বরিশালের পুরাকীর্তিসমূহ
প্রাগৈতিহাসিককালের কোন নিদর্শন বরিশালে তথা বাকলা-চন্দ্রদ্বীপে পাওয়া যায়নি। চতুর্থ শতক হতে এ অঞ্চলে প্রাচীন কীর্তির সন্ধান পাওয়া যায়। প্রাপ্তকীর্তগুলোর মধ্যে দেব-দেবীর মূর্তি, দীঘি, দুর্গ, তাম্রলিপি, মুদ্রা প্রভৃতি প্রধান।
চতুর্থ থেকে নবম শতক
দুর্গ ও মুদ্রা- প্রাচীন চন্দ্রদ্বীপের সামুদ্রিক বন্দর ও শাসন কেন্দ্র নাব্যাবকাশিকায় চতুর্থ শতকে রাজা চন্দ্রবর্মা চন্দ্রদ্বীপ জয় করে একটি বিরাট দুর্গ বা কোট নির্মাণ করেন। কোটালীপাড়ায় অবস্থিত মাটি নির্মিত এই দুর্গটি চন্দ্রদ্বীপের প্রাচীনতম কীর্তি। মাটির দুর্গটি ১৫ থেকে ৩০ ফুট উঁচু এবং ২ মাইল লম্বা। চন্দ্রবর্মা দুর্গটি আনুমানিক ৩১৫ খ্রিস্টাব্দে নির্মাণ করেন। ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে ভূমি জরিপের সময় কোটালীপাড়ায় ৫ম শতকের গুপ্ত রাজা দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত ও স্কন্দ গুপ্তের স্বর্ণমুদ্রা পাওয়া যায়। ষষ্ঠ শতকের রাজা শ্রী গোপচন্দ্র, ধর্মাদিত্য ও সমাচার দেবের পাঁচখানি তাম্রলিপি কোটালীপাড়ায় পাওয়া যায়। তাম্রলিপিগুলোর মধ্যে ঘুঘ্রাহাটি বা ঘাঘরকাটি তাম্রশাসন তাৎপর্যপূর্ণ।
শিকারপুরের তারামূর্তি- বরিশাল বিভাগে প্রাপ্ত মূর্তির মধ্যে শিকারপুরের তারামূর্তি ভারত বিখ্যাত। কথিত আছে তারার নাসিকা সুগন্ধা নদীতে পতিত হয় তখন থেকে শিকারপুর তীর্থস্থানে পরিণত হয়। দেবীর সেবায়েতদের হস্তলিখিত প্রাচীন পুঁথিতে দেখা যায়- শ্রী গঙ্গাগতি চক্রবর্তী ৬১৭ শকাব্দ ইংরেজী ৬৯৫ খ্রিঃ স্বপ্নে সুগন্ধা নদীতটে পাষাণময়ী তারামূর্তি ও স্বয়¤ভূ শিবলিঙ্গ প্রাপ্ত হন। গঙ্গাগতি চক্রবর্তী সুগন্ধার তীরে তারা ও শিবলিঙ্গ স্থাপন করে অর্চনার ব্যবস্থা করেন। অধ্যাপক ফুচার ১১ শতকের একটি পান্ডুলিপিতে চন্দ্রদ্বীপের তারা মূর্তির উল্লেখ দেখেছেন। শিকারপুরে প্রাপ্ত ১০১৫ খ্রি¯টাব্দের একখানা তালপাতার পুঁথিতে তারামূর্তি অঙ্কিত আছে। ১৮৮৪ খ্রিঃ আটিপাড়া গ্রামের একদল মুসলমান এই মূর্তিটি ভেঙ্গে ফেলে দেয়। পরে আর একটি কালীমূর্তি শিকারপুর মন্দিরে স্থাপন করা হয়। সে মূর্তিটিও ১৯৭১ খ্রিঃ স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় পাকবাহিনী ভেঙ্গে ফেলে। বর্তমানে আর একটি মূর্তি স্থাপন করে অর্চনা চলছে। তারা মূর্তির সাথে প্রাপ্ত শিবলিঙ্গ তারা মন্দিরে এখনও রক্ষিত আছে। শত শত বছর ধরে শিকারপুরে তারাবাড়িতে মেলা বসছে। পূবে ভারতে বিভিন্ন স্থান হতে ভক্তদের সমাগম হতো। শিকারপুরের ধ্বংসপ্রাপ্ত তারামূর্তি ৭ম শতকে স্থাপন করা হয়েছে বলে সেবায়েতরা দাবি করে। কিন্তু ঐতিহাসিকদের মতে, তারা মূর্তিটি পাল রাজত্বে প্রথম যুগের। মূর্তির চার হস্তে খড়গ, তরবারি, নীলোৎপল ও নরমুন্ড। শবের উপর দন্ডায়মান দেবীমূর্তির উপরিভাগে ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব, কার্তিক ও গণেশের মূতি উৎকীর্ণ। দেবী মূর্তির উপরিভাগে ছোট আকারে খোদিত পাঁচ দেবতার মূতি ভাস্কর্যের চরম অভিব্যক্তি প্রকাশ করে এবং বৌদ্ধধর্মের মহাযানপন্থী পঞ্চধ্যানী বুদ্ধের সন্নিবেশ স্মরণ করিয়ে দেয়।
লক্ষ্মণকাঠির বিষ্ণুমূর্তি- চন্দ্রদ্বীপে প্রাপ্ত প্রাচীন মূর্তিগুলোর মধ্যে গৌরনদী থানায় লক্ষ্মণকাঠির বিষ্ণুমূর্তিটি বাংলার ভাস্কর্য শিল্পের শ্রেষ্ঠতম নিদর্শন। ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দের ১৭ চৈত্র মঙ্গলবার গৌরনদীর আটক গ্রামে পুকুর খনন করার সময় মহাবিষ্ণুর চতুর্ভুজ প্রকান্ড মূর্তিটি পাওয়া যায়। খুব সম্ভব রাজনৈতিক ও প্রাকৃতিক কারণে মূর্তিটি কয়েকশ’ বছর পূর্বে পুকুরের মাটির নিচে প্রেথিত হয়। প্রকান্ড এ মূর্তিটি ধূসর বর্ণেও কৃষ্ণ পাথরের ওপর সুন্দরভাবে খোদিত। কৃষ্ণ পাথরের এ বিষ্ণু মূর্তিটি ৬ ফুট ৪ ইঞ্চি উচ্চ। উর্ধে উড্ডীয়মান ত্রিনেত্র গরুড়ের পাখার ওপর বিষ্ণু ললিতাসনে উপবিষ্ট। বিষ্ণুর উর্ধ দক্ষিণ ও বাম হস্তে ধৃত পদ্মানালের ওপর যথাক্রমে লক্ষ্মী (গজলক্ষ্মী) ও বিনাবাদিনী বাণীমূর্তি। অন্য দু’হস্তে চক্র পুরুষসহ চক্র ও গদাদেবী। মস্তকের ষটকোণে কিরীটির মধ্যস্থলে ধ্যানস্থ চতুর্ভুজ দেবমূর্তি। হস্তোপরি লক্ষ্মী ও সরস্বতী (শ্রী ও পুষ্টি) এবং কিরীটস্থ ধ্যানী দেবমূর্তি- এ দু’টি আলোচ্য মূর্তিও বিশেষত্ব। বিষ্ণু মূর্তিতে এগুলো দেখা যায় না। সম্ভবত এটা বৌদ্ধ মহাযান মতের প্রভাব সূচিত করে। ঐতিহাসিক এন. কে. ভট্টশালী মূর্তিটিকে গুপ্ত যুগের বলে দাবি করেন। কিন্তু বৌদ্ধ মহাযান মতের প্রভাব প্রমাণ করে মূর্তিটি পাল আমলের প্রথম যুগের- অষ্টম শতকের। ডঃ নীহারবঞ্জন রায় তার বাংলার ইতিহাসে এ মূর্তি সম্পর্কে বলেছেন, “বরিশাল জেলার লক্ষ্মণকাঠির সুপ্রসিদ্ধ বিষ্ণু প্রতিমার পশ্চাতে হাসের ওপর আসীন শ্রী ও পুষ্টির প্রতিকৃতি এবং মুুকুটে চতুর্হস্ত ধ্যানী বুদ্ধপ্রতিম প্রতিমাটি মুর্তিতত্ত্বের দিক হতে উল্লেখযোগ্য। উভয় লক্ষ্মণেই মহাযান বৌদ্ধ প্রতিমার রূপ কল্পনা নিঃসন্দেহে সক্রিয়।”
পোনাবালিয়ার শিবলিঙ্গ- শিকারপুরের উগ্রতারার মতো ঝালকাঠী থানার পোনাবালিয়াস্থ শ্যামরাইলের শিবলিঙ্গ ভারত বিখ্যাত। প্রাচীন সুগন্ধা নদীর উত্তর তীরে শিকারপুর এবং দক্ষিণ তীরে পোনাবালিয়া। সুগন্ধা নদীতে তারা দেবীর নাসিকা নিমজ্জিত হয় এবং সে জন্য নদীর উভয় তীরে একান্নতম পীঠস্থান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পোনাবালিয়ার জমিদার শ্রীরাম ১৮ শতকের প্রথমভাগে স্বপ্নে শ্যামরাইলের শিবলিঙ্গ প্রাপ্ত হন। কথিত আছে পোনাবালিয়ার একদল বালক জঙ্গলের নিকট গাভী চরাতো। গৃহস্বামীরা গাভী দোহন করার সময় দুধ পেত না এবং তাই রাখাল বালকদের দোষারোপ করে। বালকরা অনুসন্ধান করে দেখতে পেল গাভীগুলো গভীর জঙ্গলে একটি বৃক্ষমূলে দাঁড়িয়ে আছে এবং দুধ পড়ছে। বালকেরা ঐ স্থানে আগুন লাগিয়ে দিলে একটি কালো মূর্তি নিকটস্থ পুকুরে লাফিয়ে পড়ে। শ্রীরাম রাতে স্বপ্নে দেখলেন দেবী কষ্টে আছেন। দেবী তাকে উদ্ধার করার নির্দেশ দেন। শ্রীরাম জঙ্গল পরিষ্কার করে বৃক্ষমূলে মাটির নিচে পাষাণময় শিবলিঙ্গ দেখতে পান। তিনি কয়েকটি হাতির সাহায্যে শিবলিঙ্গ তোলার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। পুনরায় স্বপ্নে দেবী শ্রীরামকে শিবলিঙ্গ স্থানান্তরিত না করে মন্দির নির্মাণ করে পূজার আয়োজন করতে বলেন। শ্রীরাম মন্দির নির্মাণ করেন। সেখানে পূজার বন্দোবস্ত এখনও আছে। বর্তমান মন্দিরটি পরে নির্মিত হয়েছে। বৃহৎ আকারের পাষাণ নির্মিত এই শিবলিঙ্গটি নবম শতকের বলে ধারণা করা হয়। কি করে এ মূর্তি জঙ্গলে প্রোথিত অবস্থায় পাওয়া যায় তা সত্যিই বিস্ময়কর। খুব সম্ভব পাল আমলে শিবলিঙ্গ পোনাবালিয়ায় পূজিত হতো। সেন রাজত্বের শেষভাগে প্লাবনে চন্দ্রদ্বীপের এ অঞ্চল জলশূন্য হয়ে পড়ে এবং শিবলিঙ্গ মাটির নিচে চাপা পড়ে যায়।
সূর্যমণির সূর্যমূতি- সূর্যমণির সূর্যমূর্তিটি নবম শতকের। বানারীপাড়া থানার বেতাল গ্রামে সূর্যমণি অবস্থিত। সূর্যমূর্তিটি তিন ফুট উঁচু। কষ্টি পাথরের সূর্যমূর্তির সাথে স্ত্রীছায়া, পুত্র শনি ও কন্যা সংজ্ঞার মূর্তি আছে। সূর্যের সাথে নারায়ণের মূর্তিও আছে। বেতাল গ্রামের সরকারদের পূর্বপুরুষ হালচাষ করার সময় মূর্তিটি মাটির নিচে পায়। খুব সম্ভব মূর্তিটি পূর্বে বাউফল থানার সূর্যমণি গ্রামে ছিল। কন্দর্প নারায়ণ বাকলা থেকে রাজধানী স্থানান্তরিত করার সময় সেবায়েতগণ মূর্তিটি বানারীপাড়ায় নিয়ে আসে। পরে প্রাকৃতিক বা রাজনৈতিক কারণে মূর্তিটি মাটির নিচে চাপা পড়ে যায়। সূর্য মূর্তিটিকে কেন্দ্র করে বেতাল গ্রামে প্রত্যেক বছর তিন দিনব্যাপী বিরাট মেলা বসে। এ মেলা সূর্যমণির মেলা নামে পরিচিত। ১৯৭১ খ্রিঃ মূর্তিটি চুরি হয়ে যায়। ১৯৭৭ খ্রিঃ পুলিশ মূর্তিটি চোরাকারবারীদের নিকট থেকে উদ্ধার করে। বর্তমানে মূর্তিটি ঢাকা জাদুঘরে আছে।
দশম থেকে চতুর্দশ শতক
তাম্রশাসন- দশম শতকের রাজা শ্রীচন্দ্রের পাঁচখানা তাম্রশাসনের মধ্যে তিনখানা প্রাচীন চন্দ্রদ্বীপে পাওয়া যায়। এগুলো হলো ধূলিয়া, কেদারপুর ও ইদিলপুর তাম্রশাসন। ধূলিয়া ও কেদারপুর বর্তমানে ফরিদপুর জেলার অধীনে। পূর্বে ধূলিয়া ও কেদারপুর চন্দ্রদ্বীপের অন্তর্গত ছিল। শ্রীচন্দ্রের বিক্রমপুর তাম্রলিপিতে চন্দ্রদ্বীপ ও বাঙ্গাল নামের উল্লেখ আছে। উজিরপুর থানার শিকারপুর গ্রামে ১০১৫ খ্রিঃ রচিত একখানা তালপাতার পুঁথি পাওয়া যায়। বিশ্বরূপ সেনের তেরো শতকের প্রথম ভাগের একখানা তাম্রশাসন কোটালীপাড়ায় পাওয়া যায়। এ তাম্রশাসনে গৌরনদী থানার রামসিদ্ধি, বাঙ্গালা, ঝালকাঠি থানার নৈকাঠি ও চন্দ্রদ্বীপ নামের উল্লেখ আছে। হিজলা-মুলাদী থানার ইদিলপুরে কেশব সেনের একখানা তাম্রলিপি পাওয়া যায়। তেরো শতকের এ তাম্রশাসনে ব্রাহ্মণকে ভূমিদানের ও চন্দ্রভন্ড্র জাতি শাসন ও মন্দির নির্মাণের কথা আছে।
দীঘি- ফুল্লশ্রী গ্রামে সেন রাজবংশের ৭ জন রাজকুমারের নামে ৭ টি দীঘি আছে। এ দীঘিগুলো সুন্দর পরিকল্পনা অনুযায়ী খনন করা হয়েছিল। নরসিংহের দীঘিতে প্রাচীন টালি ইটের নির্মিত ঘাটলা পাওয়া যায়। এ দীঘিগুলো ভরে গেছে এবং পাড়ে জনবসতি সৃষ্টি হয়েছে। মাহিলারা গ্রামের রুদ্র সেনের বাড়ির দীঘিটি সেন আমলের বলে মনে হয়। দীঘিরপাড়ে রাজা ও হাতীবাড়ি নামে দু’টি স্থান আছে।
কাত্যায়নীর মূর্তি- মাধবপাশা রাজবাড়িতে কাত্যায়নী মূর্তি পূজিত হতো। কাত্যায়িনীকে মহিষমর্দিনী বা দুর্গা বলা হয়। কথিত আছে, চন্দ্রদ্বীপ রাজা দনুজমর্দন সুগন্ধা নদীতে মদন গোপাল ও কাত্যায়নী মূর্তি পায়। মূর্তিটির অষ্ট হস্তের বিবরণ : ১. চক্র, ২. অসূরের বুকে নিক্ষিপ্ত ত্রিশূল, ৩. তূণ থেকে তোলা তীর, ৪. তরবারী, ৫. তর্জনী মুদ্রা, ৬. ঢাল, ৭. ধনুক এবং ৮. অসূরের চুল। কাত্যায়নী মূর্তিটি দশ অথবা এগারো শতকে নির্মিত বলে মনে হয়।
কাশীপুর গ্রামের চতুর্ভুজ শিবমূর্তি- বরিশাল শহরের নিকটবর্তী কাশীপুর গ্রামের চতুর্ভুজ শিবমূর্তিটি পাল আমলের। এই মূর্তিটিকে বিরূপাক্ষ বা নীলকণ্ঠ বলা হয়। সারদাতিলকতন্ত্র অনুসারে নীলকণ্ঠের পাঁচটি মুখ। এ মূর্তির মুখ মাত্র একটি। শিব মূর্তিটির হস্তে অক্ষমালা, ত্রিশূল, খট্টাঙ্গ ও কপল আছে। বর্ণনার অতিরিক্ত এ মূর্তিতে কিরীটি মুখের পরিবর্তে ছত্র প্রভাবলীর দু’পাশে কার্তিক, গণেশের মূর্তি ও নিম্নে দু’পাশে মকরবাহিনী গঙ্গা ও সিংহবাহিনী পার্বতীর মূর্তি প্রভৃতি বিশেষ লক্ষ্য করার বিষয়। মূর্তির আধোভাগে শিবের বাহন নন্দীর মূর্তি। সারদাতিলক তন্ত্রের ওপর নির্ভর করে ঐতিহাসিক এন কে ভট্টাশালী মূর্তিটি নীলকণ্ঠের বলে আখ্যায়িত করেছেন।
গৌরনদীর গরুড় মূর্তি- ১৯৬৮ খ্রিঃ গৌরনদীর নিকটে জঙ্গল হতে চাখার কলেজের একদল ছাত্র ও শিক্ষক একটি গরুড় মূর্তি উদ্ধার করে। বিষ্ণুর বাহন গরুড় মূর্তিটি ১১ শতকের। কৃষ্ণ পাথরের এই মূর্তিটি দুই ফুট উঁচু। মূর্তিটি ঢাকা জাদুঘরে রক্ষিত আছে। উনিশ শতকের শেষভাগে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছাসে চন্দ্রদ্বীপের এক বিরাট অঞ্চল জনশূন্য হয়ে পড়ে। খুব সম্ভব এ সময় মূর্তিটি মাটি চাপা পড়ে। আবার অনেকে মনে করেন মুসলমান সৈন্যদের ভয়ে অনেকে দেব-দেবীর মূর্তি জঙ্গল ও পুকুরে ফেলে দেয়।
রায়েরকাঠি সিদ্ধেশ্বরী মূর্তি- মদন মোহনের প্রপৌত্র রুদ্র নারায়ণ রায়েরকাঠি গ্রাম আবাদ করার সময় কালীদেবী বা সিদ্ধেশ্বরীর একটি মূর্তি পান এবং ১৬৪১ খ্রিঃ তিনি মন্দির নির্মাণ করে মূর্তিটি স্থাপন করেন। রায়েরকাঠি জমিদার বাড়িতে মূর্তিটি এখনও পূজিত হচ্ছে। রুদ্র নারায়ণের পৌত্র শত্রুজিত ঝালকাঠী থানার মঠবাড়ী গ্রামে দীঘি খনন করার সময় শিবমূর্তি প্রাপ্ত হন। মূর্তিটি বর্তমানে কীর্তিপাশার জমিদার বাড়িতে পূজিত হচ্ছে। সূর্যপুত্র-রেবন্তের মূর্তি- বরিশালের চাচৈরপাশা গ্রামে কৃষ্ণ পাথরের সূর্যপুত্র-রেবন্তের মূর্তি পাওয়া যায়। মূর্তিটি বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর রক্ষিত আছে।
মারীচী মূর্তি- ১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দের ১৩ মার্চ মাধবপাশার অন্তর্গত ফুলতলা গ্রামে সিকদার বাড়ির একটি প্রাচীন দীঘি খনন করার সময় দু’টি মারীচী দেবীর মূর্তি পাওয়া যায়। একটি মূর্তির দৈর্ঘ্য সাড়ে ৫০ ইঞ্চি, প্রস্থ সাড়ে ১৯ ইঞ্চি এবং ভেদ দেড় ইঞ্চি। অপরটির দৈর্ঘ্য ৪৯ ইঞ্চি, প্রস্থ সাড়ে ২৫ ইঞ্চি এবং ভেদ দেড় ইঞ্চি। মারীচী দেবীর তিনটি মুখ, একটি মুখ শূকরীর। দেবীর অষ্টহস্তে বজ্র, অস্কুশ, শর, অশোকপত্র, সূচি, ধনু, পাশা ও অন্য হাত তর্জনী মুদ্রা ভঙ্গিমায়। মূর্তির মস্তকে ধ্যানী বুদ্ধ বিরোচনের মূর্তি। সারথি রাহুচালিত সপ্ত শূকরবাহিত রথে প্রত্যালীর ভঙ্গিতে দন্ডায়মান। একটি মূর্তির এক হস্তের অর্ধেক, নাসিকা ও একটি শূকর ভাঙ্গা। উভয় মূর্তির গলায়, হাতে ও কোমরে অলঙ্কার অঙ্কিত আছে। মারীচীর সাথে বরট্টালী, বদালী, বরানী ও বরাহমুখী দেবীর মূর্তি আছে। মহাযান ও বজ্রযান বৌদ্ধ ধর্মের উপাস্য দেবীর সংখ্যা অনেক তন্মধ্যে প্রজ্ঞাপারমিতা, মারীচী, হারীতী প্রধান। এ দেবী বিভিন্ন ধ্যানী বুদ্ধ হতে প্রসূত বিভিন্ন তারা দেবীবিশেষ। মারীচি মূর্তির নির্মাণকাল শেষ পাল যুগ বলে অনুমিত হয়।
কাশীপুরের মহামায়া মূর্তি- কাশীপুর গ্রামে মহামায়া দেবীর মূর্তি আছে। নবাব মুর্শিদ কুলী খাঁর আমলে চন্দ্রদ্বীপের রাজা উদয়নারায়ণ স্বপ্নে মহামায়া দেবীর মূর্তি প্রাপ্ত হন। সৈন্য বাহিনীর জন্য দীঘি খননকালে মূর্তিটি পাওয়া যায়। রাজা উদয়নারায়ণ দীঘির পাড়ে মন্দির নির্মাণ করে মহামায়ার মূর্তি স্থাপন করেন। এখানে প্রত্যেক বছর মেলা বসে।
আগৈলঝাড়ার বিষ্ণুমূর্তি- ১৯৭৯ খ্রিঃ আগৈলঝাড়া থানায় একটি পুরনো দীঘি খননকালে একটি কৃষ্ণপাথরের বিষ্ণুমূর্তি পাওয়া যায়। মূর্তিটি পাল আমলে (দশ থেকে বারো শতক) নির্মিত। আগৈলঝাড়ায় প্রাপ্ত মূর্তিটি আগৈলঝাড়া কলেজের নিকট ভেগাই হালদার মন্দিরে রক্ষিত আছে। কষ্টিপাথরের বিষ্ণু মূর্তিটি চার ফুট লম্বা। চার হস্তবিশিষ্ট বিষ্ণুমূর্তিটি বাংলাদেশের প্রতœতত্ত্ব বিভাগের মূল্যবান সম্পদ। এ প্রকার মূর্তি উপমহাদেশে বিরল। ভাস্কর্য জগতে এ মূর্তিটি অন্যতম সেরা সৃষ্টি। দন্ডায়মান বিষ্ণু মূর্তিকে জীবন্ত মনে হয়। পিছনের ডান হাতে গদা এবং বাম হাতে চক্র। সামনের এক হাতে শঙ্খ এবং আর এক হাতে পদ্মফুল। গলায় বনমালা। মূর্তিও নিচে চক্র পুরুষ ও শঙ্খ পুরুষের ক্ষুদ্র মূর্তি অঙ্কিত আছে।
রঙ্গশ্রীর স্তম্ভ- বাকেরগঞ্জে সেন আমলের দু’টি পাথরের স্তম্ভ আছে। বিশ শতকের প্রথম দিকে বাকেরগঞ্জ থানার রঙ্গশ্রী ইউনিয়নে একটি স্তম্ভ পাওয়া যায়। স্তম্ভটি প্রায় ৪ ফুট লম্বা। বর্তমানে স্তম্ভটি বাকেরগঞ্জের বারআউলিয়ার দরগায় রক্ষিত আছে।
তথ্যসূত্র: ১। সিরাজ উদ্দীন আহমেদ। বরিশাল বিভাগের ইতিহাস (১ম খন্ড)। ভাস্কর প্রকাশনী, ঢাকা। ২০১০।