কীর্তিপাশার জমিদার সেন পরিবার

Barisalpedia থেকে

এই পরিবার সেলিমাবাদ পরগণার অন্যতম জমিদার। এঁরা রায়েরকাঠির জমিদারদের অনুগ্রহে জমিদারি লাভ করেছিলেন। এ পরিবারের প্রথম পদবি সেন, পরে মজুমদার এবং তারও পরে রায়চৌধুরী। এ পরিবারের বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব রোহিনী কুমার সেন ও ড. তপন রায়চৌধুরী।


প্রতিষ্ঠার ইতিহাস

ঝালকাঠি থানার কীর্তিপাশা গ্রামের বৈদ্যবংশীয় কৃষ্ণরাম মজুমদার রায়েরকাঠির দেওয়ান ছিল। এ পরিবারের আদি পুরুষ দুর্গাদাস সেন বিক্রমপুরের পোড়াগঙ্গা গ্রাম হতে কীর্তিপাশায় আগমন করেন। তিনি পদহিদাস বংশীয় হরেকৃষ্ণের ভগ্নিকে বিয়ে করে কীর্তিপাশায় বসতি স্থাপন করেন। তার প্রপৌত্র কৃষ্ণ রায়, বিষ্ণু রায় ও বলরাম রায়েরকাঠির রাজা জয়নারায়ণের কর্মচারী ছিলেন। কৃষ্ণরাম অসাধারণ বুদ্ধিমত্তার বলে জয়নারায়ণের দেওয়ান নিযুক্ত হন। তিনি নিজের জীবন বিপন্ন করে নবাবের নিকট হতে জয়নারায়ণের জমিদারী উদ্ধার করেন এবং জয়নারায়ণের অনুগ্রহে জমিদারি লাভ করে মজুমদার উপাধিপ্রাপ্ত হন।


কীর্তিপাশার জমিদারদের বংশলতিকা

দুর্গা দাশ সেনের পুত্র রামজীবন সেন, তদীয় পুত্র রামেশ্বর সেন, তদীয় ৪ পুত্র কাশীরাম, কৃষ্ণরাম মজুমদার (জয়নারায়ণ কর্তৃক মজুমদার উপাধি প্রদত্ত), বিষ্ণুরাম ও বলরাম। কৃষ্ণরাম মজুমদার মূলত কীর্তিপাশার জমিদারির প্রতিষ্ঠাতা। কৃষ্ণরাম মজুমদারের পুত্র রাজারাম, তদীয় পুত্র দুই পুত্র নবকৃষ্ণ ও কালাচাঁদ। নবকৃষ্ণের পুত্র কালী কুমার। কালী কুমারের পুত্র রাজ কুমার (দত্তক), তদীয় পুত্র প্রসন্ন কুমার। প্রসন্ন কুমারের ৪ পুত্র রোহিণী কুমার, কামিনী কুমার, রমনী কুমার ও বিনোদ কুমার। রোহিণী কুমারের দুই পুত্র সুধাংশু ও প্রেমাংশু। কামিনী কুমারের ৩পুত্র হিমাংশু, শীতাংশু ও শুভ্রাংশু। রমনী কুমারের পুত্র সৌরাংশু। বিনোদ কুমারের পুত্র অমিয় কুমার সেন, তদীয় পুত্র অধ্যাপক ড. তপন কুমার রায়চৌধুরী। রাজারামের দ্বিতীয় পুত্র কালাচাঁদের পুত্র ছিল চন্দ্র কুমার, তদীয় পুত্র অন্নদা কুমার, তদীয় পুত্র নৃপেন্দ্র কুমার।


কৃষ্ণরামের কীর্তি

কৃষ্ণরামের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা বলরাম সেন পুবের বাড়ি এবং দ্বিতীয় ভ্রাতা বিষ্ণুরাম পশ্চিমের বাড়িতে বাস করতেন। কৃষ্ণরাম ১৬৮৮ খৃৃস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৭৫৯ খৃৃস্টাব্দে পরলোকগমন করেন। তার পুত্র নবকৃষ্ণ ১৭৫৭ খৃৃস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৮২৬ খ্রি. মৃত্যুবরণ করেন। তিনি গাবখান হতে কীর্তিপাশা খাল ও রাস্তা নির্মাণ করেন।


পরবর্তী জমিদারগণ ও তাদের কীর্তি

নবকৃষ্ণের পুত্র কালী কুমার বড় হিস্যার দশআনি ও ছোট হিস্যার ছয়আনির অধিকারী ছিলেন। কালী কুমারের জন্ম ১৮০৬ খ্রি. এবং ১৮২৮ খ্রি. দেহ ত্যাগ করেন। তার ষোড়শী স্ত্রী হরসুন্দরী সকলের নিষেধ সত্ত্বেও এবং জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট মি. গ্যারেটের উপস্থিতিতে চিতায় আরোহণ করেন। এ সময় রাজকুমার সেনকে দত্তক গ্রহণ করা হয়। রাজকুমার অল্প বয়সে ১৮৪৫ খ্রি. মারা যান। কথিত আছে, বাস-ার মহলানবিসরা তাকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করে। এ ঘটনা সম্পর্কে তখন একটি কবিতা প্রচলিত ছিল। রাজকুমারের পুত্র প্রসন্ন কুমার সেন ১৮৩৯ খ্রি. জন্মগ্রহণ করেন। বাজেরগঞ্জের সহকারী কালেক্টর মি. রেলী নাবালক প্রসন্ন কুমারের অভিভাবক নিযুক্ত হন। প্রসন্ন কুমার ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দের ১ জানুয়ারি কীর্তিপাশা মধ্য ইংরেজী স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। এ বিদ্যালয়টি ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দের ২২ জানুয়ারি উচ্চ ইংরেজী বিদ্যালয়ে পরিণত হয়। তিনি ১৮৭৬ খ্রি. মৃত্যুবরণ করেন। তার জ্যেষ্ঠপুত্র রোহিনী কুমার সেন ১৮৬৭ খ্রি. জন্মগ্রহণ করেন।

রোহিনী কুমার সেন বাংলা ভাষায় আটখানা বই রচনা করেন। তিনি এ জেলার ইতিহাস বাকলা রচনা করে জেলাবাসীর নিকট স্মরণীয় হয়ে আছেন। ১৯০৪ খ্রি. তার মৃত্যু হয়। তার মৃত্যুর পর তার পুত্র ১৯১৫ খ্রি. বাকলা বইটি প্রকাশ করেন। ছোট হিস্যার জমিদার শশীকুমার একজন সঙ্গীতজ্ঞ ছিলেন। তার প্রণীত হরিসঙ্কীর্তন হৃদয়গ্রাহী ছিল। তিনি ১৮৭১ খ্রি. কীর্তিপাশা দাতব্য চিকিৎসালয় প্রতিষ্ঠা করেন। রোহিণী সেনের ছোট ভাই বিনোদ কুমার সেন। তার পুত্র অমিয় কুমার রায় চৌধুরী। অমিয় কুমার রায় চৌধুরীর পুত্র ড. তপন কুমার রায় চৌধুরী।

ড. তপন কুমার রায় চৌধুরী ১৯৪১ খ্রি. বরিশাল জিলা স্কুল হতে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রথম স্থান অধিকার করেন। তিনি লন্ডনের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ছিলেন। তার লেখা বাঙ্গালানামা বিখ্যাত গ্রন্থ।



তথ্যসূত্র: ১। সিরাজ উদ্দীন আহমেদ। বরিশাল বিভাগের ইতিহাস (১ম খণ্ড)। ভাস্কর প্রকাশনী, ঢাকা। ২০১০।