তপন রায়চৌধুরী, ড.

Barisalpedia থেকে

অধ্যাপক তপন রায়চৌধুরী (জন্ম ৮ মে, ১৯২৬ - মৃত্যু ২৬ নভেম্বর, ২০১৪) একজন ভারতীয় ইতিহাসবেত্তা যিনি ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতবর্ষের ইতিহাস রচনার জন্য প্রসিদ্ধ। তিনি দীর্ঘকাল অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ভারতীয় ইতিহাস ও সভ্যতা বিষয়ে শিক্ষকতা করেন।

তপন রায়চৌধুরী.jpg


শিক্ষাজীবন

অধ্যাপক ড. তপন রায়চৌধুরীর জন্ম ৮ মে ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে, বাংলাদেশের বরিশাল শহরের নাবালক লজ নামক বাড়িতে (অধুনালুপ্ত বিউটি সিনেমা হল ভবন)। অবশ্য তাঁর আদি পূর্বপুরুষের বাড়ি ঝালকাঠি জেলার কীর্তিপাশায গ্রামে। তাঁর পিতার নাম অমিয় কুমার সেন। তিনি বরিশাল জিলা স্কুল থেকে ১৯৪১ সালে ম্যাট্রিকুলেশনে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অবিভক্ত বাংলায় প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন। এরপর স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে আইএ, প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইতিহাসে বিএ অনার্স এবং কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স। সরকারি কলেজে প্রথম শিক্ষকতা শুরু করেন সেন্ট্রাল ক্যালকাটা কলেজে (বর্তমান মৌলানা আজাদ কলেজ) ১৯৪৯ সালে। এরপর কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর বিভাগে ইসলামের ইতিহাসের লেকচারার পদে যোগদান করেন এবং কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইন্দুভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের তত্ত্বাবধানে গবেষণা করে প্রথম ডি-ফিল ডিগ্রি অর্জন করেন।

কর্মজীবন

১৯৫৩ সালে তপন রায়চৌধুরী স্টেট স্কলারশিপে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন পুনরায় ডি-ফিল ডিগ্রির জন্য। ডিগ্রি নিয়ে ১৯৫৭ সালে দেশে ফিরে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্কাইভসে ডেপুটি ডিরেক্টর পদে যোগদান করেন। এরপর দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্কুল অব ইকোনোমিকসে অর্থনৈতিক ইতিহাসের রিডার এবং পরবর্তীতে উক্ত স্কুল অব ইকোনোমিকসের ডিরেক্টর। ১৯৭১ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক। ১৯৭৩ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক ইতিহাসের রিডার হিসেবে যোগ দেন। চাকুরিটি অক্সফোর্ডে হলেও মূলত এরপর থেকে তিনি পড়াতে শুরু করেন সারা দুনিয়ায়। আমেরিকার হার্ভার্ডে, ক্যালিফের্নিয়ায়, পেনসিলভানিয়ায়, অস্ট্রেলিয়ায়, মেক্সিকোতে, ফ্রান্সে বিভিন্ন সময়ে মাসের পর মাস তিনি ভারতীয় ইতিহাস ও সভ্যতার ওপর পড়িয়েছেন। ১৯৯৩ সালে সারা জীবনের ইতিহাসচর্চার পুরস্কার হিসেবে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি ডি.লিট. প্রদান করে। একই বছর এ্যাড হোমিনেম অধ্যাপক হিসেবে উক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জনাব রায়চৌধুরী অবসর গ্রহণ করেন। তবে অবসর গ্রহণ করলেও আমৃত্যু তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্ট এ্যান্টনিস কলেজের প্রফেসর এমেরিটাস ছিলেন।


গ্রন্থাবলি

এই দুনিয়াজোড়া খ্যাতির প্রফেসর যতটুকু পড়িয়েছেন এবং পড়েছেন তার তুলনায় লিখেছেন অনেক কম। কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বসে যে গবেষণার কাজটি করেছিলেন সেটি পঞ্চাশের দশকে এ. মুখার্জী এন্ড কোম্পানি গ্রন্থরূপে বের করে Bengal Under Akbar & Jahangir: An Introductory Study in Social History নামে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ডি-ফিল ডিগ্রির জন্য লিখিত থিসিস থেকে জন্ম নেয় Jan Company in Coromandel। এটি হল্যান্ড থেকে ডাচ ভাষায়ও প্রকাশিত হয়। ঐতিহাসিক ইরফান হাবিবের সাথে যৌথভাবে সম্পাদনা করেন The Cambridge Economic History of India । বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত হওয়া তাঁর কিছু প্রবন্ধ জড়ো করে জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা শালিনী রনধেরিয়া গ্রন্থ আকারে বের করেনPerceptions, Emotions, Sensibilities: Essays on India's Colonial and Post-colonial Experiences নামে। ১৯৮৭ সালে Europe Reconsidered: Perception of the West in Nineteenth Century Bengal গ্রন্থের ভিত্তিতে জনাব তপন রায়চৌধুরী রবীন্দ্র পুরস্কারে ভূষিত হন। ১৯৯২ সালে দেশ পত্রিকায় তিনি প্রথম বাংলায় লেখেন দেশবিভাগ বিষয়ে তাঁর স্মৃতিকথা। আনন্দ পাবলিশার্স থেকে উক্ত স্মৃতিকথা রোমন্থন অথবা ভীমরতিপ্রাপ্তর পরচরিতচর্চা নামে গ্রন্থ আকারে বের হয়। মূলত এই বইটিই বাঙালির ঘরে ঘরে লেখক তপন রায়চৌধুরীকে পৌঁছে দেয়। এই গ্রন্থের অগণিত পাঠকের তাগিদেই ২০০৭ সালে তিনি স্মৃতিকথাভিত্তিক আরো একটি গ্রন্থ বাংলায় লেখেন বাঙালনামা নামে। ২০১২ সালে বিখ্যাত প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান Harper & Collins অনেকটা বাঙালনামার আদলে লিখিত The World in Our Time: A Memoir নামে জনাব রায়চৌধুরীর ইংরেজি গ্রন্থটি প্রকাশ করে। বলা যায় বাঙালনামার এই ইংরেজি রূপ পড়েই আরেক ভুবনবিখ্যাত বাঙালি অমর্ত্য সেন আবেগের সাথে এই গ্রন্থ সম্পর্কে লিখেছিলেন- A wonderful account, by one of the leading historians of India, of the story of his life and of the class of landlords of Bengal to which his family belonged... This is a superb book । অবশ্য তপন রায়চৌধুরী আরেকটি বই লেখার মানসে অনেকদিন ধরে অনেক যোগাড়যন্ত্র করেছিলেন বলে বাঙালনামায় উল্লেখ করেছেন। বইটির বিষয় হবে বাঙালি মানসের ইতিবৃত্ত তা-ও তিনি উল্লেখ করেছেন। তবে শেষ পর্যন্ত সেই বইটি আমাদেরকে না দিয়েই লেখক ও ঐতিহাসিক তপন রায়চৌধুরী আমাদেরকে বিদায় জানিয়ে চলে গেলেন।

সম্মাননা

  • অ্যামেরিকান হিস্টোরিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন গোল্ড মেডেল, ১৯৯০
  • ডক্টর অব লেটার্স, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি, ১৯৯৩
  • ডক্টর অব লেটার্স, ইউনিভার্সিটি অব ক্যালকাটা, ২০০৫
  • পদ্মভূষণ (ভারত), ২০০৭
  • ন্যাশনাল রিসার্চ প্রফেসর (ভারত), ২০১০

মৃত্যু

২০১৪ সালের ২৬ নভেম্বর বুধবার সন্ধ্যা ৬টায় অক্সফোর্ডের বাড়িতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।