তালগাছিয়ার পির সাহেব
ঝালকাঠি জেলার কাঠালিয়া থানাধীন তালগাছিয়ার পীরসাহেব হযরত মাওলানা মকসুদুল্লাহ (রহ.) এতদঞ্চলের একজন বিশিষ্ট ইসলামী সাধক ও বুজুর্গ ব্যক্তি। তিনি ১২৯০ সনে (বাংলা) পবিত্র শুক্রবারে জন্ম গ্রহণ করেন। পিতার নাম মৌলভী গাজী ছানাউল্লাহ (রঃ)। মাতার নাম মোহতারিমা আমেনা খাতুন।
বাল্যকাল ও শিক্ষাজীবন
মক্তবে কোরানের তালিম নেয়ার মধ্য দিয়ে জনাব মকসুদুল্লাহর শিক্ষাজীবন শুরু। সাথে সাথে তিনি কোরান হেফজও করেন। মকসুদুল্লাহ সাহেবের পিতা ইন্তেকাল করেন বাংলা ১৩০৫ সালে। দাদা জীবিত ছিলেন। তিনি তাকে কাঠালিয়ার কচুয়া মাদ্রাসায় ভর্তি করে দেন। কালকিনির একজন বিশিষ্ট আলেমে দ্বীন হযরত মাওলানা সাঈদ আহমদ সাহেবের কাছে তাঁকে সোপর্দ করেন মকসুদুল্লাহ সাহেবের দাদা। ১৩১৬ সালে উস্তাদ মাওলানা সাঈদ আহমদ সাহেবের পরামর্শক্রমে ভারতের দেওবন্দ মাদ্রাসায় তিনি চলে যান।
দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাসায় পড়বার সময় তিনি বিখ্যাত আলেম হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানবী (রঃ)-এর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। এ দেশের আরও কয়েকজন ছাত্র মকসুদুল্লাহ সাহেবসহ দেওবন্দে ছিলেন। তন্মধ্যে ছিলেন জয়নুল আবেদীন, মোঃ ইয়াসীন, মনসুর আহমদ ও ফজর উদ্দীন। দেওবন্দে এসে তিনি প্রথমে হযরত আশরাফ আলী থানবী (রঃ)- এর সাক্ষাৎ প্রার্থনা করেন। প্রথম সাক্ষাতে তিনি হাফেজ মকসুদুল্লাহকে তিনটি প্রশ্ন করেন: কোথা থেকে এসেছো, কে পাঠিয়েছে এবং কেন? হাফেজ মকসুদুল্লাহ সাহেবও প্রশ্ন তিনটির একই সাথে উত্তর দিয়েছিলেন। তিনি উত্তর দেন, বাংলা থেকে মাওলানা সাঈদ সাহেব পাঠিয়েছেন শরীয়ত এবং মারেফত শিক্ষার জন্য। হযরত থানবী (রঃ) তার জবাবে অত্যন্ত খুশী হলেন এবং ভাবলেন ভবিষ্যতে প্রখর মেধা সম্পন্ন ব্যক্তি হবে হাফেজ মকসুদুল্লাহ। থানবী (রঃ) এর নজরে ঐ দিন থেকেই হাফেজ মকসুদুল্লাহ সাহেব পড়ে যান। তিনি কেতাবাদী তালিমের জন্য হাফেজ মকসুদুল্লাহকে হাসানপুরের হযরত আলী আহমদের কাছে পাঠিয়ে দেন। অন্যরাও হাফেজ মকসুদুল্লাহ সাহেবের সাথে হাসানপুরে যান।
মাওলানা সাঈদ আহমদ সাহেব হযরত থানবী (রঃ)-এর কাছে পত্র লিখে পাঁচজন ছাত্রের হালত জানতে চাইলেন। উত্তরে থানবী সাহেব জানালেন, একজন কুতুব এবং একজন বুজুর্গ হবে। ঐ পাঁচজন ছাত্রের মধ্যে একজনকে অত্যন্ত ন¤্র ভদ্র এবং সদালাপী পরহেজগার এবং সর্ববিষয়ে এখনই ভাল মনে হয়। অবশ্য তিনি নাম উল্লেখ করেননি কিন্তু হাফেজ মকসুদুল্লাহ (রঃ) কেই ইশারা করেছেন। হাসানপুর এবং কিছুদিন সাহরানপুরে অধ্যয়নের পর হাফেজ মকসুদুল্লাহ (রঃ) পুনরায় দেওবন্দ আসেন। ইলমে শরীয়াত এবং মারেফাতের শিক্ষা এবং কামেলিয়াত হাসেল করবার সময় অধিকাংশ সময় তিনি হযরত আশরাফ আলী থানবী সাহেবের দরবারেই কাটাতেন। অল্প দিনের মধ্যেই তিনি হযরত থানবী সাহেবের খেলাফত প্রাপ্ত হন। ভারতের যে স্থানে হাফেজ মকসুদুল্লাহ সাহেব থাকতেন, তথা হতে ১৩ মাইল দূরে গিয়ে তিনি হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানবী (রঃ) সাহেব-এর সাথে সাক্ষাত এবং মোলাকাত করতেন।
মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা ও তাবলীগে দ্বীন
চার তরীকার খেলাফত প্রদান করে হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানবী (রঃ) সাহেব হযরত মাওলানা হাফেজ মকসুদুল্লাহ (রঃ) কে বাংলা ১৩২৬ সালে বাংলাদেশে নিজ মাতৃভুমিতে পাঠান দ্বীনের তাবলীগের জন্য এবং হেদায়েতের জন্য। দেওবন্দ থেকে চলে এলেন নিজ দেশ কাঁঠালিয়ার তালগাছিয়াতে। হাফেজ মকসুদুল্লাহ (রঃ) দীর্ঘদিন কচুয়া মাদ্রাসায় মোহতামিম পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। হযরত হাফেজ মকসুদুল্লাহ (রঃ) নিজ জন্মভূমি তালগাছিয়ায় নিজ বাড়িতে দরসে নেজামি বা কওমি একটি মাদ্রাসা স্থাপন করেন, যার নাম দেন মাদ্রাসায়ে আশরাফিয়া এমদাদিয়া। এখানে একটি হাফেজী মাদ্রাসা ও একটি মসজিদও প্রতিষ্ঠা করেন। মসজিদের নাম দেন বায়তুল মামুর। দেশের মানুষ হযরত মাওলানা মকসুদুল্লাহ (রঃ) এর খবর শুনে দলে দলে তার কাছে আসতে লাগল এবং দ্বীন প্রচারের কার্যে তার সহযোগী হিসেবে নাম লিখাতে লাগল। তিনি জীবদ্দশায় অনেক মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন। তার মধ্যে অন্যতম বরিশালের আশরাফুল উলুম, কাঠালিয়ার লতাবুনিয়া, কৈখালী মাদ্রাসা ও ভান্ডারিয়ার পৈকখালী মকসুদুল উলুম মাদ্রাসা।
কারামাত
একবার বেতাগী থানার হাজী দেলোয়ার নামে হুজুরের এক মুরীদ তাঁর কাছে এসে কেঁদে কেঁদে জানালেন হুজুর আমার একটি মামলা আছে কোর্টে। কিন্তু কোর্টের নোটিস আমি হারিয়ে ফেলেছি। উকিল জানিয়েছে নোটিস না পেলে জমি নিলাম হয়ে যাবে। এখন আমি কি করি। হুজুর তার হাতে এক টুকরা আদা দিয়ে বললেন কোটে যাবার সময় এই আদাটুকু চিনি মিশেয়ে খাবে। হাজী দেলোয়ার একটি কাগজ পেঁচিয়ে চিনি আর আদা সাথে নিয়ে তারিখের দিন কোর্টে গেলেন। আদা চিনি খেতে খেতে কোর্টের বারান্দায় হাঁটছেন। আর চিনি পেঁচানো কাগজের টুকরোটি দেখতে দেখতে সামনে এগুচ্ছেন। হঠাৎ দেখছেন সেই কগজের টুকরাটিই তার হারানো কোর্টের নোটিস। এভাবে বহু কারামত হযরত হাফেজ মকসুদুল্লাহ সাহেবের রয়েছে।
তথ্যসূত্র: আবদুর রশীদ। এই সেই ঝালকাঠি। আল ইসলাম পাবলিকেশনস, ঝালকাঠি। ২০০১।