্দের ৯ জুন রাজস্ব বোর্ডের নিকট এক প্রতিবেদনে ঝড়ের হৃদয়বিদারক বর্ণনা দিয়েছেন। ‘যে ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস সমগ্র জেলাকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে দুর্যোগময় পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে সে সম্পর্কে বোর্ডকে জ্ঞান করা আমাদর দুঃখজনক কর্তব্য। এ অফিস কয়েক ফুট পানির নিচে ছিল।’

১৮ই জুলাই একটি বাংলা প্রতিবেদনে ক্ষয়ক্ষতির পূর্ণ বিবরণ লেখা হয়। ২০,১২৫ জন পুরুষ এবং ১৯,৮১৫ জন মহিলাসহ মোট ৩৯,৯৪০ জন জলোচ্ছাসে মৃত্যুবরণ করেছে। একমাত্র খলসাখালী বা গলাচিপা থানায় ২২,৪২২ জন এবং বাউফল থানায় ১০, ৯৮৪ জন নিহত হয়েছে। এ মৃত্যুর সংখ্যা ৩৯,৯৪০ জনের মধ্যে গননা করা হয়নি। এ ঝড়ে ৮৮,৪৩৪টি গবাদিপশু এবং ১৩,২৬,৬৯১ টাকার সম্পত্তি নষ্ট হয়। বাউফল থানার দারোগা ১৮২২ খ্রিস্টাব্দের ৯ জুলাই এ ঝড়ের বর্ণনাদিয়ে এক পত্রে লেখেন। পত্রে দেখা যায় ৬ জুন দুপুরে ঝড় আরম্ভ হয় এবং রাত ৯টায় ঝড় এত তীব্র আকার ধারণ করে যে, মানুষ, গরু এবং অনান্য সম্পদ ভাসিয়ে নিয়ে যায়। দারোগার প্রাথমিক হিসেবে বাউফলে ১০,৯৮৪ ব্যক্তি ও ৯৭০০ গবাদিপশু নিহত হয়। চান্দিয়া বা দক্ষিণ শাহবাজপুর, খলসাখালী, বাউফল, বুকাইনগর ও মেহেন্দীগঞ্জ ঝড়ে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ঝড়ের পর চালের মূল্য বৃদ্ধি পায় এবং টাকায় ১০ সের চাল বিক্রি হয়।

এশিয়াটিক জার্নাল, ক্যালকাটা জার্নাল এবং সানডেম্যান সিলেকশনে ১৮২২ খৃৃস্টাব্দে ঝড়ের বিবরণ প্রকাশ করেছে। এশিয়াটিক জার্নালের মতে, এ ঝড়ে এক লক্ষ লোক মারা যায়। ১৮২২ খ্রিস্টাব্দের ১৯ ও ২২ জুন কলকাতা টাউন হলে বাকেরগঞ্জের বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্যের জন্য সভা হয়েছিল এবং ১৮৪৩৩ টাকা চাঁদা উঠেছিল। মেজর ষ্টুয়ার্ট বাকেরগঞ্জে এসেছিলেন এবং ত্রাণ বিতরণ করে প্রশংসা কুড়িয়েছিলেন। ২৯ জুন ১৮২২, ১৬ আষাঢ় ১২২৯-সমাচার দর্পণে প্রকাশিত সংবাদ- “দয়া প্রকাশ শ্রীযুক্ত নবাব গভর্নর জনরল বাহাদুর বরিশাল জেলার (জল-প্লাবনের ফলে) দুরবস্থাপন্ন লোকদের নিমিত্ত কৃপাকৃষ হইয়া মোকাম কলিকাতা হইতে সাত হাজার বস্তা তণ্ডুল ও তৈল, লবণ, ডাল, ঘৃত, লঙ্কা, মরিচ ইত্যাদি পাঠাইয়াছেন।”

কতিপয় ক্ষুদ্র ঝড়

১৮২২ খ্রিস্টাব্দের ঝড়ের পর ১৮২৫, ১৮৩১, ১৮৫৫, ১৮৬৪, ১৮৬৭, ১৮৬৯ ও ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দের ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ¡াস বাকেরগঞ্জ জেলার ওপর দিয়ে বয়ে যায়। ১৮৬৭ ও ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দের ঝড়ে জেলার দক্ষিণ অঞ্চল ও ভোলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দের ঝড়ে বরিশাল ষ্টেশন রোড ভেঙ্গে যায়। অগণিত গবাদিপশু জলমগ্ন হয়ে মারা যায় এবং আউশ ধানে ক্ষতি হয়। জলোচ্ছ¡াসে দক্ষিণ শাহবাজপুর বা ভোলার সকল পানীয় জল লবণাক্ত হয়ে যায়। ফলে সংক্রামক রোগ দেখা দেয় এবং ভোলা মহকুমার এক-দশমাংশ লোক প্রাণ হারায়।


১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দের ঝড় (বাংলা ১২৮৩)

১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দের ৩১ অক্টোবর, বাংলা ১২৮৩ সনের ১৬ কার্তিক মঙ্গলবার বাকেরগঞ্জ জেলার ওপর দিয়ে যে ঘূর্ণিঝড় বয়ে যায় তা উনিশ শতকের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ঝড় ছিল। বিশ্বের ইতিহাসে এটি ষষ্ঠ মহাপ্রলয়ঙ্করী ঝড় হিসেবে পরিচিত। এ ঝড়ে শুধু বরিশাল অঞ্চলেই লক্ষাধিক লোক প্রাণ হারায় এবং দৌলত খাঁ মহকুমা শহর সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়।

সন্ধ্যায় ঝড়ো হাওয়া ছিল। অস্বাভাবিক গরম ছিল। কিন্তু লোকজন কিছু হবে না মনে করে ঘুমিয়ে যায়। রাত ১১টায় পানি বৃৃদ্ধি পায় এবং মধ্যরাতে চীৎকার শোনা গেল, পানিতে ডুবে যাচ্ছি এবং কয়েক ফুট উঁচু একটি ঢেউ সারা অঞ্চলের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। তারপর আর একটি ঢেউ এবং পরে তৃতীয় ঢেউ এলো। তিনটি ঢেউ সামনে প্রবল বেগে ছুটে চলে। বাতাস ছিল খুব তীব্র এবং ঠাÐা। জনগণ হঠাৎ জলোচ্ছ¡াসে পতিত হয়। এমনকি তারা ঘরের ছাদে ওঠার সময় পায়নি এবং তাদের ঘরবাড়ি জলোচ্ছ¡াসে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। কিন্তু বাড়িগুলো তাল জাতীয় গাছ, বাঁশ ও অন্যান্য কাটা গাছ দ্বারা আবৃত ছিল। তারপর প্লাবনের পানি লোকদের গাছপালার উপরে নিয়ে যায়। যারা গাছের ডাল ধরে ছিল তারা বেঁচে যায় এবং যারা পারেনি তারা ভেসে যায় এবং হারিয়ে যায়। মৃতদেহগুলো এত দূরে নিয়ে যায় যে, তাদের খুঁজে বের করা যায়নি। মাঠের পানি শুকিয়ে যাবার পূর্বে মৃতদেহগুলো পচন ধরে। সর্বত্র অসংখ্যা মৃতদেহ মাটি না দেয়া অবস্থায় ছড়িয়ে চিল। আবহাওয়া সমুদ্রকে আন্দোলিত করেছিল। বঙ্গোপসাগর হতে আগত লোকেরা ঢেউয়ের সাথে অনেক মৃতদেহ ভাসতে দেখেছিল। চট্টগ্রামে সমুদ্র উপক‚লে অনেক মৃতদেহ দেখা যায় এবং ভেলার মতো ঘরের ছাদ বা খুঁটিতে ধরা অনেক লোক বাসিয়ে সেখানে নিয়ে যায়। ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট, পুলিশ ইনপেক্টর, মন্সেফ, উকিল প্রমুখ স্থানীয় কর্মচারী ডুবে মারা যায়।

সুন্দরবনের রাজস্ব ইতিহাস লেখক এসকলি ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দের ঝড়ের বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, গলাচিপা থানার এক-পঞ্চামাংশ লোক নিহত হয়। করাইবাড়িয়া, পচাকোরালিয়া, বগী ও খেপুপাড়ার অনেক গ্রাম জনশূন্য হয়ে পড়ে এবং আবাদ বন্ধ হয়ে যায়। তিনি উঁচু পাড়ের পুকুর খনন করার প্রস্তাব দেন। জে ইলিয়ট বলেছেন এ ঝড়ে ১০ থেকে ৪৫ ফুট পানি হয়েছিল। দক্ষিণ শাহবাজপুর, মনপুরা, ছোট বাইসদা, বড় বাইসদা, বাউফল, গলাচিপা, মেহেন্দিগঞ্জ ও বাকেররগঞ্জ ঝড়ে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ ঝড়ে বরিশালে ১২০০০০ এবং নোয়াখালী জেলায় এক লক্ষ লোক মারা যায়।




তথ্যসূত্র: ১। সিরাজ উদ্দীন আহমেদ। বরিশাল বিভাগের ইতিহাস (১ম খন্ড)। ভাস্কর প্রকাশনী, ঢাকা। ২০১০।