ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়, ডি.জি.
জন্ম ২৬ মার্চ ১৮৯৩। মৃত্যু ১৮ নভেম্বর ১৯৭৮। পৈত্রিক আদি নিবাস বার্থী, গৌরনদী, বরিশাল।সারা ভারতে ‘ডিজি’ নামে সুপরিচিত ছিলেন। চিত্রশিল্পী, মূকাভিনেতা, বহুরূপী সজ্জায় বিশেষজ্ঞ, কাহিনিকার, চিত্রনাট্যকার, পরিচালক, অভিনেতা, কৌতুকশিল্পী এবং সংস্থা-সংগঠক ধীরেন্দ্রনাথ জীবৎকালেই কিংবদন্তির নায়কে প্রতিষ্ঠিত হন।
পিতা বামনচন্দ্র ব্রাহ্ম ধর্ম গ্রহণ করে পিতৃভূমি বরিশালের আলতা গ্রাম থেকে কলকাতায় চলে আসেন। মেজদা নগেন্দ্রনাথ ছিলেন রবীন্দ্রনাথের জামাতা। কৈশোর কাটে শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের স্নেহচ্ছায়ায়। ছবি আঁকায় ও অভিনয়ে সমান দক্ষ ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের সাথে অনেক নাটকে অভিনয়ও করেছেন। ১৯১০খ্রি. শান্তিনিকেতনের পাঠ শেষ করে রবীন্দ্রনাথের পরামর্শে কলকাতা আর্ট কলেজে ভর্তি হন। বাড়ির গুরুজনদের তা পছন্দ না হওয়ায় বাড়ি ছেড়ে আলাদা থেকে পেইন্টিং ও মেক-আপ করে অর্থ উপার্জন করেন। ১৯১৫খ্রি. আর্ট কলেজ থেকে ভাল ভাবে পাশ করে হায়দ্রাবাদে নিজাম আর্ট কলেজে শিক্ষকতার চাকরী নিয়ে চলে যান। ছোটোবেলা থেকেই মেকাপ বিষয়ে দক্ষ ছিলেন। বহুরূপি সেজে সকলকে অবাক করে দিতেন। তাঁর এই ক্ষমতার জন্য লালবাজারের পুলিশকর্তাদের কাছ থেকে ডাক পড়েছিল। তিনি ডিটেকটিভদের নানা সাজে সজ্জিত করে দিতেন। পরে বিপ্লবীদের বিরুদ্ধে পুলিশি অত্যাচারের প্রতিবাদে তিনি ওই কাজ ছেড়ে দেন। তখন ছবি এঁকে তা বিক্রি করতেন। তাঁর চিত্রপুস্তক ‘ভাবের অভিব্যক্তি’, ‘বিয়ে’, ‘ভালবাসা’, ‘ফুলসজ্জা’, ‘রং-বেরং’ প্রভৃতি। বইগুলির রচনাও তাঁর নিজস্ব। ‘রং-বেরং’ বইটির অনেকগুলি চুটকি তাঁর হাস্যকৌতুক-সৃজনক্ষমতার সাক্ষ্য বহন করে। চার্লি চ্যাপলিন কতৃর্ক অনুপ্রাণিত হয়ে সিনেমা শিল্পে আসেন। তখন ম্যাডান কোম্পানি পৌরাণিক কাহিনির উপর বিরাট চলচ্চিত্র প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন। তিনি কলকাতায় এসে নীতীশ লাহিড়ীর সঙ্গে ১৯১৯খ্রি. ইন্দো-ব্রিটিশ ফিলম কোম্পানি গড়ে তোলেন। চলচ্চিত্রের নির্বাক যুগ তখন। বাঙালির সাধারণ জীবনযাত্রা নিয়ে তিনি ছবি তুলতে শুরু করেন। ২৬.২.১৯২১খ্রি. তাঁর প্রথম ব্যঙ্গচিত্র ‘বিলাত ফেরৎ’ মুক্তিলাভ করেÑনায়ক সুদর্শন ধীরেন্দ্রনাথ এবং পরিচালনায় নীতীশ লাহিড়ী। এরপর ‘যশোদানন্দন’ ও ‘সাধু কি শয়তান’ ছবি দু-খানি তিনি পরিচালনা করেন। এতে অভিনয়ও করেন। ১৯২২খ্রি. এই প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেলে হায়দ্রাবাদে ফিরে লোটাস ফিলম কোম্পানি নামে প্রতিষ্ঠান গড়ে ১৯২৩-২৭খ্রি. মধ্যে ৯টি ছবি করেন। মুম্বাইতে কিছুদিন চিত্র পরিবেশক অফিস চালিয়েছিলেন এবং মঞ্চের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। ১৯২৮খ্রি. কলকাতায় ফিরে বিট্রিশ ডোমেনিয়ন ফিলম কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। এই প্রতিষ্ঠানে মোট ৮টি চিত্র নিমার্ণ করেন। প্রথম চিত্র ‘ফ্লেমস অফ ফ্লেস’। ১৯৩০খ্রি.-র পর সবাক ছবি শুরু হলে তিনি বি.এন. সরকারের আহ্বানে নিউ থিয়েটার্সের হয়ে ‘মাসতুতো ভাই’, ‘একসকিউজ মি স্যার’, ‘ভক্ত কবীর’, ‘অচিন প্রিয়া’ প্রভৃতি ছবি করেন। এরপর ইস্ট ইন্ডিয়া ফিলম কোম্পানিতে যোগ দিয়ে ১৯৩২-৪০খ্রি. মধ্যে বাংলা, হিন্দি ও উর্দু মিলিয়ে কয়েকটি ছবি করেন। তাঁর ‘দাবী’ ছবিটি সেকালে খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল। তিনিই প্রথম সম্ভ্রান্ত ঘরের মেয়েদের চলচ্চিত্রে নামান। তাঁর স্ত্রী প্রেমলতিকা ওরফে রমলা দেবীকে এবং মেয়ে পারুল ও মণিকাকে ছবিতে অভিনয় করিয়েছেন। এক সময় মণিকাকে বলা হত বাংলা ছবির ‘শার্লি টেম্পল’। ৪০ বছর সিনেমাশিল্পে জড়িত থাকার পরে ‘তারকা পদ্ধতি’ চালু হলে এই শিল্প ছেড়ে দেন। মোট ২৪টি নির্বাক ও ২৫টি সবাক ছবি করেন। শেষ ছবি ‘কারটুন’ (১৯৫৮)। ১৯৭২খ্রি. আশি বছর বয়সে কলকাতার মঞ্চে ‘অলীকবাবু’ নাটকে তরুণ নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করে সকলকে চমকে দিয়েছিলেন। ভারতীয় চলচ্চিত্র জগতে তাঁর অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ‘পদ্মভূষণ’ (১৯৭৪) এবং ‘দাদা সাহেব ফালকে পুরস্কার’ (১৯৭৬) লাভ করেন।
তথ্যসূত্র: সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান।