পরমানন্দ বসু
রাজা পরমানন্দ বসু চন্দ্রদ্বীপের ৭ম রাজা ছিলেন। তাঁর মাতা রাজকুমারী কমলা দেবী এবং পিতা দেহেরগতির কুলীন কায়স্থ বলভদ্র বসু। খুব সম্ভব ১৪৯৭ সালে শিবানন্দ বা পরমানন্দ বসুর জন্ম হয়। কমলার মৃত্যুর সাথে চন্দ্রদ্বীপে দেব বংশের রাজত্বকাল শেষ হয়ে যায়। রাজা পরমানন্দ হতে বসুর বংশের রাজত্বকাল শুরু হয়।
পরিচ্ছেদসমূহ
পরামানন্দ বসুর বংশ তালিকা (পূর্বসুরী)
দশরথ বসুর পুত্র পরম বসু (বঙ্গজের আদি পুরুষ); তার পুত্র পূষণ বসু (বল্লালকৃত কুলানী); তার পুত্র দিবাকর বসু; তার পুত্র বাহবট বা বাহভট বসু; তার পুত্র তমোপহ বসু; তার পুত্র অর্হপতি বসু; তার পুত্র পুর বা পুরেন্দ্র বসু; তার পুত্র ভাঞি বসু; তার পুত্র থাক বসু; তার পুত্র কন্দর্প বসু; তার পুত্র মার্কওয়ে (?); তার পুত্র উষাপতি বসু; তার পুত্র বলভদ্র বসু; এবং তার পুত্র হলো রাজা পরমানন্দ বসু।
শিক্ষা ও সিংহাসনে আরোহণ
বলভদ্র বসুর পুত্র পরমান্দ ১৫০০ খ্রিস্টাব্দে মাতার মৃত্যুর পর সিংহাসনে বসেন। কিন্তু তিনি অপ্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ায় পিতা বলভদ্র বসু রাজ্য পরিচালনা করতেন। পরমানন্দ বাকলার বিখ্যাত পন্ডিতদের নিকট সংস্কৃত ও বাংলা ভাষা শিক্ষা লাভ করেন। তিনি বিভিন্ন শাস্ত্র সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করেন। পিতার নিকট থেকে তিনি কৈশোর হতে রাজ্য পরিচালনার অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেন। সম্ভবত তিনি ১৫২০ সাল হতে রাজ্যের ভার স্বহস্তে গ্রহণ করেন । গৌড় ও দিল্লির রাজনৈতিক পরিবর্তনের সময় তিনি গৌড় সুলতানদের সাথে মিত্রতা স্থাপন করে স্বাধীনভাবে রাজ্য শাসন করতেন।
পরমানন্দ বসুর ধর্ম ও সমাজ সমীকরণ
রাজা পরমানন্দের রাজত্বকালে শ্রীচৈতন্য দেব বৈষ্ণব ধর্ম প্রচার করেন। রাজা পরমানন্দ তার ভক্ত ছিলেন। ১৫২৭ সালে শ্রীচৈতন্য দেব কোটালীপাড়ায় মুখডোবা গ্রামে আগমন করেন। মুখডোবার ব্রাহ্মণ মন্দিরে নিজ হাতে বাসুদেবের বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেন। চৈতন্য দেবের আগমনের কথা শুনে পরমানন্দ মুখডোবায় গমন করেন এবং তার সাথে সাক্ষাত করেন। পরমানন্দ বাসুদেবের পূজার জন্য দেবোত্তর ভূমি প্রদান করেন। মুখডোবার ব্রাহ্মণরা এ ভূমি জমিদারী উচ্ছেদের সময় পর্যন্ত ভোগ করতেন।
রাজা পরমানন্দ বসু বাকলার সমাজপতি ছিলেন। তিনি কুলাচার্য ও মন্ত্রীদের সাথে পরামর্শ করে বঙ্গজ কায়স্থদের বাকলা সমাজের নবম বা শেষ সমাজ সমীকরণ করেন। এই সমাজ সীমকরণের সময় একখানি হস্ত লিখিত কুলগ্রন্থে বঙ্গজ কায়স্থদের চতুর্বিধ কুল পদ্ধতির উল্লেখ আছে। উক্ত গ্রন্থে বঙ্গজ মৌলিক সম্বন্ধে বিধান আছে।
কুলীনের সঙ্গে যদি সম্বন্ধ করয়। পণ দিয়া পূজিবে করিবে বিনয়। কুলীন ঠাকুর বটে মর্যাদায় বড়।
বঙ্গজ কুলীনগণ বসুঠাকুর, গুহঠাকুর ইত্যাদি অভিধায় আখ্যাত হতো। বানারীপাড়ার গুহ বংশীয়গণ গুহঠাকুরতা নামে অভিহিত। মনে হয় তারা পরমানন্দের সমাজ সমীকরণের সময় কুলীনত্বের মর্যাদা প্রাপ্য হন। পরমানন্দ কুলীন কায়স্থদের বিষয় কয়েকটি নতুন নতুন নিয়ম প্রচলন করেন। পূর্বে ঘোষ, বসু গুহ ও মিত্র গণনা করা হতো। তিনি ১২/১৩ পর্যায়ে কুলীন নিয়ে নবম সমাজ সমীকরণ করেছিলেন। তিনি পূর্বের নিয়ম পরিবর্তন করে বসু, ঘোষ, গুহ ও মিত্র এরূপ গণনা শুরু করেন। তিনি নিজে বসু বলে নিজের বংশমর্যাদা শিরঃস্থানে নির্ধারিত করেন। এ নিয়ম প্রচলন করায় বাকলা কুলীন সমাজে মতান্তর দেখা দেয়। তাই পরমানন্দের নবম সমীকরণ সমাপ্ত হয়নি। তার এই সমাজ সমীকরণের ফলে আরও কয়েকটি ভিন্ন সমাজ গঠিত হয়। প্রতাপাদিত্যের পিতৃব্য বসন্ত রায় সমাজ প্রতিষ্ঠা করে বাকলা সমাজ হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান। এই সমাজ সমীকরণ নিয়ে মতান্তর সত্ত্বেও বাকলা সমাজ শিরঃস্থানে ছিল। ঘটক গ্রন্থে দেখা যায় বাকলা সমাজ শিরঃস্থান, যশোর সমাজ বাহু স্বরূপ, বিক্রমপুর সমাজ ঊরুদ্বয় এবং ভূষণা সমাজ পদদ্বয়। প্রাচীনকাল হতে বরিশালের নথুল্লাবাদের মীরবহর, বসু, বামরাইলের বসু, গাভা ও লক্ষ্মণকাঠীর ঘোষ-দস্তিদার ও বানারীপাড়ার গুহঠাকুরতা বাংলাদেশে কুলীন সমাজের শীর্ষস্থান অধিকার করেছিল।
পরমানন্দ বসুর রাজত্বকালে পর্তুগীজদের আগমন
রাজা পরমানন্দের রাজত্বকালের প্রধান ঘটনা পর্তুগীজদের আগমন। ১৬ শতকের প্রথমভাগে পর্তুগীজরা চট্টগ্রাম বন্দরে বাণিজ্য করতে আসে। তারা সেখানে আরব-পারস্য বণিকদের নিকট পরাজয় বরণ করে এবং দ্বিতীয় একটি সামুদ্রিক বন্দরে বাণিজ্য করার চেষ্টা করে। তখন বাণিজ্য ক্ষেত্রে চট্টগ্রামের পরেই বাকলার স্থান। পর্তুগীজ বণিকরা উপঢৌকনসহ ১৫৫৯ সালে রাজধানী বাকলানগরে পরমানন্দের সাথে সাক্ষাত করে। পর্তুগীজরা বাকলা বন্দরে বাণিজ্য করার প্রস্তাব দেয় এবং তার পরিবর্তে পরমানন্দকে শত্রুর আক্রমণ হতে রক্ষা করার জন্য সামরিক সাহায্যের আশ্বাস দেয়। রাজা পরমানন্দ ১৫৫৯ সালে ৩০ এপ্রিল পর্তুগীজ সরকারের সাথে একটি মৈত্রী চুক্তি সম্পাদন করেন। চুক্তিপত্রটি পর্তুগীজ ভাষায় লিখিত এবং ইটালির মহাফেজখানায় সংরক্ষিত ছিল। এই চুক্তি সম্পর্কে স্যার যদুনাথ সরকার বলেন, “Some light is thrown on this obscure point by a treaty rescued from oblivion by the industry of that great archivist, Julio Firminio Judice Biker. The document was signed on behalf of a Bengal prince, the Raja of Bakala (Parmananda Roy) by Niamat Khan (Nematchao) and Gannu Bysuar (Kanu or Ganu Biswas) who seem to have made a journey to Goa to negotiate subordinate alliance on the part of their master with the Portuguese Viceroy of India (Dome Constantinode Braganza). This treaty of the 30 the April 1559 provided for a mutual military and commercial alliance.”
১৫৫৯ খ্রিস্টাব্দে ৩০ এপ্রিল গোয়া বন্দরে চন্দ্রদ¦ীপ রাজা পরমানন্দ ও ভারতীয় পর্তুগীজ প্রতিনিধিদের সাথে সম্পাদিত চুক্তির শর্তগুলো হলো- রাজা পরমানন্দ বাকলা বন্দর অথবা তার রাজ্যের যে কোন সুন্দর বন্দর পর্তুগীজ বাণিজ্য তরীর জন্য উন্মুক্ত করে দিতে সম্মত হন। যে সকল পর্তুগীজ বণিক বাকলা রাজ্যে পদার্পণ করবে তাদের প্রতি রাজা সহানুভূতিশীল ও দয়ালু থাকবেন এবং তাদের বানিজ্য তরীগুলোকে বাকলা হতে পায়গাও পর্যন্ত উপকূলের পণ্যদ্রব্য দিয়ে ভর্তি করতে সাহায্য করবে। পর্তুগীজ বণিকদের নিকট থেকে কোন বন্দরে শুল্ক আদায় করা হবে না।
উপরোক্ত সুযোগ-সুবিধা প্রদান করার জন্য পর্তুগীজরা চট্টগ্রাম বন্দরে ব্যবসা বন্ধ করার অঙ্গীকার করে এবং তারা রাজার বন্দরে প্রাপ্য আবগারী শুল্ক দিতে বাধ্য থাকবে। রাজার চারখানা বাণিজ্য জাহাজকে বিদেশে বাণিজ্যের অনুমতি দেয়া হয়। এ সকল বাণিজ্য তরী দ্রব্যসম্ভার নিয়ে পর্তুগীজ বন্দর গোয়া, উরমুজ, এরা ও মারাক্কায় প্রতি বছর যাতায়াত করবে। এই মৈত্রীচুক্তি রাজাকে অধীনস্থ করে ফেলে। রাজাকে তাদের শত্রুদের সাথে কোনরকম সম্পর্ক স্থাপন করা থেকে বিরত রাখা হয়। কিন্তু পর্তুগীজদের এ অঞ্চলের অন্যান্য রাজার সাথে একই রকম চুক্তি সম্পাদন করার অধিকার ছিল। পার্শ্ববর্তীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময় পর্তুগীজরা রাজাকে সামরিক সহযোগিতাদানে চুক্তিবদ্ধ হয় এবং তাঁত শিল্পজাত দ্রব্যের মাধ্যমে বার্ষিক কর দিতে সম্মত হন। পর্তুগীজরা স্থানীয় রাজাদের মাধ্যমে এদেশের একচেটিয়া বাণিজ্য করতে চেয়েছিল। রাজাদের দুর্বলতা ও দূরাকাক্সক্ষা তাদের এই নতুন পরিকল্পনার সুযোগ এনে দেয়।
পার্শ্ববর্তীদের দ্বারা আক্রান্ত হলে বাকলা রাজাকে সাহায্য করবে-এ চুক্তি থাকা সত্ত্বেও পর্তুগীজরা শ্রীপুরের রাজা চাঁদ রায়, কেদার রায়, যশোরের রাজা প্রতাপাদিত্যের সাথে অনুরূপ চুক্তি করে। যুদ্ধের সময় তারা কোন সাহয্য করেনি। অধিকন্তু পরবর্তীকালে তারা চন্দ্রদ্বীপ রাজ্যে মগদের নিয়ে এক ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করে। এই চুক্তির সমালোচনা করে ডঃ অতুলচন্দ্র রায় বলেন, “This treaty therefore bore both commercial and political importance to the Portuguese in their history of infiltration in Bengal and it was the foundation stone of their power in Bengal.”
১৫৫৯ সালে বাণিজ্য চুক্তির অজুহাতে পর্তুগীজ বণিকগণ সমুদ্রোপকূলে বাকলা বন্দর হতে পায়গাঁও বন্দর পর্যন্ত বাণিজ্য করার অধিকার লাভ করে। এ চুক্তি প্রমাণ করে যে, বাকলা-চন্দ্রদ্বীপ রাজ্যে একাধিক বাণিজ্য বন্দর ছিল। কসবা, মির্জাগঞ্জ, গিরদে লক্ষ্মীপুর, শরিকল, দাসেরহাট, গোবিন্দপুর প্রভৃতি সুলতানী আমলে বাণিজ্য বন্দর ছিল বলে মনে হয়। যদি তাই হয় তবে সুন্দরবনসহ বাগেরহাট-খুলনা পরমানন্দের শাসনাধীন ছিল।
পরমানন্দের শাসনামল
রাজা পরমানন্দের রাজত্বকালে সুলতান হুসেন শাহ, নুসরত শাহ ও শূর বংশীয় আফগান সুলতানগণ বাংলাদেশ তথা গৌড় শাসন করেন। ১৫৬৩ সালে তাজ কররানী আফগান শেষ সুলতানকে পরাজিত করে গৌড়ের সিংহাসন দখল করেন। রাজা পরমানন্দ একজন সুশাসক ও বীরযোদ্ধা ছিলেন। গৌড় সুলতান ভুলুয়া, শ্রীপুর ও ভূষণার রাজারা বাকলা আক্রমণের প্রচেষ্টা চালান। পার্শ্ববর্তী রাজ্য থেকে আক্রমাণ প্রতিহত করার জন্য তিনি এক শক্তিশালী সৈন্যবাহিনী গঠন করেন। তার সেনাবাহিনীতে হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের লোক ছিল। নিয়ামত খাঁ তার একজন প্রধান অমাত্য ছিলেন। তিনি রাজ্যের মধ্যে অনেক দূর্গ নির্মাণ করেন। তিনি রাজধানী বাকলানগরে দূর্গ নির্মাণ করে সুরক্ষিত করেন। আবুল ফজল তার আইন ই-আকবরীতে বাকলা শহরের দুর্গের কথা উল্লেখ করেছেন।
রাজা পরমানন্দ প্রায় ৭০ বছর রাজত্ব করে ১৫৭০ খ্রিস্টাব্দে দেহত্যাগ করেন। মৃত্যুর পর তাকে বাকলা রাজবাড়িতে সমাধিস্থ করা হয়। পরমানন্দ রাজধানী বাকলানগরে অনেক সুরম্য দালান, মন্দির ও রাস্তা নির্মাণ করেন। তার নির্মিত রাজপ্রাসাদ ও মন্দির তেঁতুলিয়া নদীতে বিলীন হয়ে যায়। ১৮৭৪ সালে মিঃ বেভারিজ কচুয়া-বাকলা পরিদর্শন করেন। তিনি সুউচ্চ মন্দির ও পরিত্যক্ত কয়েকটি দালান দেখেন।
তিনি পন্ডিত ব্যক্তিদের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তার রাজত্বকালে মনসা মঙ্গলের কবি বিজয় গুপ্ত জীবিত ছিলেন। ত্রিলোচন দাশ, জানকী নাথ, মধুসূদন সারস্বত, রূপ-সনাতন ও শ্রীজীব গোস্বামী তার রাজত্বকালে বাকলা-চন্দ্রদ্বীপে আবির্ভূত হন। এ সময় বাকলা রাজ্যে বাংলা ও সংস্কৃত ভাষা বিশেষ উন্নতি লাভ করে। শ্রীচৈতন্য দেব প্রচারিত বৈষ্ণব ধর্মেও তিনি ভক্ত ছিলেন। তার পৃষ্ঠপোষকতায় রাজ্যে বৈষ্ণব সাহিত্যের ব্যাপক প্রসার ঘটে।
তথ্যসূত্র: সিরাজ উদ্দীন আহমেদ, বরিশাল বিভাগের ইতিহাস, ১ম খণ্ড, ভাস্কর প্রকাশনী