পরমানন্দ বসু

Barisalpedia থেকে
Spadmin (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ১২:১৭, ১৩ জুন ২০১৭ পর্যন্ত সংস্করণে (পরমানন্দের শাসনামল)

রাজা পরমানন্দ বসু রাজা জয়দেবের কন্যা রাজকুমারী কমলার দেহেরগতির কুলীন কায়স্থ বলভদ্র বসুর সাথে বিয়ে হয়। খুব সম্ভব ১৪৯৭ সালে রাজকুমারী কমলা এক পুসন্তান লাভ করেন এবং পুত্রের নাম রাখেন শিবানন্দ বা পরমানন্দ বসু। কমলার মৃত্যুর সাথে দেব বংশের রাজত্বকাল শেষ হয়ে যায়। রাজা পরমানন্দ হতে বসুর বংশের রাজত্বকাল শুরু হয়।


বলভদ্র বসুর বংশ তালিকা (পূর্বসুরী)

দশরথ বসুর পুত্র পরম বসু (বঙ্গজের আদি পুরুষ); তার পুত্র পূষণ বসু (বল্লালকৃত কুলানী); তার পুত্র দিবাকর বসু; তার পুত্র বাহবট বা বাহভট বসু; তার পুত্র তমোপহ বসু; তার পুত্র অর্হপতি বসু; তার পুত্র পুর বা পুরেন্দ্র বসু; তার পুত্র ভাঞি বসু; তার পুত্র থাক বসু; তার পুত্র কন্দর্প বসু; তার পুত্র মার্কওয়ে (?); তার পুত্র উষাপতি বসু; এবং তার পুত্র হলো বলভদ্র বসু।

( চন্দ্রদ্বীপ বসু রাজাদের আদি)

পরমানন্দ বসুর পূর্বপুরুষশ দশরথ বসু। দশরত বসু বল্লালী কুলীনত্ব লাভ করে বাকলা-চন্দ্রদ্বীপে বসতি স্থাপন করেন। এ বংশের ১০ পুরুষ থাক বসু। থাক বসু দেহেরগতি গ্রামে বাস করতেন। থাক বসুর পুত্র উষাপতি। বুষপতির পুত্র বলভদ্র বসু রাজকুমারী কমলার স্বামী। বলভদ্র বসুর পুত্র পরমান্দ ১৫০০ খ্রিস্টাব্দে মাতার মৃত্যুর পর সিংহাসনে বসেন। কিন্তু তিনি অপ্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ায় পিতা বলভদ্র বসু রাজ্য পরিচালনা করতেন। পরমানন্দ বাকলার বিখ্যাত পন্ডিতদের নিকট সংস্কৃত ও বাংলা ভাষা শিক্ষা লাভ করেন। তিনি বিভিন্ন শাস্ত্র সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করেন। পিতার নিকট থেকে তিনি কৈশোর হতে রাজ্য পরিচালনার অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেন। সম্ভবত তিনি ১৫২০ সাল হতে রাজ্যেও ভার স্বহস্তে গ্রহণ করেন । গৌড় ও দিল্লির রাজনৈতিক পরিবর্তনের সময় তিনি গৌড় সুলতানদের সাথে মিত্রতা স্থাপন করে স্বাধীনভাবে রাজ্য শাসন করতেন।


পরমানন্দ বসুর রাজত্বকাল

রাজা পরমানন্দের রাজত্বকালে শ্রীচৈতন্য দেব বৈষ্ণব ধর্ম প্রচার করেন। রাজা পরমানন্দ তার ভক্ত ছিলেন। ১৫২৭ সালে শ্রীচৈতন্য দেব কোটারীপাড়ায় মুখডোবা গ্রামে আগমন করেন। মুখডোবার ব্রাহ্মণ মন্দিরে নিজ হাতে বাসুদেবের বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেন। চৈতন্য দেবের আগমনের কথা শুনে পরমানন্দ মুখডোবায় গমন করেন এবং তার সাথে সাক্ষাত করেন। পরমানন্দ বাসুদেবের পূজার জন্য দেবোত্তর ভূমি প্রদান করেন। মুখডোবার ব্রাহ্মণরা এ ভূমি জমিদারী উচ্ছেদের সময় পর্যন্ত ভোগ করতেন। রাজা পরমানন্দ বসু বাকলার সমাজপতি ছিলেন। তিনি কুলাচার্য ও মন্ত্রীদের সাথে পরামর্শ করে বঙ্গজ কায়স্থদের বাকলা সমাজের নবম বা শেষ সমাজ সমীকরণ করেন। এই সমাজ সীমকরণের সময় একখানি হস্ত লিখিত কুলগ্রন্থে বঙ্গজ কায়স্থদের চতুর্বিধ কুল পদ্ধতির উল্লেখ আছে। উক্ত গ্রন্থে বঙ্গজ মৌলিক সম্বন্ধে বিধান আছে।

কুলীনের সঙ্গে যদি সম্বন্ধ করয়। পণ দিয়া পূজিবে করিবে বিনয়। কুলীন ঠাকুর বটে মর্যাদায় বড়।

বঙ্গজ কুলীনগণ বসুঠাকুর, গুহঠাকুর আখ্যাত হতো। বানারীপাড়ার গুহ বংশীয়গণ গুহঠাকুরতা নামে অভিহিত। মনে হয় তারা পরমানন্দের সমাজ সমীকরণের সময় কুলীনত্বের মর্যাদা প্রাপÍ হন। পরমানন্দ কুলীন কায়স্থদের বিষয় কয়েকটি নতুন নতুন নিয়ম প্রচরণ করেন। পূর্বে ঘোষ, বসু গুহ ও মিত্র গণনা করা হতো। তিনি ১২/১৩ পর্যায়ে কুলীন নিয়ে নবম সমাজ সমীকরণ করেছিলেন। তিনি পূর্বেও নিঃযম পরিবর্তন করে বসু, ঘোষ, গুহ ও মিত্র এরূপ গণনা শুরু করেন। তিনি নিজে বসু বওে নিজের বংশ মর্যদা শিরঃস্থানে নির্ধারিত করেন। এ নিয়ম প্রচলন করায় বাকলা কুলীন সমাজে মতান্তর দেখা দেয়। তাই পরমানন্দের নবম সমীকরণ সমাপ্ত হয়নি। তার এই সমাজ সমীকরণের ফলে আরও কয়েকটি ভিন্ন সমাজ গঠিত হয়। প্রতাপাদিত্যের পিতৃব্য বসন্ত রায় সমাজ প্রতিষ্ঠা করে বাকলা সমাজ হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এই সমাজ সমীকরণ নিয়ে মতান্তর সত্ত্বেও বাকলা সমাজ শিরঃস্থানে ছিল। ঘটক গ্রন্থে দেখা যায় বাকলা সমাজ শিরঃস্থান, যশোর সমাজ বাহু স্বরূপ, বিক্রমপুর সমাজ ঊরুদ্বয় এবং ভূষণা সমাজ পদদ্বয়। প্রাচীনকাল হতে বরিশালের নথুল্লাবাদের মীরবহর, বসু, বামরাইলের বসু, গাভা ও লক্ষ্মণকাঠীর ঘোষ-দস্তিদার ও বানারীপাড়ার গুহঠাকুরতা বাংলাদেশে কুলীন সমাজের শীর্ষস্থান অধিকার করেছিল।

পর্তুগীজদের আগমন

রাজা পরমানন্দের রাজত্বকালের প্রধান ঘটনা পর্তুগীজদের আগমন। ১৬ শতকের প্রথমভাগে পর্তুগীজরা চট্টগ্রাম বন্দরে বাণিজ্য করতে আসে। তারা সেখানে আরব-পারস্য বণিকদের নিকট পরাজয় বরণ করে এবং দ্বিতীয় একটি সামুদ্রিক বন্দরে বাণিজ্য করার চেষ্টা করে। তখন বাণিজ্য ক্ষেত্রে চট্টগ্রামের পরেই বাকলার স্থান। পর্তুগীজ বণিকরা উপঢৌকনসহ ১৫৫৯ সালে রাজধানী বাকলানগরে পরমানন্দের সাথে সাক্ষাত করে। পর্তুগীজরা বাকলা বন্দরে বাণিজ্য করার প্রস্তাব দেয় এবং তার পরিবর্তে পরমানন্দকে শত্রুর আক্রমণ হতে রক্ষা করার জন্য সামরিক সাহায্যের আশ্বাস দেয়। রাজা পরমানন্দ ১৫৫৯ সালে ৩০ এপ্রিল পর্তুগীজ সরকারের সাথে একটি মৈত্রী চুক্তি সম্পাদন করেন। চুক্তিপত্রটি পর্তুগীজ ভাষায় লিখিত এবং ইটালির মহাফেজখানায় সংরক্ষিত ছিল। এই চুক্তি সম্পর্কে স্যার যদুনাথ সরকার বলেন, “Some light is thrown on this obscure point by a treaty rescued from oblivion by the industry of that great archivist, Julio Firminio Judice Biker. The document was signed on behalf of a Bengal prince, the Raja of Bakala (Parmananda Roy) by Niamat Khan (Nematchao) and Gannu Bysuar (Kanu or Ganu Biswas) who seem to have made a journey to Goa to negotiate subordinate alliance on the part of their master with the Portuguese Viceroy of India (Dome Constantinode Braganza). This treaty of the 30 the April 1559 provided for a mutual military and commercial alliance.” “মহামতি আর্কিবিসট জুলিও মারমিনিও জুডিস বিকার পরিশ্রম করে হারিয়ে যাওয়া চুক্তিটি আবিষ্কার করেছেন। এই চুক্তি থেকে আমরা আলোর সন্ধান পেয়েছি।” চুক্তি সম্পাদন করার জন্য রাজা পরমানন্দ নিয়ামত খাঁ ও কানু (গুনু) বিশ্বাসকে সমুদ্রপথে গোয়া বন্দরে প্রেরণ করেন। নিয়ামত খাঁ ও কানু বিশ্বাস তাদের রাজার পক্ষে পর্তুগালের ভারতীয় প্রতিনিধি ডোম কনস্টান্টিনোডি ব্রাগ্যানজারের সাথে চুক্তি সম্পাদন করেন।” ১৫৫৯ খ্রিস্টাব্দে ৩০ এপ্রিল গোয়া বন্দরে চন্দ্রদ¦ীপ রাজা পরমানন্দ ও ভারতীয় পর্তুগীজ প্রতিনিধিদের সাথে সম্পাদিত চুক্তির শর্তগুলো হলো- রাজা পরমানন্দ বাকলা বন্দর অথবা তার বাজ্যের যে কোন সুন্দর বন্দর পর্তুগীজ বাণিজ্য তরীর জন্য উন্মুক্ত করে দিতে সম্মত হন। যে সকল পর্তুগীজ বণিক বাকলা রাজ্যে পদার্পণ করবে তাদের প্রতি রাজা সহানুভূতিশীল ও দয়ালু থাকবেন এবং তাদের বানিজ্য তরীগুলোকে বাকলা হতে পায়গাও পর্যন্ত উপকূলের পণ্যদ্রব্য দিয়ে ভর্তি করতে সাহায্য করবে। পর্তুগীজ বণিকদের নিকট থেকে কোন বন্দরে শুল্ক আদায় করা হবে না। উপরোক্ত সুযোগ-সুবিধা প্রদান করার জন্য পর্তুগীজরা চট্টগ্রাম বন্দরে ব্যবসা বন্ধ করার অঙ্গীকার করে এবং তারা রাজার বন্দরে প্রাপ্য আবগারী শুল্ক দিতে বাধ্য থাকবে। রাজার চারখানা বাণিজ্য জাহাজকে বিদেশে বাণিজ্যের অনুমতি দেয়া হয়। এ সকল বাণিজ্য তরী দ্রব্যসম্ভার নিয়ে পর্তুগীজ বন্দর গোয়া, উরমুজ, এরা ও মারাক্কায় প্রতি বছর যাতায়াত করবে। এই মৈত্রীচুক্তি রাজাকে অধীনস্থ করে ফেলে। রাজাকে তাদের শত্রুদেও সাথে কোনরকম সম্পর্ক স্থাপন করা থেকে বিরত রাখা হয়। কিন্তু পর্তুগীজদের এ অঞ্চলের অন্যান্য রাজার সাথে একই রকম চুক্তি সম্পাদন করার অধিকার ছিল। পার্শ্ববর্তীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময় পর্তুগীজরা রাজাকে সামরিক সহযোগিতাদানে চুক্তিবদ্ধ হয় এবং তাঁত শিল্পজাত দ্রব্যের মাধ্যমে বার্ষিক কর দিতে সম্মত হন। পর্তুগীজরা স্থানীয় রাজাদের মাধ্যমে এদেশের একচেটিয়া বাণিজ্য করতে চেয়েছিল। রাজাদের দুর্বলতা ও দূরাকাক্সক্ষা তাদের এই নতুন পরিকল্পনার সুযোগ এনে দেয়। পার্শ্ববর্তীদের দ্বারা আক্রান্ত হলে বাকলা রাজাকে সাহায্য করবে-এ চুক্তি থাকা সত্ত্বেও পর্তুগীজরা শ্রীপুরের রাজা চাঁদ রায়, কেদার রায় যশোরের রাজা প্রতাপাদিত্যের সাথে অনুরূপ চুক্তি করে। যুদ্ধের সময় তারা কোন সাহয্য করেনি। অধিকন্তু পরবর্তীকালে তারা চন্দ্রদ্বীপ রাজ্যে মগদের নিয়ে এক ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করে। এই চুক্তির সমালোচনা করে ডঃ অতুলচন্দ্র রায় বলেন, “This treaty therefore bore both commercial and political importance to the Portuguese in their history of infiltration in Bengal and iota was the foundation stone of their power in Bengal.”

বানিজ্য চুক্তির গুরুত্ব

“সুতরাং এ চুক্তি পর্তুগীজদের বাংলাদেশের অনুপ্রবেশের ইতিহাসে রাজনৈতিক ও বাণিজ্যের গুরুত্ব বহন করে এবং এই চুক্তি তাদের বাংলাদেশের শক্তি প্রতিষ্ঠার ভিত্তি স্থাপন করেন। এই চুক্তির ফলে চন্দ্রদ্বীপ রাজ্যে স্বাধীনতা ক্ষুন্ন হয় এবং রাজা পর্তুগীজদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। চুক্তির দ্বারা রাজার আশনুরূপ ফল হয়নি। বিপদের দিনে তারা রাজাকে সাহায্য করেনি। অথচ রাজা পর্তুগীজদের বিপদে আশ্রয় দিয়েছেন। বাণিজ্যক্ষেত্রে তিনি উপকৃত হতে পারেননি। বাকলা সামুদ্রিক বন্দর হিসেবে চট্টগ্রামের স্থান দখল করতে পারেনি। এই চুক্তির মাধ্যমে বাকলার বণিকগণ পর্তুগীজ ও বিদেশী বণিকদের সাথে বাণিজ্য করার সুযোগ লাভ করে। বাকলার চাল, চিনি, ঘি ও তুলা বিদেশে রপ্তানি করে স্বর্ণ ও মণিমুক্তা অর্জন করে। ১৫৫৯ সালে বাণিজ্য চুক্তির অজুহাতে পর্তুগীজ বণিকগণ সমুদ্রোপকূলে বাকলা বন্দর হতে পায়গাঁও বন্দর পর্যন্ত বাণিজ্য করার অধিকার লাভ করে। এ চুক্তি প্রমাণ করে যে, বাকলা-চন্দ্রদ্বীপ রাজ্যে একাধিক বাণিজ্য বন্দর ছিল। কসবা, মির্জাগঞ্জ, গিরদে লক্ষ্মীপুর, শরিকল, দাসেরহাট, গোবিন্দপুর প্রভৃতি সুলতানী আমলে বাণিজ্য বন্দর ছিল বলে মনে হয়। যদি তাই হয় তবে খুলনা জেলা আলোচ্য সময় চন্দ্রদ্বীপ রাজধানী ছিল। কারণ এ সময় গৌর সুলতান শক্তিশালী ছিল না এবং তখন যশোর রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি। সুন্দরবনসহ বাগেরহাট-খুলনা পরমানন্দের শাসনাধীন ছিল।

পরমানন্দের শাসনামল

রাজা পরমানন্দের রাজত্বকালে সুলতান হুসেন শাহ, নুসরত শাহ ও শূর বংশীয় আফগান সুলতানগণ বাংলাদেশ শাসন করেন। ১৫৬৩ সালে তাজ কররানী আফগান শেষ সুলতানকে পরাজিত করে গৌড়ের সিংহাসন দখল করেন। রাজা পরমানন্দ একজন সুশাসক ও বীরযোদ্ধা ছিলেন। গৌড় সুলতান ভুলুয়া, শ্রীপুর ও ভূষণার রাজারা বাকলা আক্রমণের প্রচেষ্টা চালান। পার্শ্ববর্তী রাজ্য থেকে আক্রমাণ প্রতিহত করার জন্য তিনি এক শক্তিশালী সৈন্যবাহিনী গঠন করেন। তার সেনাবাহিনীতে হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের লোক ছিল। নিয়ামত খাঁ তার একজন প্রধান অমাত্য ছিলেন। তিনি রাজ্যের মধ্যে অনেক দূর্গ নির্মাণ করেন। তিনি রাজধানী বাকলানগরে দূর্গ নির্মাণ করে সুরক্ষিত করেন। আবুল ফজল তার আইন ই-আকবরীতে বাকলা শহরের দুর্গের কথা উল্লেখ করেছেন।

রাজা পরমানন্দ প্রায় ৭০ বছর রাজত্ব করে ১৫৭০ খ্রিস্টাব্দে দেহত্যাগ করেন। মৃত্যুও পর তাকে বাকলা রাজবাড়িতে সমাধিস্থ করা হয়। তিনি দক্ষ শাসক, প্রজাবৎসল ও বিদ্যোৎসাহী রাজা ছিলেন। তার শাসনামলে বাকলা রাজ্য উন্নতির চরম শিখরে আরোহণ করে। কৃষি ও শিল্প উৎপাদনে বাকলা উদ্বৃত্ত ছিল। চন্দ্রদ্বীপের বিভিন্ন বন্দর হতে চাল, লবণ, চিনি, ঘি ও সুতা বিদেশে রপ্তানী হতো। জনগণের অর্থনৈতিক অবস্থা সমৃদ্বিশালী ছিল। পরমানন্দ রাজধানী বাকলানগরে অনেক সুরম্য দালান, মন্দির ও রাস্তা নির্মাণ করেন। তার নির্মিত রাজপ্রাসাদ ও মন্দির তেঁতুলিয়া নদীতে বিলীন হয়ে যায়। ১৮৭৪ সালে মিঃ বেভারিজ কচুয়া-বাকলা পরিদর্শন করেন। তিনি সুউচ্চ মন্দির ও পরিত্যক্ত কয়েকটি দালান দেখেন। মন্দিরের চূড়া দেখে যেত। বর্তমানে রাজবাড়ী কচুয়ায় চর পড়েছে। এককালের রাজধানী বাকলা এখন কৃষিভূমি।

পরমানন্দের রাজত্বকাল বাকলার ইতিহাসের স্বর্ণযুগ। তার রাজত্বকাল প্রায় এক শতাব্দীর ইতিহাস। তার সময় বাকলা সাহিত্য সংস্কৃতি, অর্থনীতি প্রভৃতি ক্ষেত্রে অগ্রগতি লাভ করে। চন্দ্রদ্বীপ রাজ্যের কচুয়া, কালিসূরী, ধুলিয়া, তাতেরকাটি, কালাইয়া, দাসেরহাট, সূর্যমণি, মদনপুর, আওলিয়াপুর, বেতাগী, রামবল্লভপুর, বাকলা, দুর্গাপাশা, রাজনগর, কালাবাকলা, মঙ্গলসী, গিরদে-লক্ষ্মীপুর, মির্জাগঞ্জ, মোকামিয়া, বিবিচিনি, মাধবখালী, গুলিশাখালী, চাওরা, ইদিলপুর, কসবা, ফুল্লশ্রী, লতা, হোসেনেপুর প্রভৃতি জনপদ সুখ-শান্তিতে ভরপুর ছিল।

তিনি পন্ডিত ব্যক্তিদের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তার রাজত্বকালে মনসা মঙ্গলের কবি বিজয় গুপ্ত জীবিত ছিলেন। ত্রিলোচন দাশ,জানকী নাথ, মধুসূদন সারস্বত, রূপ-সনাতন ও শ্রীজীব গোস্বামী তার রাজত্বকালে বাকলা-চন্দ্রদ্বীপে আবির্ভূত হন। এ সময় বাকলা রাজ্যে বাংলা ও সংস্কৃত ভাষা বিশেষ উন্নতি লাভ করে। শ্রীচৈতন্য দেব প্রচারিত বৈষ্ণব ধর্মেও তিনি ভক্ত ছিলেন। তার পৃষ্ঠপোষকতায় রাজ্যে বৈষ্ণব সাহিত্যের ব্যাপক প্রসার ঘটে।

পর্তুগীজদের সাথে বশ্যতামূলক সামরিক চুক্তি ব্যতীত পরমানন্দের শাসনকাল সমালোচনার উর্ধে। কিন্তু তৎকালীন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তার পক্ষে পর্তুগীজদের সাথে সামরিক চুক্তি করা স্বাভাবিক। পর্তুগীজরা গোলাবারুদের ব্যবহার জানত। তাই পার্শ্ববর্তী শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য তাকে উন্নত একটি শক্তির সাথে মিত্রতা করতে হয়েছে। রাজা পরমানন্দ একটি বিদেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছেন। তার পূর্বে বাংলার কোন সুলতান অন্য রাষ্ট্রের সাথে বাণিজ্যিক বা সামরিক চুক্তি করেননি। বৈদেশিক সম্পর্ক স্থাপন করে তিনি অনন্য উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন।


তথ্যসূত্র: সিরাজ উদ্দীন আহমেদ, বরিশাল বিভাগের ইতিহাস, ১ম খণ্ড, ভাস্কর প্রকাশনী