ধানসিড়ি (নদী)

Barisalpedia থেকে

বাংলা কবিতার সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত এবং সবচেয়ে বেশি উদ্ধৃত একটি লাইন- ‘আবার আসিব ফিরে ধানসিড়িটির তীরে এই বাংলায়’। বাংলা কবিতার এই অমর পংক্তিতে অমরত্ব লাভ করা নদী ধানসিড়ি ভৌগোলিক বাস্তবতায় রাজাপুর ও ঝালকাঠিকে সংযুক্ত করেছে। রাজাপুর থানাশহরের পার্শ্ববর্তী বাঘড়ি হাট থেকে শুরু করে ঝালকাঠি শহরের নিকটবর্তী গাবখান খাল ও বিষখালী নদীর সঙ্গমস্থলে পতিত হয়ে এ নদী বা খালটির প্রবাহপথের সমাপ্তি ঘটেছে। উত্তর-দক্ষিণে বিস্তৃত এই প্রবাহপথের দৈর্ঘ্য ৭ কিলোমিটারের বেশি নয়।

ধানসিড়ি.jpg

ধানসিড়ির পূর্ব পরিচয়

যে নদীটিকে দুনিয়া জুড়ে এমন অমর করে রেখে গেলেন কবি জীবনানন্দ, সেই নদীটির আসল নাম কিন্তু ধানসিড়ি নয়। তার আসল নাম ‘ধানসিদ্ধ’। আবার নদী বলতে যে বিপুল জলপ্রবাহ বোঝায়, এটি তা-ও নয়। আসলে এটি রাজাপুর ঝালকাঠিকে সংযোগকারী একটি খাল। পুরনো যে কোন মৌজা ম্যাপ বা অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ম্যাপে এই নদী বা খালের নাম ইংরেজি বানানে লিখিত ছিল উযধহংরফযধ। এমনকি ১৯৯০-এর দশকে ‘গ্রাফোসম্যান’ কর্তৃক প্রণীত উপজেলা ম্যাপেও এর বানান দেখা যায় উযধহংরফযধ। কিন্তু বাংলা বানানে এর রূপ ‘ধানসিদ্ধ’ থেকে ‘ধানসিড়ি’তে রূপান্তরিত হয়ে গিয়েছিল অনেক আগে বরিশালের শ্রেষ্ঠ কবি জীবনাননন্দের হাতে। বাংলার ‘ড়’ ধ্বনির সাথে ইংরেজি ‘ফ’ ধ্বনির দোস্তির বরাতে জীবনানন্দ কাব্যের জাদুকাঠি ছুঁইয়ে ‘ধানসিদ্ধ’কে বানিয়ে দিলেন ‘ধানসিড়ি’। কবিতার গীতল ধ্বনিতে জন্মলাভ করা সেই ধানসিড়ি এখন আসল ধানসিদ্ধ থেকে আদি না হলেও অনেক আসল ও অনেক আপন। উল্লেখ করা যায় যে, খালটির নাম ধানসিদ্ধ হওয়ার পিছনে একটি কারণ আছে বলে এতদঞ্চলের মানুষেরা মনে করেন। তারা বলে থাকেন, এই খালের পাড়ে হাইলাকাঠি ও চর-হাইলাকাঠি গ্রামের লোকেরা এত পরিমাণ ধান সিদ্ধ করতো যে সেই ধান সিদ্ধ করার পানি প্রবাহের এই খালটির নামই হয়ে যায় ধানসিদ্ধ। এটি বিশ্বাসযোগ্য কোনো বয়ান না হলেও এ গল্প এতদঞ্চলের এক সময়কার ধানের উচ্চ ফলন সম্পর্কে ধারণা দেয়।

জীবনানন্দের সাথে ধানসিড়ির সম্পর্ক

কবি জীবনানন্দের সাথে এই নদীর বা খালের পরিচয় হয় বরিশাল থেকে কোলকাতা যাওয়ার পথে। ১৮৮৪ সালে বেঙ্গল সেন্ট্রাল ফ্লোটিলা কোম্পানী যখন বরিশাল-খুলনা স্টীমার চালু করেছিল তখন হয়তো সে স্টীমার ধানসিড়ির ওপর দিয়ে যেতো না, কেননা বেভারিজ ১৮৭৬ সালে তাঁর হিস্ট্রি অব বাকেরগঞ্জ প্রকাশের সময় লিখেছেন যে কয়েক বছর আগে বারো হাজার টাকা ব্যয়ে গাবখান খালটি গভীর ও প্রশস্ত করা হয়েছে (পৃ. ১৭)। অনুমান করা যায় যে খালটি প্রশস্ত করা হয়ে থাকবে পরিকল্পিত স্টীমার সার্ভিসের জন্যই। তবে শুরুতেই খালটি খনন করার প্রয়োজনীয়তা থেকে বোঝা যায় প্রাকৃতিক কারণে এই খালের ভরাটের প্রবণতা ছিল। হয়তো দুই দশকের মধ্যে খালটি সিল্টেশনের কারণে অগভীর হয়ে উঠলে এই রুট পরিবর্তন করে স্টীমার সার্ভিসটি বরিশাল থেকে ঝালকাঠি হয়ে রাজাপুরের বাঘড়ি-বলারজোড় খাল ধরে কাউখালি এবং সেখান থেকে খুলনার পথে চলাচল শুরু করেছিল। খোসাল চন্দ্র রায়ের বাকরগঞ্জের ইতিহাস -এর সংযোজন-১ অংশের তথ্য মোতাবেক বলা যায় যে ১৮৯৮ সাল থেকে বরিশাল-খুলনা স্টিমার সার্ভিসটি ঝালকাঠি থেকে ছেড়ে গাবখান খালে না ঢুকে ধানসিড়িতে ঢুকতো এবং রাজাপুরের বাঘড়ি-বলারজোড় খাল ধরে কাউখালি হয়ে খুলনা যেতো। ১৮৯৬ সালে ফ্লোটিলা কোম্পানি বন্ধ হয়ে গেলে ‘ইন্ডিয়া জেনারেল’ এবং ‘রিভারস স্টিম’ কোম্পানীর বরিশাল-খুলনা স্টীমার সার্ভিস চালু করে। ফলে অনুমান করা যায় জীবনানন্দ দাশ ১৯৩০-এর দশকে এর কোনো স্টিমারে চড়েই কোলকাতা যাওয়ার জন্য বরিশাল থেকে খুলনা যেতেন। কল্পনা করা যায় যে, ধানসিদ্ধ নামের খালটিতে স্টীমার ঢোকার পরে খালের দুই পাড়ের মায়াবী দৃশ্য চলন্ত স্টীমারের যাত্রী হিসেবে তিনি এত কাছে থেকে দেখতেন যে সেই খাল ও তার পাড়ের দৃশ্যের প্রতি তাঁর এক গভীর মায়া জমে যায়। হয়তো তিনি শুনলেন খালটির নাম ধানসিদ্ধ। নামটি তাঁর পছন্দ হলো না। কাব্যিক ভাষার জাদুর কাঠি ছুঁইয়ে তিনি নামটি পাল্টে দিলেন ধানসিড়ি রূপে এবং রেখে গেলেন সারা বাংলার কাছে তাঁর আকুতি- ‘আবার আসিব ফিরে ধানসিড়িটির তীরে এই বাংলায়- - ’।

ধানসিড়ির সাথের অন্য নদীর নাম পরিবর্তন

জীবনানন্দের জাদুর কাঠি শুধু ধানসিড়িকেই ছুঁয়ে যায়নি। ধানসিড়ির সাথে সংযুক্ত অন্য জলপ্রবাহগুলোও তাঁর এই কাব্যের জাদুকাঠিতে কাব্যিকভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। ধানসিড়ি তার উত্তর প্রান্তে যেখানে গাবখান খালের সাথে মিশেছে তার খানিক দক্ষিণে পশ্চিম দিক থেকে আগত একটি ছোট জলপ্রবাহ ধানসিড়ির সাথে মিশেছে। তদস্থানের গ্রামের নামানুসারে উক্ত জলপ্রবাহ বা খালের নাম রূপসিয়ার খাল। জীবনানন্দ তাঁর অমর সনেট ‘আবার আসিব ফিরে’-এর দ্বাদশ পংক্তিতে লিখেছেন ‘রূপসার ঘোলা জলে হয়তো কিশোর এক সাদা ছেঁড়া পালে/ ডিঙ্গা বায়’। এই রূপসাকে খুলনা নগরীর নিকটস্থ রূপসা নদী বলে জ্ঞান করা খুব যুক্তিযুক্ত নয়। যিনি ধানসিড়ির তীরে ফিরে আসবেন তাকে খুলনাস্থ রূপসা নদীতে ডিঙ্গা বাইতে দেখার চেয়ে ধানসিড়ির সন্নিকটস্থ কোনো নদী বা খালে ডিঙ্গা বাইতে দেখাই স্বাভাবিক। এ থেকেই যুক্তিযুক্তভাবে অনুমিত হয় যে, জীবনানন্দ এই পংক্তিতে ‘রূপসা’ দ্বারা খুলনার রূপসাকে নয়, বরং ধানসিড়ির উত্তর প্রান্তে ধানসিড়ির সাথে মিশে যাওয়া রূপসিয়া খালকে বুঝিয়েছেন। কবিতার ধ্বনি-গীতলতার সাথে সাযুজ্যপূর্ণ করে তুলতে ধানসিদ্ধকে তিনি যেমন ধানসিড়ি বানিয়ে ফেলেছেন তেমনি সনেটের পংক্তিগত মাত্রার সাথে মিল তৈরির সুবাদে হয়তো তিনি রূপসিয়াকে ‘রূপসা’য় পরিবর্তন করে নিয়েছেন।

এমন কাব্যিক পরিবর্তন জীবনানন্দের হাতে সাধিত হয়েছে ধানসিড়ির সাথে সংযুক্ত আরো একটি নদীর ক্ষেত্রে। নদীটির নাম জাঙ্গালিয়া। জীবনানন্দ তাঁর সনেট ‘আবার আসিব ফিরে’-এর অষ্টম পংক্তিতে লিখেছেন ‘জলাঙ্গীর ঢেউয়ে ভেজা বাংলার এই সবুজ করুণ ডাঙ্গায়’। ধানসিড়ির দক্ষিণপ্রান্তে বাঘড়ি হাটের কাছে ধানসিড়ি নদীটি দুইদিকে বিভক্ত হয়ে গিয়েছে। পূর্বদিকের প্রবাহটি বাঁক পরিবর্তন করে ‘জাঙ্গালিয়া’ নাম ধারণ করেছে। পশ্চিম দিকের প্রবাহটির নাম হয়েছে ‘বলারজোড়’ খাল। জীবননান্দের স্টিমার ঢুকতো পশ্চিম দিকে বলারজোড় খালে। তবে স্টিমারটি বাঁক পরিবর্তনের সময় স্বাভাবিকভাবেই দেখা যেত জাঙ্গালিয়ার পূর্ব-দক্ষিণমুখী ধূ-ধূ বিস্তার। অনুমিত হয় কবিতার অষ্টম পংক্তির ‘জলাঙ্গী’ শব্দটি এই জাঙ্গালিয়া নামেরই কাব্যিক রূপান্তর। ‘জল+অঙ্গী’ রূপ সন্ধিতে সাধিত ‘জলাঙ্গী’ শব্দটি সাধারণ অর্থে নদী বোঝাতে পারে বলেই কোনো পাঠকের এই শব্দ-উৎস অনুসন্ধানের প্রয়োজন পড়েনি। তবে আমরা ন্যায়ত অনুমান করতে পারি যে, জলাঙ্গী শব্দটি ‘জাঙ্গালিয়া’র ধ্বনিগত কাব্যিক রূপান্তর। জীবনানন্দের পারঙ্গমতা এখানেই যে, এই রূপান্তরকে বুঝতে না পারলেও কবিতার ঈপ্সিত অর্থে পৌঁছতে পাঠকের কষ্ট হয় না কারণ রূপান্তরিত নাম-রূপ ধ্বনিগুচ্ছটিকে তিনি একটি অর্থবহ শব্দের মোড়কে আটকে দিতে পেরেছেন।

উপসংহার

এমন অনেক কাব্যিক পরিবর্তনের নদীটি আজ ভৌগোলিক বাস্তবতায়ও যারপরনাই পরিবর্তিত হয়ে আছে। যে নদীতে এক সময় চলতো স্টিমার সেই নদীতে এখন নৌকা চলার মতো পানিও থাকে না বছরে অন্তত ছয় মাস। তবে ধানসিড়ির বুকে পানি থাক আর না থাক, বাংলার মাটির বুকে ধানসিড়ি নামে কোনো নদী বা খাল কিছুই থাক আর না থাক, বাংলা সাহিত্য যতদিন থাকবে ধানসিড়ি ততদিন প্রবহমান থাকবে পদ্মা মেঘনার চেয়ে প্রমত্তারূপে আমাদের কাব্য অনুভবের হৃদয় জুড়ে।


তথ্যউৎস: ১. মুহম্মদ মুহসিন। চরিতাভিধান: রাজাপুরের গুণী ও বিশিষ্টজন। নালন্দালোক, ঢাকা। ২০১০। ২. এইচ বেভারিজ। দি ডিস্ট্রিক্ট অব বাকেরগঞ্জ। ট্রাবনার এন্ড কোং, লন্ডন। ১৮৭৬।