ছাত্র ফেডারেশন, বরিশাল

Barisalpedia থেকে

বরিশালের ছাত্র সংগঠনের মধ্যে ছাত্র ফেডারেশন ও নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগ শক্তিশালী ছিল। মুসলিম ছাত্রলীগ মুসলিম লীগের সমর্থক ছিল। ছাত্র ফেডারেশনের সদস্যরা কমিউনিষ্ট পার্টি, আরএসপি, ফরওয়ার্ড ব্লকের সমর্থক ছিল। অনেকে আবার কংগ্রেস ও কৃষক প্রজা পার্টির অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। সংগঠন ও সদস্য সংখ্যায় ছাত্র ফেডারেশন সবচেয়ে বৃহৎ ছিল।


প্রতিষ্ঠার ইতিহাস

বরিশালের ছাত্র সমাজ বিশ শতকের প্রথম ভাগে অনুশীলন ও যুগান্তর দলের সমর্থক ছিল এবং অনেকে সশস্ত্র বিপ্লবে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত কোন সুসংগঠিত ছাত্রদল ছিল না। ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে কমিউনিস্ট পার্টির কয়েকজন সদস্য আইএ ও বিএ পাস করে কলকাতায় যান। তারা ছিলেন অমৃত নাগ, প্রমথ সেন, রমেশ ভট্টচার্য ও অমিয় দাশগুপ্ত। তাদের ওপর ভার ছিল কলকাতার রাজনীতির সাথে যোগাযোগ রক্ষা করা। অমিয় কুমার দাশগুপ্ত আইএ পাস করেন এবং ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় বিএ পড়তে যান। মূলত তাঁর চেষ্টায় বরিশালে ছাত্র ফেডারেশন গঠিত হয়। তিনি ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে এমএ পরীক্ষায় অর্থনীতিতে প্রথম শ্রেণী লাভ করে বরিশালে আসেন। তরুণ সংঘ, শংকর মঠ, বরিশাল কমিউনিষ্ট পার্টির হাতে লেখা পত্রিকা ‘স্ফুলিঙ্গ’ ও ‘লাল নিশান’ ছাত্রদের মধ্যে প্রগতিশীল চিন্তার বিকাশ ঘটাতে সহায়তা করে। ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে বরিশালে ছাত্র ফেডারেশনের সম্মেলন এবং চাঁদসীর কৃষক সম্মেলন বরিশাল কমিউনিষ্ট পার্টির দিকচিহ্নস্বরূপ। ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে বরিশাল ছাত্র ফেডারেশনের প্রথম কার্যকরী কমিটি গঠন করা হয়। ফনী রায়, কিষান দাশগুপ্ত, দেব প্রসাদ ব্যানার্জী, কানাই রায়, শোভা রায়, সুহাসিনী সেন প্রমুখ কমিটির সদস্য ছিলেন। ফনী রায় কমিটির সম্পাদক নির্বাচিত হন। ছাত্র ফেডারেশন যুক্তফ্রন্ট নীতিতে বিশ্বাসী ছিল। ছাত্র ফেডারেশনে কমিউনিষ্ট, অনুশীলন, যুগান্তর, তরুণ সংঘ, রায় বাদী দলের প্রতিনিধি ছিল।


ছাত্র ফেডারেশনের কার্যক্রম

১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে পটুয়াখালীতে ছাত্র ফেডারেশনের সম্মেলন হয়। ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে ছাত্র ফেডারেশনের সম্পাদক ছিলেন নুটু ব্যানার্জী। ছাত্র ফেডারেশন ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে বরিশালে এমএন রায়কে সংবর্ধনা জানায়। ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে ফেডারেশনের সম্পাদক ছিলেন মিন্টু বসু। সৈযদ শাহ আলম চৌধুরী যুগ্ম সম্পাদক এবং নূরুল ইসলাম খান সহকারী সম্পাদক ছিলেন। ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে নাগপুরে ছাত্র ফেডারেশনের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। বরিশাল হতে অনেক ছাত্র সম্মেলনে যোগ দেন। আহসান উল্লাহ (আমতলী), শামসুদ্দিন আবুল কালাম (ঔপন্যাসিক), নূরুল ইসলাম খান সুলতান, সৈয়দ শাহ আলম ট্রেনে একত্রে নাগপুর থেকে ফিরছিলেন। আলিগড়ের নিকট ষ্টেশন থেকে ওঠার সময় সৈয়দ শাহ আলম পড়ে যান এবং ট্রেনে চাপা পড়ে মারা যান। তাকে সেখানে কবর দেয়া হয়। বিভিন্ন পত্রিকায় শাহ আলমের মর্মান্তিক মৃত্যু খবর ছাপা হয়। সুভাষ চন্দ্র বসু শাহ আলমের মাতাকে শোকবাণী পাঠিয়েছিলেন। শাহ আলম ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে মুলাদী থানার সৈয়দেরগাঁও গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা সৈয়দ বদরুদ্দোজা ফজলে উল্লাহ। শাহ আলম জেলা স্কুলের ছাত্র থাকাকালে অনুশীলন দলে যোগ দেন। তিনি মাদারীপুর মহকুমার ইদিলপুর স্কুল হতে মেট্রিক পাস করে বিএম কলেজে ভর্তি হন। তিনি ছাত্র ফেডারেশনের যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন।

১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দে জ্যোতি ব্যানার্জী এবং ১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দে সীতাংশু মজুমদার ফেডারেশনের সম্পাদক ছিলেন। ১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দে উৎপল সেন, ১৯৪৪ খ্রিষ্টাব্দে ব্রজগোপাল ভট্টাচার্য, ১৯৪৫-৪৬ খ্রিষ্টাব্দে প্রশান্ত দাশগুপ্ত সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রæয়ারি মাসে বরিশাল জেলায় ছাত্র ফেডারেশনের ৮ম বার্ষিক সম্মেলন টাউন হলে অনুষ্ঠিত হয়। এসময় জেলায় ফেডারেশনের সদস্য সংখ্যা দুহাজারের বেশি ছিল। এ সম্মেলনে কলকাতা হতে অম্বিকা চক্রবর্তী, নিরঞ্জন সেন, নৌবিদ্রোহের নেতা শেখ শাহাদাৎ আলী, সাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রাদেশিক ছাত্র ফেডারেশনের পক্ষে অলকা মজুমদার, রাখাল দত্ত প্রমুখ যোগ দিয়েছিলেন। অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি ছিলেন শিক্ষাবিদ অসিত রঞ্জন ভট্টাচার্য। টাউন হল স্থানের নাম দেয়া হয় দেবব্রতনগর। কলকাতা রশীদ আলী দিবসে শহীদ ছাত্র দেবব্রত ছিলেন বরিশালের সন্তান। সম্মেলনে স্বদেশ বসু জেলা ফেডারেশনের সম্পাদক ও ব্রজগোপাল ভট্টাচার্য সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন।

১৯৩৮ হতে ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ছাত্র ফেডারেশনের যারা কর্মী ছিলেন তারা হলেন ফণী রায়, জ্যোতি ব্যানার্জী, নুটু ব্যানার্জী, মিন্টু বসু, সৈয়দ শাহ আলম, সুনীল সেন, নূরুল ইসলাম খান, রফিকুল ইসলাম, ভুলু সেন, অরবিন্দ সরকার, সুব্রত দাশগুপ্ত, অবণী মুখার্জী, যতীন সমদ্দার, অজয় সেন, নারায়ণ সাহা, মুজিবর রহমান চৌধুরী, মোজাম্মেল হক, আবদুস শহীদ, কেরামত আলী, শামসুদ্দিন আবুল কালাম, জাহাঙ্গীর, সুশীল চক্রবর্তী, নারায়ণ সাহা, স্বদেশ বসু, সুজাতা গুপ্তা, তৃপ্তি দাশগুপ্ত, ঝর্ণা ব্যানার্জী, কল্যাণী দাশগুপ্ত, রতন গুপ্ত, সরল রায় ভট্টাচার্য, বঙ্কিম চ্যাটার্জী, সাধন দাশগুপ্ত, কালিপদ সেন, মোশারফ হোসেন নান্নু, তপন পিপলাই, রেবা মুখার্জী, বাসন্তী দাশগুপ্ত, আভা সেন, বিভা সেন, হাসি সেন প্রমুখ। বরিশাল ছাত্র ফেডারেশনের সর্বক্ষণিক পরামর্শদাতা ছিলেন অমিয় কুমার দাশগুপ্ত মহারাজ। তিনি ছিলেন বরিশাল ছাত্র আন্দোলনের প্রাণপুরুষ। কমিউনিষ্ট পার্টির পক্ষ হতে অধীর চক্রবর্তী ফেডারেশনের সহযোগিতা করতেন। জেলায় ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে ছাত্র ফেডারেশনের সদস্য সংখ্যা ছিল প্রায় তিন হাজার।

উপসংহার

স্বাধীনতা, শান্তি ও প্রগতি ছিল ছাত্র ফেডারেশনের মূলমন্ত্র। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের কবল হতে উপমহাদেশের স্বাধীনতার জন্য ছাত্র ফেডারেশন সংগ্রাম করেছে। আগষ্ট আন্দোলন নিয়ে মতবিরোধ হলেও দলে ভাঙ্গন সৃষ্টি হয়নি। ফেডারেশন বন্দীমুক্তি, পঞ্চাশের দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধ ও কৃষকদের দাবি নিয়ে আন্দোলন করেছে। তৎকালীন যুব সমাজের মধ্যে ছাত্র ফেডারেশন অভূতপূর্ব সাড়া জাগায়। বিভাগ পূর্বকালে ফেডারেশন ছিল একমাত্র অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল ছাত্রদল। তাদের অধিকাংশ কর্মী কমিউনিষ্ট দলের সমর্থক ছিল। সাম্রাজ্যবাদবিােধী আন্দোলনে ছাত্র ফেডারেশনের নেতা অমিয় দাশগুপ্ত, ফণী রায়, জ্যোতি ব্যানার্জী, নুটু ব্যানার্জী, সীতাংশু মজুমদার, ব্রজগোপাল, প্রশান্ত দাশগুপ্ত, উৎপল সেন প্রমুখ কারাবরণ করেন । দেশ বিভাগের পর ছাত্র ফেডারেশন ১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ছিল। ছাত্র ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠিত হলে ছাত্র ফেডারেশন বিলুপ্ত হয়ে যায়।


তথ্যসূত্র: ১। সিরাজ উদ্দীন আহমেদ। বরিশাল বিভাগের ইতিহাস (১ম খণ্ড)। ভাস্কর প্রকাশনী, ঢাকা। ২০১০।