বঙ্গভঙ্গ রদ আন্দোলনে বরিশাল

Barisalpedia থেকে

লর্ড কার্জন ১৯০৩ খৃৃস্টাব্দে মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষার নামে বাংলাকে বিভক্ত করে পূর্ববঙ্গ-আসাম প্রদেশ গঠন করার প্রস্তাব করেন। কার্জনের এ প্রস্তাব মুসলিম নেতারা স্বাগত জানান কিন্তু কোলকাতাকেন্দ্রিক হিন্দু ভূম্যধিকারীদের কায়েমি স্বার্থের কথা বিবেচনা করে কংগ্রেস বিরোধিতা করে। তখন পর্যন্ত মুসলিম লীগ গঠিত হয়নি বলে রাজনৈতিক মাঠে এই প্রস্তাবের বিরুদ্বে সারা বাংলাদেশে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। বঙ্গভঙ্গ রদ করার এ আন্দোলনে বরিশালের জনগণ ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ করে।


বি এম কলেজের জনসভা

অশ্বিনীকুমার দত্তের নেতৃত্বে বরিশালে জনসাধারণ সভায় বঙ্গব্যবচ্ছেদের প্রতিবাদে সভা অনুষ্ঠিত হয়। ১৯০৪ খৃৃস্টাব্দে হাজার হাজার লোকের স্বাক্ষর সংগ্রহ করে তিনি ইংরেজ সরকারের নিকট প্রেরণ করেন। ১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ জুলাই ব্রজমোহন কলেজ প্রাঙ্গণে এক বিরাট জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। এ সভায় উকিল দীনবন্ধু সেন সভাপতিত্ব করেন এবং বরিশালের জনপ্রিয় নেতা অশ্বিনীকুমার দত্ত ভাষণ দেন। ড. আর সি মজুমদার তখন বিএম কলেজের ছাত্র এবং জনসভায় উপস্থিত ছিলেন।


স্বদেশ বান্ধব সমিতি

বরিশাল শহরে প্রবীণদের নিয়ে নেতৃসংঘ এবং যুবকদের নিয়ে কর্মীসংঘ গঠন করা হয়। ১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দের ৬ আগষ্ট নেতৃসংঘ ও কর্মীসংঘ একত্রিত হয়ে ‘স্বদেশ বান্ধব সমিতি’ গঠন করা হয়। অশ্বিনীকুমার ছিলেন স্বদেশ বান্ধব সমিতির সভাপতি এবং ড. নিশিকান্ত বসু সমিতির প্রচারক ছিলেন। পরে অশ্বিনীকুমার দত্ত দু’জন হিন্দু ও দু’জন মুসলমান প্রচারক নিযুক্ত করেন। সমিতির উদ্দেশ্য ছিল বঙ্গভঙ্গের তীব্র প্রতিবাদ, স্বদেশী আন্দোলন, সরকারী কর্মচারীদের অন্যায় আচরণের প্রতিবাদ, অর্থনৈতিক উন্নয়ন , মাদকদ্রব্য সেবন নিবারণ, স্ত্রীশিক্ষা প্রচলন, সেবকদল গঠন, ব্যায়াম বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, স্বদেশী বস্ত্র তৈরি, গ্রাম্য সালিশী প্রভৃতি গ্রামে গ্রামে স্বদেশ বান্ধব সমিতির শাখা গঠন করা হয় এবং অচিরেই বঙ্গভঙ্গ রদ ও স্বদেশী আন্দোলন জনপ্রিয়তা লাব করে।৫


স্থানীয় বুদ্ধিজীবীদের অংশগ্রহণ

বঙ্গবঙ্গ রদ আন্দোলনে অশ্বিনী কুমার দত্তের সহযোগীদের মধ্যে ছিলেন বিএম কলেজের অধ্যাপক সতীশ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বিএম স্কুলের শিক্ষক আচার্য জগদীশ মুখোপাধ্যায়, কালীশ চন্দ্র বিদ্যা বিনোদ, বিএম কলেজের অধ্যক্ষ রজনীকান্ত গুহ, উপাধ্যক্ষ কালীপ্রসন্ন ঘোষ, সতীশ চন্দ্র মুখোপাধ্যায়, উকিল নিবারণ দাশগুপ্ত, ব্যারিষ্টার সৈয়দ মোতাহার হোসেন, হাজী ওয়াহেদ রাজা চৌধুরী, শরৎ কুমার রায়, ডা. তারিণী কুমার গুপ্ত, দুগামোহন সেন, মনোরঞ্জন গুহঠাকুরতা, চাণ কবি মুকুন্দ দাশ, ভবরঞ্জন মজুমদার, চৌধুরী মুহাম্মদ ইসমাইল খান প্রমুখ। চারণ কবি মুকুন্দ দাশ গান গেয়ে স্বদেশী আন্দোলনের ডাক ঘরে ঘরে পৌঁছে দেন। স্বদেশী ও বঙ্গভঙ্গ রদ আন্দোলনকারীদের ওপর নেমে আসে ফুলারী নিপীড়ণ ও অত্যাচার। ১৯০৫ খৃৃস্টাব্দে স্যার র‌্যামফিল্ড ফুলার পূর্ব বাংলার গভর্নর নিযুক্ত হন। বরিশালে আন্দোলন প্রবল ছিল সে কারণে বরিশালেই সরকারী নির্যাতন সবচেয়ে বেশি ছিল


কার্লাইল সার্কুলার

শত শত ছাত্র বঙ্গভঙ্গ বিরোধী স্বদেশী আন্দোলনে যোগ দেয়। ছাত্রদের আন্দোলন হতে বিরত রাখার জন্য পূর্ববঙ্গের চীফ সেক্রেটারি মি. কারলাইল ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের ১০ অক্টোবর একটি সার্কুলার জারি করেন। এটির কার্লাইল সার্কুলার নামে পরিচিত। কারলাইল সার্কুলার বিরোধিতার জন্য এন্টি সার্কুলার সোসাইটি গঠন করা হয়। কলকাতায় সতীশ চন্দ্র মুখোপাধ্যায় ডন সোসাইটি গঠন করেন। বরিশালের ছাত্ররা কারলাইল সার্কুলারের শিকার হয় এবং অনেক ছাত্রদের বৃত্তি বন্ধ করে দেয়। স্টীমার ঘাটে ছেলেরা ফুলারকে বলেছিল “ফুলার গো ব্যাক, ফুলারকে প্রত্যাবর্তন করতে হয়েছিল।”৮


চারণকবিদের অংশগ্রহণ

স্বদেশী আন্দোলনেক চারণ কবি মুকুন্দ দাশ জনপ্রিয় করে তোলেন। তিনি বরিশালের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এবং অনেক জেলায় জাগরণী গান শুনালেন এবং জনগণের মধ্যে দেশপ্রেম সৃষ্টি করেন। মুকুন্দ দাশ বাঙালীদের অভয় বাণী শুনালেন। “ভয় কি মরনে, রাখিতে সন্তানে, মাতঙ্গী মেতেছে আজ সমর রঙ্গে”/ “মায়ের নাম নিয়ে ভাসানো তরী”/ “দশ হাজার প্রাণ আমি যদি পেতাম ঐ বিদেশী বণিকের গৌরবরবি অতলতলে ডুবিয়ে দিতাম।”/ মায়ের দেওয়া মোটা কাপড়, মাথায় তুলে নেরে ভাই,”/ “জাগো গো জাগো গো জননী, তুই না জাগিলে শ্যামা কেউতো জাগিবে না”/ “রাম রহিম না জুদা করো”/ “ছিল ধান গোলা ভরা শ্বেত ইন্দুরে করল সারা” ইত্যাদি গান গেয়ে তিনি স্বদেশীদের জাগিয়ে তুললেন।

অশ্বিনী কুমারের মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে মুকুন্দ দাশ জনগণের মধ্যে স্বাধীনতার স্পৃহা সৃষ্টি করেন এবং স্বদেশী গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করেন। রঙ্গশ্রীর কবি হেমচন্দ্র মুখোপাধ্যায় স্বদেশী গান গেয়ে আন্দোলনকে শক্তিশালী করেন। বিখ্যাত জারি গায়ক আলাম, আকুব্বার ও মফিজ উদ্দিন স্বদেশী জারি গান গেয়ে হিন্দু মুসলমানকে বিদেশী মাল বর্জনে উৎসাহিত করেন।



তথ্যসূত্র: ১। সিরাজ উদ্দীন আহমেদ। বরিশাল বিভাগের ইতিহাস (১ম খন্ড)। ভাস্কর প্রকাশনী, ঢাকা। ২০১০