খান বাহাদুর হেমায়েতউদ্দীন খান

Barisalpedia থেকে

পূর্ণ নাম খান বাহাদুর হেমায়েতউদ্দিন আহম্মদ। জীবনকাল ১৮৬০-১৯৪১। ঊনিশ শতকের শেষভাগের ও বিশ শতকের গোড়ার দিকের বরিশালের শিক্ষা ও রাজনৈতিক আন্দোলনের অগ্রণী মুসলিম নেতা।

জন্ম ও পূর্ব পুরুষের পরিচিতি

হেমায়েতউদ্দীন ১৮৬০সালের ১৯ নভেম্বর বর্তমান গোপালগঞ্জ জেলার কোটালিপাড়া থানাধীন কুশলা গ্রামে জন্মগ্রহন করেন। তাঁর পিতামহ জহিরউদ্দীন আহম্মদ ফরিদপুর জেলার তৎকালীন গোপালগঞ্জ মহকুমার অন্তর্গত গোবরার অধিবাসী ছিলেন। তিনি আইন ব্যবসায়ী ছিলেন। পিতামহের মৃত্যুর পরে পিতা মহীউদ্দীন আহম্মদ গোবরা থেকে ঐ জেলার কোটালিপাড়া থানাধীন কুশলায় এসে বসতি স্থাপন করেন। তখন পর্যন্ত কোটালিপাড়া বাকেরগঞ্জ জেলাভুক্ত ছিল। প্রসংগত উল্লেখ্য যে ১৮৭৩ সাল পর্যন্ত কোটালিপাড়া ও মাদারীপুর মহকুমা সহ বৃহত্তর ফরিদপুর জেলার দক্ষিণাঞ্চল ফতেহাবাদ পরগনা নামে বাকেরগঞ্জ জেলা তথা বাকলা-চন্দ্রদীপ রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। হেমায়েত উদ্দীনের পিতা মৌলভী মহিউদ্দীণ আহম্মদ এবং তাঁর অপর এক ভাই বাকেরগঞ্জের ফৌজদারী আদালতের মোক্তার ছিলেন এবং সম্ভবত বরিশাল সদর হাসপাতালের কাছে প্রথম বসতি স্থাপন করেন। পরবর্তী সময়ে উক্ত বাড়ির মালিকদের নিজেদের মধ্যে অংশীদারিত্বের গোলমালে হাসপাতাল এলাকা ছেড়ে বগুড়া রোড বরিশালে সদর গার্লস স্কুল ও চৈতন্য বিদ্যালয়ের মধ্যবর্তী স্থানে নতুন বসতি স্থাপিত হয়। হেমায়েত উদ্দীনের পিতা বরিশালে মারা যান এবং তাঁর পিতার কাছে কুশলায় সমাহিত হন।

শিক্ষাজীবন

বরিশাল জিলাস্কুলে প্রাথমিক শিক্ষালাভ করে হেমায়েত উদ্দীন ১৮৭৪ সালে ঢাকা মাদ্রাসায় (বর্তমান কবি নজরুল সরকারি কলেজ) এ্যাংলো-পারসীয়ান বিভাগে ভর্তি হন। ১৮৮২ সালে ঢাকা মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা সর্বপ্রথম কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এন্ট্রান্স পাশ করে। অতঃপর ঢাকা কলেজে চার বছর অধ্যয়নের পরে ১৮৮৪ সালে এফ.এ ও ১৮৮৬ সালে বি.এ পাস করেন। বি.এ. ডিগ্রি নিয়ে হেমায়েতউদ্দীন ঢাকা মাদ্রাসার শিক্ষক নিযুক্ত হন এবং এখানে সাফল্যের সাথে পাঁচ বছর শিক্ষকতার পাশাপাশি ঢাকা কলেজ থেকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ১৮৯১ সালে বি.এল. ডিগ্রিলাভ করেন। তিনি বরিশাল জেলার দ্বিতীয় মুসলিম গ্রাজুয়েুট ও উকিল। প্রথম মুসলমান গ্রাজুয়েট ও উকিল ছিলেন শেরেবাংলার পিতা মোহাম্মদ ওয়াজিদ (১৮৪৩-১৯০১)।


আইন ব্যবসায়

১৮৯১ সালে বি.এল. ডিগ্রি অর্জনের পরে হেমায়েত উদ্দীন ঢাকা মাদ্রাসায় শিক্ষকতা ছেড়ে পৈতৃক পেশা ও ওকলাতি করতে বরিশাল বারে যোগ দেন। দন্ড বিধায়ক বিচারক (punitive judge) হওয়া পর্যন্ত তিনি প্রায় পঁচিশ বছর পর্যন্ত উক্ত পেশায় জড়িত থেকে ১৯১৪ কিংবা ১৫ সালে ওকালাতি ত্যাগ করেন । সমাজসেবা ও শিক্ষাবিস্তারে ভূমিকা (বরিশালে) ঢাকা কলেজে অধ্যয়ন কালে হেমায়েত উদ্দীন তাঁর সতীর্থ আব্দুল আজিজ (১৮৬৩-১৯২৬), জাহিদ সোহরাওর্দী (১৮৭১-১৯৪৯) সহ আরো কতিপয় সমাজসেবী তরুণ মিলে ঢাকা মাদ্রাসার তৎকালীন সুপারিনটেনডেন্ট মাওলানা উবায়দুল্লাহ্ সুহ্রাওয়ার্দীর (১৮৩৪-৮৫) অনুপ্রেরণায় ১৮৮৩ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারী ঢাকায় মুসলিম সুহৃদ সম্মিলনী নামে একটি শিক্ষা-সাংস্কৃতিক সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। এই সংস্থা আঞ্জুমানে আহবাবে ইসলামীয়া নামেও অভিহিত হতো। তারও পূর্বে ১৮৭৮ সালে তাঁরা সমাজ সম্মিলনী নামেও একটি শিক্ষামূলক প্রতিষ্ঠান গঠন করেছিলেন। সুহৃদ সম্মিলনী প্রথম জোর দেয় মুসলমানে বালিকাদের শিক্ষিত করে তোলার কাজে। বিদ্যালয়ের প্রচলিত পদ্ধতিতে নয়, নিজেদের উদ্ভাবিত পদ্ধতিতে পাঠ্যপুস্তক ও পরীক্ষা পদ্ধতি প্রবর্তন পূর্বক তাঁরা বাংলা ও উর্দূভাষায় ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা চালু করেছিলেন। কলাকাতাসহ সারা বাংলায় এ সমিতির সদস্য ও শাখা ছিল। প্রায় বিশ বছর পর্যন্ত ছাত্রীদের গৃহে শিক্ষাদান ও স্বতন্ত্র পরীক্ষা গ্রহণের এ শিক্ষাবিস্তারের পদ্ধতি চালু ছিল। ১৮৮৯ সালের ২৯ নভেম্বর ঢাকা মাদ্রাসার গৃহে সুহৃদ সম্মিলনীর বার্ষিক সভায় হোমায়েতউদ্দীনের প্রস্তাবক্রমে স্কুল কলেজ ও মাদ্রাসার ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে সহযোগিতা ও সহমর্মিতা স্থাপনের উদ্দেশ্যে একটি ডিবেটিং কøাব বা আলোচনা চক্র গঠনের প্রস্তাব সর্ব সম্মতিক্রমে গৃহিত হয়। হেমায়েতউদ্দীন ১৮৯১ সালে ঢাকা ত্যাগ পর্যন্ত তিনি ঐ সমিতির অন্যতম কর্মকর্তা ছিলেন। তাই তাঁকে বাংলাদেশে স্ত্রীশিক্ষার অন্যতম অগ্রদূত বলা যায়।

আনজুমানে হেমায়েতে ইসলাম

ঢাকায় আনজুমানে আহবাবে ইসলামীয়া (মুসলিম সুহৃদ সম্মিলনী) পরিচালনা ও রেনেসাঁ আন্দোলনের প্রেরণা নিয়ে বরিশালে এসে হেমায়েত উদ্দীনের উদ্যোগে একের পরে এক সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়। বরিশাল শহরকে কেন্দ্র করেই তাঁর সামাজিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষা ও রাজনৈতিক বিষয়ক ক্রিয়াকর্ম আবর্তিত হতো। ১৮৯৩ সালের ২০ মে হেমায়েতউদ্দীন বরিশাল আঞ্জুমানে হেমায়েত-এ-ইসলাম নামে একটি ধর্মীয় ও সমাজসেবা মূলক সমিতি স্থাপন করেন। সমিতির প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতি ছিলেন এ. কে. ফজলুল হকের পিতা মুহাম্মদ ওয়াজেদ ও সেক্রেটারি ছিলেন হেমায়েত উদ্দীন। হেমায়েত উদ্দীন আমৃত্যু প্রায় অর্ধশতক এ সমিতির সেক্রেটারী থেকে সমকলীন সমস্যাদি সমাধানের প্রয়াস পান। ১৯২৩ সালে বাংলা সরকার প্রণীত সংশোধিত সমিতি তালিকায় বরিশালের আঞ্জুমানে হেমায়েত-এ-ইসলামের উদ্দেশ্য সম্পর্কে উল্লেখ ছিল- Improvement of The condition of the Muhammedans generally and specially of the District of Bakergonj and to give opinions on political matters when asked by Goverment। এই সমিতির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ তৎপরতায় গোটা বরিশাল জেলায় হজ্ব যাত্রায় উদ্বুদ্ধকরনসহ শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সমাজ সেবার উন্মেষ ঘটে। ১৮৯৫ সালে সরকারের পিলগ্রিমশিপ বিল অনুসারে হজ্ব যাত্রীদের প্রথম টীকা দানের নিয়ম চালু হয়। ধর্মচ্যুতির আশংকায় সেকালে মুসলমানদের টীকাগ্রহণে আপত্তি ছিল। হেমায়েতউদ্দীনের আঞ্জুমান এ জাতীয় কুসংস্কার দূর করতে সক্ষম হয়।

বেল ইসলামিয়া ছাত্রাবাস ( B.l. Hostel)

আঞ্জুমানের উদ্দ্যোগে এবং হেমায়েত উদ্দীনের ব্যক্তিগত চেষ্টায় আলীগড় আন্দোলনের আদর্শে বরিশালের বিখ্যাত বেল ইসলামিয়া বোর্ডিং স্থাপনের প্রয়াস ১৮৯৫ সালে শুরু হয়। সেকালে বাংলা-ভারতের অনান্য শহরের ন্যায় বরিশালে ও ছাত্রাবাসের অভাবে মুসলমান ছাত্রদের শিক্ষালাভের পথে একটা বড় বাধা ছিল। এই সময় হেমায়েতউদ্দীন ঢাকার নবাব আহসানউল্লাহর কাছ থেকে দু’হাজার টাকা নিয়ে ১৮৯৫ সালের ২৫ জানুয়ারী জামে কশাই মসজিদের পশ্চিম পাশে আট কাঠা জমি ক্রয় করেন। ঐ বছরের ২৩ ফেব্রুয়ারী জেলাপ্রশাসক মিঃ মসুরিয়ারের সভাপতিত্বে স্থানীয় বি.এম. স্কুলে এক সভায় শায়েস্তাবাদের জমিদার সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন (১৮১০-১৯০৯) উক্ত ছাত্রাবাস নির্মানে তাৎক্ষনিক ভাবে ৫০০ টাকা দান করেন। ১৮৯৭ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর জেলা প্রশাসক স্যার বিটসন বেলের সভাপতিত্বে বরিশাল জিলা স্কুলের প্রাঙ্গনে অনুষ্ঠিত এক জনসভায় জৌনপুরী পীর মাওলানা হাফেজ আহম্মদ (১৮৩৪-৯৯) এবং কলকাতা হাইকোর্টের নামযাদা উকিল নওয়াব সিরাজুল ইসলাম (১৮৪৮-১৯২৩) অত্র ছাত্রাবাস নির্মাণের গুরুত্ব সম্পর্কে প্রেরণামূলক বক্তৃতা করেন। নওয়াব সাহেবের প্রস্তাবে সর্বসম্মতিক্রমে বেল সাহেবের নামানুসারে ঐ ছাত্রাবাসের নামকরণ করা হয় বেল ইসলামিয়া ছাত্রাবাস । ১৮৯৯ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারী বিটসন বেল উক্ত ছাত্রাবাসের ভিত্তি প্রস্থর স্থাপন করেন এবং গভর্নর প্রদত্ত পাঁচ হাজার টাকা সহ আরো কিছু সংগৃহীত অর্থে নির্মিত ছাত্রাবাস ১৯০১ সালের জুন মাসে গভর্নর উডবার্ন কর্তৃক উদ্বোধন করা হয়। এই হোষ্টেল প্রথম যুগে বরিশালে মুসলিম যুবকদের মধ্যে শিক্ষায় একটি নতুন প্রবাহের সৃষ্টি করেছিল। দেহ ও চরিত্রগঠন, ভ্রাতৃত্ব বন্ধন, ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা ছিল এই হোষ্টেলের বৈশিষ্ট্য। বি.আই. হোষ্টেলের বোর্ডারদের মাধ্যে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের ষ্পীকার আবদুল ওহাব খান, বিচারপতি আবদুল জব্বার খান, খান বাহাদুর মুহাম¥দ আকরাম, বিচারপতি মুহাম্মদ ইব্রাহিম, খান বাহাদুর মাহবুবউদ্দীন আহম্মদ, সাবেক পাক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আযীজ উদ্দীন আহম্মদ, সাবেক মন্ত্রী খান বাহাদুর হাশেম আলী খান, খান বাহাদুর আবদুর রহমান খান, মেজর আফসার উদ্দীন প্রমুখের নাম সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।

আছমত আলী খান ইনষ্টিটিউশন (এ.কে. স্কুল) স্থাপন

বেল ইসলামিয়া হোষ্টেলের ছাত্রসংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় হোষ্টেল কর্তৃপক্ষ (বোর্ড অব ট্রাস্টিজ) ছাত্রাবাসের নিকটে ইসলামী ঐতিহ্যের প্রতীক একটি শিক্ষায়তন স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা উপলদ্ধি করেন। এই উদ্দেশ্যে হেমায়েত উদ্দীন সাহেবের উদ্যোগে এবং চৌধুরী মুহাম্মদ ইসমাইল খান ও শহরের অন্যান্য গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সহযোগিতায় সরকার থেকে কিছু জমি অধিগ্রহণ করা হয়। ১৯১৩ সালের ৬ জানুয়ারী উক্ত জমিতে নির্মিত টিনসেড গৃহে একটি মক্তব প্রতিষ্ঠা করা হয় যেখানে উর্দু, আরবী ও কুরআন শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করা হয়। ১৯১৬ সালে ইসমাইল চৌধুরী সাহেবের পিতার নামানুসারে প্রতিষ্ঠানের নামকরণ করা হয় আছমত আলী খান ইনটিষ্টিউশন। ১৯১৮ সালে প্রতিষ্ঠানটি পূর্ণাঙ্গ ইংরেজী বিদ্যালয়ে পরিণত হয়। হেমায়েতউদ্দীন এ সময় থেকে আমরণ এই প্রতিষ্ঠানের সেক্রেটারী ছিলেন। তৎকালীন স্কুলটি বরিশাল, পটুয়াখালী ও ফরিদপুর অঞ্চলের মুসলিম শিক্ষা বিস্তারে বিশেষ ভুমিকা পালন করে। হেমায়েতউদ্দীন বি. আই. হোষ্টেলের ন্যায় এই বিদ্যালয়ের উন্নতি সাধনেও যারপরনাই চেষ্টা করেন। স্কুলের খেলাধুলার জন্য ১৯৩০ সালে স্থানীয় র্কীতনখোলা নদীর পশ্চিম তীরে একটি মাঠ তৈরি করা হয়। এ.কে. ইনষ্টিটিউশনের এই খেলার মাঠটি বর্তমানে হেমায়েতউদ্দীন সেন্ট্রাল ঈদগাহ্ নামে অভিহিত । এ প্রসঙ্গে উলেখ্য যে, ১৯২৮ সালে বরিশালের আলেকান্দায় চৌধুরী মুহাম্মদ ইসমাইল খানের স্ত্রী হালিমা খাতুনের নামে প্রতিষ্ঠিত হালিমা খাতুন গার্লস স্কুল স্থাপনের পশ্চাতেও ছিল খান বাহাদুর হেমায়েত উদ্দীনের পরামর্শ ও প্রেরণা।

বরিশাল জিলা স্কুল ও বি.এম. কলেজে ভূমিকা

১৮২৯ সালের ২৩ ডিসেম্বর বরিশাল ইংরেজী স্কুল নামে প্রতিষ্ঠিত বরিশাল জিলা স্কুল বিভিন্ন পর্যায় বর্তমান গৌরবময় ভূমিকায় উন্নিত হয়েছে। হেমায়েতউদ্দীন দীর্ঘদিন জিলা স্কুল কমিটির সেক্রেটারী ও সহ-সভাপতি ছিলেন। তাঁর শিক্ষা সেবার স্বীকৃতিস্বরূপ জনশিক্ষা পরিচালক জিলা স্কুলে হেমায়েতউদ্দীনের নামে একটি শিক্ষাবৃত্তি প্রবর্তন করেন।

১৯১২ সালে হেমায়েতউদ্দীন বরিশাল বি.এম. কলেজ গভর্নিংবডির সদস্য নির্বাচিত হন। অতঃপর তিনি আমরণ কখনো সরকার মনোনীত আবার কখনো অভিভাবক প্রতিনিধিরুপে এ কলেজ-কউন্সিলের সদস্য ছিলেন। তাঁর নামে ঐ সময় বি.এম. কলেজে মুসলমান ছাত্রদের জন্য ডিউটি ফান্ড (Duty Fund) চালু হয়েছিল। এই ফান্ড থেকে প্রথমে মুসলমান ছাত্রদের ও পরবর্তীকালে সকল ছাত্রদের ফ্রি বই পড়ার সুযোগ প্রদান, দরিদ্র ও মেধাবী ছাত্রদের সাহায্য দেয়া হতো। তাঁর চেষ্টার ফলে মুসলমান ছাত্ররা হোষ্টেলে থাকার সুযোগ লাভ করে।

বরিশাল পৌরসভা ও জেলা বোর্ড

হেমায়েতউদ্দীন আহম্মদ দীর্ঘকাল বরিশাল জেলা বোর্ড ও মিউনিসিপ্যালিটির সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। ১৯৪২ সালে প্রকাশিত Who’s Who in India শীর্ষক তথ্যমূলক গ্রন্থে বলা হয় হেমায়েতউদ্দীন বরিশাল জেলা বোর্ড ও পৌরসভায় ১৫ বছরের অধিককাল ধরে কাজ করেছেন। তিনি দু’দফা বরিশালা জেলা বোর্ডের সফল চেয়ারম্যান ছিলেন। প্রথম দফা ১৯২০ -২৩ এবং দি¦তীয় বার ১৯৩২-৩৬ তিনি এই দায়িত্ব পালন করেন।

বরিশাল সেন্ট্রাল কো-অপারেটিভ ব্যাংক স্থাপন

বিশ শতকের প্রথমার্ধে বাংলাদেশে খান বাহাদুর হেমায়েতউদ্দীন ছিলেন সমবায় আন্দোলনের অন্যতম অগ্রদূত। কুসিদজীবি মহাজনদের কবল থেকে দরিদ্র কৃষক-শ্রমিকদের জানমাল ও মান-ইজ্জত রক্ষার উদ্দেশ্যে তিনি কতিপয় নিবেদিতপ্রাণ কর্মী নিয়ে বরিশালে সমবায় আন্দোলনের সূত্রপাত্র করেন। তাঁর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় মধ্যবিত্ত কয়েকটি পরিবার নিয়ে ১০০১ (একহাজার এক টাকা) আমানত সংগ্রহপূর্বক বগুড়া রোডস্থ বাড়ীর আঙ্গিনায় ১৯১৩ সালের ২৮ মে বরিশাল সেন্ট্রাল কো-অপারেটিভ ব্যাংক স্থাপিত হয়। ১৯১৪-১৫ তাঁর বাড়ীর পূর্ব পাশে সমবায়ী উৎসাহীদের দানে ৭(সাত) কাঠা জমি খরিদ পূর্বক ঐ স্থানে ব্যাংকের দফতর স্থানান্তরিত হয়। ১৯১৭ সালে ঐ আমানত বেড়ে ব্যাংকে জমার পরিমান দাঁড়ায় ষোল লাখ টাকায়। তখন থেকে সহজ শর্তে ও নামেমাত্র সুদে ঋণদান শুরু হয়। ১৯১৮ সালে হেমায়েতউদ্দীনের চেষ্টায় ঐ ব্যাংকের জন্য দু’তলা দালান নির্মিত হয় যা এখনো কালের সাক্ষী হয়ে বিরাজমান। ১৯১৩ থেকে ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ সিকি শতক তিনি ঐ ব্যাংকের সেক্রেটারী এবং আমৃত্যু উপদেষ্টা হিসেবে জড়িত ছিলেন। সমবায় আন্দোলনের অগ্রদূত হিসেবে তিনি বাংলাদেশে সমবায় সমিতির রেজিস্ট্রারের নিকট শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন। তিনি প্রাদেশিক ব্যাংকিং ইনকোয়ারী কমিটির সরকার মনেনীত সদস্য হিসেবে সুনাম অর্জন করেন। তিনি বরিশাল অফিসার্স কো-অপারেটিভ ব্যাংক এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন।

স্বাস্থ্যসেবা - প্রয়াস ও পরিণতি

বিশ শতকের গোড়ার দিকে হেমায়েতউদ্দীন ছিলেন বরিশাল দাতব্য চিকিৎসালয় সমিতির সেক্রেটারী। সেই সূত্র ধরে তিনি বরিশাল জিলা সদরে একটি হাসপাতালে স্থাপনের আন্দোলন চালিয়ে যান। এ ব্যাপারে তিনি এ অঞ্চলের সবচেয়ে প্রভাবশালী নেতা এ. কে. ফজলুল হককে ভাবিয়ে তোলেন। এ. কে ফজলুল হক ১৯২৪ সালে প্রাদেশিক শিক্ষামন্ত্রণালয়ের সাথে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর পেয়ে মাত্র ৭/৮ মাসে শিক্ষা বিস্তারকল্পে কিছু করতে পারলেও স্বল্পতম সময়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরে উল্লেখযোগ্য কিছু করতে পারেন নি। অতঃপর এ. কে. ফজলুল হকের অবিভক্ত বাংলার প্রধান মন্ত্রীত্বের আমলে (১৯৩৭-৪১) বরিশালে শের-ই-বাংলার উপস্থিতিতে বরিশাল কেন্দ্রীয় কারাগারের পশ্চিম পাশে বাংলার গর্ভনর স্যার জন হার্বাট কর্তৃক মেডিকেল স্কুল ও হাসপাতালের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপিত হয়। কলেজসহ হাসপাতাল করার উদ্যোগ নিলেও উনারা বর্তমান সদর হাসপাতাল ব্যতীত কিছু দেখে যেতে পারেন নি।


খান বাহাদুর খেতাব লাভ

হেমায়েতউদ্দীনের এতসব জন সেবার স্বীকৃতি স্বরূপ তদানীন্তন বৃটিশ সরকার ১৯১১ সালের ১২ ডিসেম্বর দিল্লীর করনেশন দরবারে তাঁকে ‘খান বাহাদুর’ খেতাবে ভূষিত করেন।

শিক্ষা বিস্তারে বহুমুখী ও বহিমুর্খী ভূমিকা

খান বাহাদুর হেমায়েতউদ্দীনের শিক্ষা তৎপরতা শুধু বরিশালে বা এমনকি পূর্ববাংলায়ও সীমিত ছিল না। ১৮৯৩ সালে প্রতিষ্ঠিত ক্যালকাটা মোহামেডান ইউনিয়নের তিনি মফস্বল সদস্য মনোনীত হন। ঢাকা মাদ্রাসা কমিটির সদস্য হিসেবে তিনি তাঁর অভিজ্ঞতার স্বাক্ষর রাখেন। তিনি বেঙ্গল টেকস্ট বুক বোর্ডের সদস্য ছিলেন। স্যার সৈয়দ আহাম্মদ (১৮১৭-৯৮) কর্তৃক উত্তর প্রদেশের আলীগড়ে ১৮৮৬ সালে প্রতিষ্ঠিত অলইন্ডিয়া মোহামেডান এডুকেশনাল কনফারেন্স- এর বার্ষিক সভা বাংলার মাটিতে সর্বপ্রথম অনুষ্ঠিত হয় কলকাতায় ১৮৯৯ সালের ২১ ডিসেম্বর । ঐ বছর ১৪ ডিসেম্বর বরিশালে জজ কোর্টের উকিল মোহাম্মদ ওয়াজেদ এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভার সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত মুতাবিক হেমায়েতউদ্দীন সাহেব জেলা প্রতিনিধি রুপে উক্ত শিক্ষা সম্মেলনে যোগদান করেন।

১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর পূর্ববঙ্গ ও আসাম নতুন প্রদেশের জন্মদিনেই প্রাদেশিক মুসলিম শিক্ষা সমিতি প্রতিষ্ঠা লাভ করে। সেই সমিতির সিদ্ধান্ত অনুসারে এবং নওয়াব স্যার সলিমুল্লাহ্র (১৮৬৬-১৯১৫) উদ্যোগে ১৯০৬ সালের ১৪-১৫ এপ্রিল ঢাকায় অনুষ্ঠিত ঐতিহাসিক সম্মেলনে হেমায়েতউদ্দীনের ভূমিকা উল্লেখের দাবী রাখে । ঐ সভায় মুসলিম ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষাবৃত্তি মোহসীন ফান্ডের অর্থ সংখ্যানুপাতে বরাদ্দ ইত্যাদি ব্যাপারে হেমায়েতউদ্দীনের প্রস্তাবসমূহে সমর্থন যোগান অন্যান্যের মধ্যে খান বাহাদুর মাহমুদুন নবী, এ. কে. ফজলুল হক প্রমুখ নামযাদা মুসলিম নেতৃবর্গ। ১৫ এপ্রিলের সমাপনী অধিবেশনে হেমায়েতউদ্দীনকে সর্বসম্মতিক্রমে প্রস্তাবিত ঢাকা মেহামেডান হলের অর্থ সংগ্রহ কমিটি এবং নগর প্রাইমারী স্কুল ও গ্রামীন মক্তব্যের সাহায্যের জন্য স্কীম প্রনয়নকারী কমিটির সদস্য নির্বাচিত করা হয়। শিক্ষা সম্মেলনে ঢাকা মাদ্রাসার ডাফরিন হোষ্টেল ও কলকাতায় ইলিয়ট হোষ্টেল (১৮৯৬) নির্মাণেও তাঁর সক্রিয় ভূমিকা ছিল। ১৯০৬ সালের ২৭ ডিসেম্বর থেকে তিন দিন ব্যাপী ঢাকার শাহ্বাগে সারা ভারত থেকে আগত ৮০০ ডেলিগেটের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত অলইন্ডিয়া মুসলিম এডুকেশনাল কনফারেন্স ও ৩০ ডিসেম্বর আহসান মঞ্জিলে অলইন্ডিয়া মুসলিম লীগ গঠনকল্পে অনুষ্ঠিত অধিবেশনে হেমায়েতউদ্দীন একজন দায়িত্বশীল জাতীয় নেতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। তাঁরই বলিষ্ঠ নেতৃত্বে বরিশাল অঞ্চল থেকে এ. কে. ফজলুল হক ও নূরুল হক চৌধুরী (১৮৮৪-১৯৮৯) উক্ত ঐতিহাসিক সমাবেশে অংশগ্রহণ পূর্বক উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন। বিশেষ করে ঐ সময় মুসলিম লীগের গঠনতন্ত্র প্রণয়নের জন্য গঠিত তিন সদস্য বিশিষ্ট কেন্দ্রীয় কমিটির হেমায়েত উদ্দীন ছিলেন অন্যতম, তিনি ছিলেন আইনজ্ঞ। অপর দু’জন সম্মানিত সদস্য ছিলেন নওয়াব স্যার সলিমুল্লাহ বাহাদুর ও সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী (১৮৬৩-১৯২৯)।

১৯০৭ সালের ১৬ ডিসেম্বর ও ১৯০৮ সালেন ২২ এপ্রিল বাংলার জনশিক্ষা পরিচালক মিঃ আর্কডেল মাদ্রাসায় কামিল কøাশ ও তাতে বাধ্যতামূলক ইংরেজী শিক্ষা প্রবর্তন করা হবে কিনা ইত্যাদি বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য কলকাতায় উভয় বাংলার প্রতিনিধিত্বশীল উচ্চমানের দুটো শিক্ষা সম্মেলন আহবান করেন। পূববঙ্গ ও আসাম প্রদেশের শিক্ষা পরিচালক মিঃ শারপ ঐ সম্মেলনে যে ৭ জন প্রতিনিধি বাছাই করেন বরিশালের হেমায়েতেউদ্দীন ছিলেন তাদের অন্যতম। উভয় সম্মেলনে হেমায়েতউদ্দীন সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। ১৯০৯ সালে মর্লিমিন্টো সংস্কারে সম্প্রাদায় ভিত্তিক নির্বাচনের আইন পাস করা হয়। ঐ আইনের বদৌলতে হেমায়েতউদ্দীন ১৯১০ সালের গোড়ার দিকে ঢাকা বিভাগে মুসলামান এলাকা থেকে পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রাদেশিক ব্যবস্থাপক সভার সদস্য নির্বাচিত হন। বঙ্গ বিভাগ বাতিল হওয়া পর্যন্ত তিনি ঐ পদে বহাল ও সক্রিয় ছিলেন। ১৯২৭-৩৪ মেয়াদে বড় লাটের আইন সভায় মনোনীত সদস্য হিসেবে স-সম্মানে অধিষ্ঠিত ছিলেন। ।

সমকালীন রাজনীতিতে ভূমিকা (১৯০৫-৪০)

বিশ শতকের প্রথমার্ধে উপমহাদেশের বিশেষত বাংলার রাজনীতি ছিল বিস্ফোরণোন্মুুখ। বঙ্গবিভাগ (১৯০৫), স্বরাজ আন্দোলন (১৯০৫-১১), প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪-১৮), খেলাফত আন্দোলন (১৯২১), অসহযোগ আন্দোলন (১৯২১), পটুয়াখালীতে সত্যাগ্রহ আন্দোলন ও হিন্দু-মুসলিম দাঙা (১৯২২-২৬), চট্টগ্রামের অস্ত্রাগার লুন্ঠন (১৯৩০), লন্ডনে গোলাটেবিল বৈঠক (১৯৩১-৩৩), সাধারণ নির্বাচন (১৯৩৭), লাহোর প্রস্তাব (১৯৪০), দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ (১৯৩৯ - ৪৩) প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা এই সময়ে ঘটে। খান বাহাদুর হেমায়েতউদ্দীনকে এ সময় যে ঘটনা অনেক আন্দোলিত করেছে তাহলো কুলকাঠি দাঙ্গা। বর্তমান ঝালকাঠী জেলাধীন নলছিটি থানার কুলকাঠীতে (পোনা বালিয়া) ৭ মার্চ ১৯২৬ মতান্তরে ১৯২৭ স্থানীয় হিন্দুদের শিব মেলাকে কেন্দ্র করে এক মারাত্মক হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গায় ২০ জন মুসলমান নিহত ও শতাধিক আহত হয়। মেলার এক শোভাযাত্রা নামাজের সময় মসজিদের সম্মুখে পৌছলে মুসলমানেরা বাধা দেবার জন্য প্রস্তুত হয়। জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট ই.এন. ব্লান্ডি, পুলিশ সুপার টেইলর, ভূতনাথ দারোগা সরেজমিনে উপস্থিত ছিলেন। মসজিদের সম্মুখ দিয়ে ঢোলবাদ্য বাজিয়ে হিন্দুদেরকে যেতে দিতে মুসলমানেরা অস্বীকার করলে ১৪৪ ধাারা জারি করা হয় এবং মুসলমানদেরকে পথ থেকে সরে যেতে বলা হয়। কিন্তু কোন ফল হয়না। তখন গুলি চালানোর জন্য জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট আদেশ দেয় যার ফলে ১৭ জন মুসলমান ঘটনাস্থলেই শহীদ হন। এর ফলে বরিশালে মুসলমানদের মধ্যে এক তীব্র আন্দোলন সৃষ্টি হয়। বরিশালের মুসলমান সম্প্রদায় খান বাহাদুর হোমায়েতউদ্দীন সহেবকে রিসিপশন কমিটির চেয়ারম্যান করে এক নিখিল বঙ্গ মুসলিম কনফারেন্সের আয়োজন করেন। এই নৃশংস ও চাঞ্চল্যকর হত্যাকান্ডের পরক্ষণেই নিহত ও আহতদেরে পরিবার বর্গের প্রতি আর্থিক ও অন্যান্য সাহায্য দেয়ার জন্য স্থানীয় নেতৃবৃন্দ কর্তৃক হেমায়েতউদ্দীনকে সভাপতি করে একটি রিলিফ ফান্ড গঠন করা হয়। সমকালীন পত্র-পত্রিকা বিশেষত ‘আজাদ, যুগান্তর, সত্তগাত, ঢাকা প্রকাশ ইত্যাদি সাময়িকীতে উক্ত রিলিফ সংগ্রহ ও বিতরনে হেমায়েতউদ্দীনের ভূয়সী প্রশংসা করা হয়েছে।

উক্ত বর্ররোচিত হত্যাকান্ডের পরে তিন মাসের মধ্যে বরিশালের নের্তৃবর্গ বিশেষত হেমায়েতউদ্দীনের উদ্যোগে ৮ থেকে ১২ মে (১৯২৬/২৭) পাঁচদিন ব্যাপী বরিশাল শহরে প্রাদেশিক মুসলমান সম্মিলনীর এক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।প্রয় লক্ষাধিক লোকের অংশগ্রহনে অনুষ্ঠিত উক্ত সম্মেলনের মূল কমিটির সভাপতি ছিলেন এককালীন মুসলীম লীগের প্রাদেশিক সভাপতি স্যার আবদুর রহিম (১৮৪৯-১৯২৭) তৎকালীন অভ্যর্থনা কমিটির সভাপতি হিসেবে হেমায়েতউদ্দীনের ভাষণ ছিল ইংরেজীতে ডিমাই অকটেভ ১২ পৃষ্ঠা সম্বলিত। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য ১৯২৮ সালে হেমায়েতউদ্দীন শরৎ গুহ, এ. কে. ফজলুল হক প্রমুখের উদ্যোগে হিন্দু-মুসলমান ও খৃষ্টানদের মধ্যে এক ঐতিহাসিক শান্তি চুক্তি সম্পাদিত হয়।

পত্র-পত্রিকা ও সাহিত্যচর্চা

১৯২৬ সালে বরিশাল থেকে ‘বঙ্গমিহির’ ও ১৯২৭ সালে ‘নকীব’ পত্রিকা প্রকাশে হেমায়েত উদ্দীনের আন্তরিক পৃষ্ঠপোষকতা ছিল। ১৯ শতকের শেষ দিকে সুহৃদ সম্মিলনীর উদ্যোগে হেমায়েত উদ্দীন, আবদুল আজিজ ও রমনীরঞ্জন বিদ্যারতেœর যৌথ উদ্যোগে যেসব পাঠ্য পুস্তক প্রণীত ও প্রকাশিত হয় তন্মধ্যে সাহিত্যসার ব্যাকরণ (১ম ভাগ/১৮৯০) এর কথা বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। কলকাতা থেকে প্রকাশিত মিহির ও সুধাকর পত্রিকায় (১০ কার্তিক, ১৩০২) ২৯ জন লেখকের তালিকায় হেমায়েতউদ্দীন আহম্মদ বি.এ., বি.এল নামটি আছে।

ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবন

খান বাহাদুর হেমায়েতউদ্দীন তৎকালীন ‘হাই সোসাইটি’ তথা অভিজাত সম্প্রদায়ের সাাথে প্রায়ই মেলা মেশা করেও সাদাসিধে জীবন যাপন করতেন। সেকালের রেওয়াজ মাফিক তিনি ঘরে সাাদা থান কাপড়ের ধূতি ও মাথায় লাল রুমি টুপি পরতেন। ঘোড়ার গাড়ীতে চরে সভাসমিতিতে অংশগ্রহণ করতেন। তাঁর টিনশেড বৈঠক খানার ফরাশ বিছানো থাকতো। উক্ত বৈঠকখানা প্রায় সর্বদাাই সরগরম থাকতো। তিনি নিজে বার্মিজ সিজার খেতেন। সাধারণ ধূমপায়ীদের জন্য পিতলের নির্মিত এক ধরনের হুক্কার ব্যবস্থা ছিল যা, বর্তমানে দুর্লভ। তিনি অতিথিপরায়ণ ও ধর্মভীরু ছিলেন, যথারীতি নামায-রোজা আদায় করতেন। কিন্তু হজ্ব সম্পন্ন করেছেন বলে জানা যায় না। মৃত্যুর মাত্র ‘দু’ বছর পূর্বে (১৯৩৯) বগুড়া রোডের বাড়ীটি দোতালা ভবনে উন্নতি হয় যা “হেমায়েত মনঞ্জিল” নামে অভিহিত। বর্তমানে উক্ত ভবনে এমনকি বরিশালে তাঁর আপনজন কেউ বাস করেন বলে মনে হচ্ছে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশিষ্ট গবোষক ড. মুহাম্মদ আবদুল্লাহ তাঁর গবেষণা গ্রন্থে হোমায়েতউদ্দীনের স্ত্রী হিসেবে বরিশাল জেলাধীন মূলাদী থানার অন্তর্গত গাছুয়ার জমিদার আলহাজ্ব সৈয়দ জয়নাল আবেদীনের কন্যা সাইয়েদা বেলাতুননেসার কথা লিখেছেন।

হেমায়েতউদ্দীনের ৪ পুত্র কন্যার মধ্যে একমাত্র মেয়ে হাসিনা খাতুন (?), যার বিয়ে হয় চাচাতো ভাই এ.কে.এম ফখরুদ্দীনের সাথে, যিনি ডিস্ট্রিক্ট রেজিষ্ট্রার ছিলেন। হাসিনা ফখরুদ্দীনরা বরিশালে বগুড়া রোডে বাস করতেন এবং তাদের একমাত্র পুত্র সেলীম আহম্মেদ বরিশাল শহরে সুপরিচিতি ছিল। হেমায়েতউদ্দীনের তিন পুত্র সন্তানের মধ্যে প্রথম ও দ্বিতীয় যথাক্রমে জনাব হাবীবউদ্দীন আহম্মদ ও মাহবুবউদ্দীণ আহম্মদ ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর ছিলেন। তৃতীয় পুত্র ক্যাপ্টন কবীরউদ্দীন আহম্মদ বিআইডব্লিউটিএ-এর ডেপুটি ডিরেক্টর অব পোর্টস এন্ড শিপিং পদ থেকে অবসর গ্রহন করেছেন। জেষ্ঠ্যপুত্র হাবীবউদ্দীন আহম্মদের মৃত্যুর তারিখ ১৯৭৯ সালের ১১ অক্টোবর।


মৃত্যু

দীর্ঘকাল রোগশয্যায় থাকার পরে ৮৩ বছর বয়সে ১৯৪১ সালের ২১ সেপ্টেম্বর সোমবার সন্ধ্যায় খান বাহাদুর হেমায়েতউদ্দীন ইন্তেকাল করেন। পরেরদিন সকাল ৯ টায় সুসজ্জিত শবাধারে তাঁর মরদেহ মৌন শোভাযাত্রা সহকারে এ.কে. ইনষ্টিটিউশন প্রাঙ্গনে নেয়া হয়। ১৯৬৯ সালেন ২১ জানুয়ারী বেগম হেমায়েতউদ্দীন “হেমায়েত মঞ্জিলে” ইন্তেকাল করলে তাঁকে ও একই স্থানে যথা সম্মানে সমাধিস্থ করা হয়।



লেখক: প্রফেসর মোসলেম উদ্দিন সিকদার

তথ্যসূত্র ১। হেমায়েতউদ্দীন সাহেবের ২য় পুত্র মাহবুবউদ্দীন প্রদত্ত তথ্য । ২। সিরাজউদ্দীন আহমেদ- বরিশালের ইতিহাস দ্বিতীয় খন্ড ঢাকা , ১৯৮৫ ৩। ড. আহম্মদ হাসান দানী, ঢাকা, ১৯৬২ (২য় সংস্করণ) ৪। প্রফেসর ড. ওয়াকিল আহম্মদ - হেমায়েত উদ্দিন আহম্মদ ১৮৬০ -১৯৪১-ইতিহাস সমিতি পত্রিকা ১০ম সংখ্যা ১৯৮১ (শামসুন নাহার মাহমুদ মাঃ মোহাম্মদী কার্তিক ১৩৪৭ পৃঃ ৫২-৫৩) উল্লেখ্য ১৯৭৯ সালের ৫-৭ অক্টোবর বরিশাল বি এম কলেজে বাংলাদেশ ইতিহাস কমিটি ৫ম জাতীয় সম্মেলনে প্রবন্ধকার কর্তৃক উপস্থাপিত। ৫। পূর্বোক্ত ( মোসলেম ক্রনিকল ২২ আগষ্ট, ১৮৯৫)। ৭। নাজিম উদ্দিন আহম্মদ ‘বরিশাল জিলা স্কুলের ইতিবৃত্ত’ (ম্যাগাজিন, সবুজ পাতা) ২০০০-২০০৪ ৮। ড. মাসায়ুকি উসুদা ‘প্রাক-স্বদেশী যুগে অশ্বিনী কুমারের কর্মকান্ড’, পূর্বোক্ত ইতিহাস সমিতি পত্রিকা ৯। কামরুদ্দীন আহম্মদ- বাংলায় মধ্যবিত্তের আত্ম প্রকাশ, ঢাকা , আশ্বিন ১৩৮২ ১০। পূর্বোক্ত- যুগান্তর, কলকাতা , ২৮ সেপ্টম্বর, ১৯৪১। ১১। পূর্বোক্ত- আজাদ, কলকাতা , ২৮ সেপ্টেম্বর, ১৯৪১।