কমিউনিস্ট পার্টি, বরিশাল

Barisalpedia থেকে

১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে ভারতীয় কমিউনিষ্ট পার্টি গঠিত হয়। বরিশালে শিল্প প্রতিষ্ঠান না থাকায় কমিউনিষ্ট পার্টি গড়ে উঠতে বিলম্ব হয়। বরিশালের ছাত্র-যুবক বিপ্লবী দলের অনুসারী ছিল। কারাগারে থাকার ফলে অনেক যুবক কমিউনিষ্ট মতবাদে আকৃষ্ট হয়। ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দের ৭ নভেম্বর বরিশালের কয়েকজন যুবক নিজেদের কমিউনিষ্ট বলে ঘোষণা করে।


প্রতিষ্ঠার ইতিহাস

গৈলার মুকুল সেন বরিশাল কমিউনিষ্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা। মুকুল সেন মাছুয়া বাজার বোমা মামলায় দণ্ডিত হয়ে আলিপুর জেলে বন্দী ছিলেন। জেলখানায় তিনি কমিউনিষ্ট নেতাদের সংস্পর্শে এসে ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে নিজকে কমিউনিষ্ট বলে ঘোষণা করেন। যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হলে ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দের ৭ নভেম্বর মুকুল সেন প্যারলে মুক্তি লাভ করে এবং দশজনকে নিয়ে সোশ্যালিষ্ট পার্টি গঠন করেন। সদস্য ছিলেন মুকুল সেন, নির্মল দাশগুপ্ত, সুশীল দাশগুপ্ত, প্রেমাংশু দাশগুপ্ত (কিষান), বীরেন রায়, দেবেন্দ্র বিজয় সেন গুপ্ত (কালাচাঁদ), সুশীল গুপ্ত, জুঁইফুল বসু, জ্যোতি দাশগুপ্ত, অমিয় দাশগুপ্ত (মহারাজ)। কমিউনিষ্ট পার্টি নিষিদ্ধ থাকায় বরিশাল পার্টি গণবাণী গ্রুপে যোগ দেয়। ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দের বরিশাল দল ভারতের কমিউনিষ্ট পার্টির অধীনে শাখা গঠন করে। পাঁচজনকে নিয়ে কমিটি গঠিত হলো-সদস্য বীরেন রায়, দেবেন্দ্র বিজয় সেনগুপ্ত, সুশীল দাশগুপ্ত, নির্মল দাশগুপ্ত, জ্যোতি দাশগুপ্ত। ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে অনেক বিপ্লবী মুক্তি লাভ করে কমিউনিষ্ট পার্টিতে যোগ দেন। কমিটির সম্পাদক ছিলেন জ্যোতি দাশগুপ্ত।

কমিউনিস্ট পার্টির প্রসার

১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে শৈলেন দাশগুপ্ত (রণুদা) বরিশাল সদর রোডে তরুণ সংঘ পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করেন। বিপ্লবীরা তরুণ সংঘ পাঠাগারে সমাজতন্ত্রের চিন্তাধারার সাথে পরিচিত হবার সুযোগ পায়। শংকর মঠে অনেক পত্রিকা আসত এবং তা পড়ে বিপ্লবীদের চিন্তার পরিবর্তন হতে থাকে। ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে ছাত্রদের মধ্যে কমিউনিষ্ট বলয় সৃষ্টি হয়। রফিকুল ইসলাম, মন্টু দাশগুপ্ত, বেলা গুপ্ত, সন্তোষ বসু ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে ছাত্র সম্মেলন আহ্বান করেন। কমিউনিষ্ট পার্টি কৃষক সমিতি ও নারী আন্দোলন শুরু করে। মনোরমা বসু, সরযু সেন, জুঁইফুল বসু, মনিকুন্তলা সেন, বেলা গুপ্তা, সুহাসিনী সেনগুপ্তা, রানী সেন, হরলাল দাশ, নৃপেন সেন পার্টিতে এলেন। ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে চাঁদসীতে কৃষক সম্মেলনের সময় জেলা কমিটি পুনর্গঠন করা হয় এবং কমরেড নীরেন ঘোষকে সম্পাদক করা হয়। কমিটির সদস্য ছিলেন কালু গাঙ্গুলী, সুরেশ গাঙ্গুলী, মনোরঞ্জন চক্রবর্তী, ফনি রায়, শান্তি সেন ও হীরামোহন চ্যাটার্জী। জেলা কংগ্রেসের সম্পাদক হীরালাল দাশগুপ্ত ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে কমিউনিষ্ট পার্টিতে যোগ দেন। ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে মানবেন্দ্র রায় বরিশালে এসেছিলেন। বরিশালের বেনু দাশগুপ্ত, ঝালকাঠির রাধিকা ব্যানার্জী এমএন রায়ের অনুগামী ছিলেন। ১৯৩৯-৪২ খ্রিস্টাব্দে বরিশাল কমিউনিষ্টদের সংখ্যা ৫০ জনের বেশি ছিল না। ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে সরকার কমিউনিষ্ট পার্টির উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়।

কমিউনিস্ট পার্টির কার্যক্রম

কমিউনিষ্ট পার্টি আগস্ট আন্দোলনে নীরব ছিল। তারা চেয়েছিল অখণ্ড ভারত এবং মিত্র শক্তির সাথে সহযোগিতা। কংগ্রেস ও কমিউনিষ্টদের সংঘর্ষ শুরু হয়। টাউন হলের কমিউনিষ্ট পার্টির সভা কংগ্রেস পণ্ড করে দেয়। বরিশাল সদর রোডে টাউন হলের বিপরীত দিকে টিনের ঘরে দোতালায় জেলা দপ্তর বসল। ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে জেলা পার্টির প্রথম প্রকাশ্য সম্মেলন বরিশাল মিউনিসিপ্যাল গার্লস স্কুলের অনুষ্ঠিত হয় এবং জেলা কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির সদস্যরা হলেন-অমৃত নাগ, কালু গাঙ্গুলী, বেনু দাশগুপ্ত, মুকুল সেন, সুশীল দাশগুপ্ত, দেবেন্দ্র বিজয় সেন, জ্যোতি দাশগুপ্ত, সুকুমার সেন, হীরালাল দাশগুপ্ত, অধীর চক্রবর্তী, নুটু ব্যানার্জী, শান্তি সেন, হিরন ভট্টাচার্য, বিজয় চ্যাটার্জী, কালিপদ দাশ, জুঁইফুল বসু, প্রফুল্ল চক্রবর্তী, নির্মল দাশগুপ্ত প্রমুখ। সম্মেলনের পর জেলা দপ্তর হাসপাতাল রোডে মন্টু দাশগুপ্তের পাকা বাড়িতে চলে যায়। সদর রোডে ট্রেড ইউনিয়ন, জেলা কৃষক সমিতি ও ছাত্র ফেডারেশনের অফিস ছিল। অমিয় কুমার দাশগুপ্ত মহারাজ বরিশাল-ফরিদপুর নিয়ে গঠিত জোনের প্রোভিনশিয়াল কমিটির অর্গানাইজার ছিলেন। বরিশাল পার্টির সম্পাদক নির্বাচিত হলেন জ্যোতি দাশগুপ্ত।

১৯৪৩-৪৪ খ্রিস্টাব্দে দুর্ভিক্ষের সময় বরিশাল কমিউনিষ্ট পার্টি উত্তর বরিশালকে বাঁচাও, মজুদ উদ্ধার ও লঙ্গরখানা আন্দোলন করে এবং পার্টি ৪০টি লঙ্গরখানা পরিচালনা করে। ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে বরিশালে মহামারী দেখা দেয়। মহামারী প্রতেিরাধের জন্য ডা. দীলিপ ব্যানার্জী, ডাঃ অমল কৃষ্ণ ঘোষ, সুধীর ঘোষকে নিয়ে মেডিকেল রিলিফ গঠন করা হয়। ১৯৪৪ ক্রিস্টাব্দে মহিলা আত্মরক্ষা সমিতির সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনে হাজরা বেগম, হেমপ্রভা মজুমদার, সুধা রায়, কমরেড ভবানী সেন, খোকা রায় প্রমুখ এসেছিলেন। মনিকুন্তলা সেন ও জুঁইফুল বসু সম্মেলনের পূর্বেই বরিশাল আগমন করেন। তখন তারা প্রাদেশিক নেত্রী। এই সম্মেলনে খেপুপাড়ার একটি মগ মহিলা দল যোগ দিয়েছিল। সম্মেলনের পর শহরে নারী কল্যাণ ভবন প্রতিষ্ঠা করা হয়।

১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের প্রথমদিকে জ্যোতি দাশগুপ্ত প্রাদেশিক সার্বক্ষনিক কর্মী নিযুক্ত হলে জেলা কমিটির সম্পাদক হন কমরেড অমিয় দাশগুপ্ত। ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে ভোলার রমনীমোহন দাশ, সমীর চক্রবর্তী, গোপাল পাল, মনসা মুখার্জী, যজ্ঞেশ্বর রায় ও সুধীর দেবকে নিয়ে পার্টি ইউনিট খোলা হয়। হিজলা, মুলাদী, গৌরনদী, উজিরপুর, বানারীপাড়া প্রভৃতি স্থানে কমিউনিষ্ট পার্টির ইউনিট ছিল। মনোরমা বসু মাসিমাকে কেন্দ্র করে বাকাই অঞ্চলে পার্টির কাজ এগিয়ে যায়। চাঁদসীর ডাঃ নলিনী দাশ, মুলাদীর কালীপদ দাশ, রাকুদিয়ার নজু ফরাজী কৃষকদের মধ্যে কমিউনিষ্ট আন্দোলনের প্রাণপুরুষ ছিলেন।

সাংস্কৃতিক অঙ্গনে কমিউনিস্ট পার্টি

বরিশালে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে কমিউনিস্ট পার্টির অবদান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে দিপালী সিনেমা হলে মহারাজের পরিচালনায় কমিউনিষ্টদের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের উদ্বোধন হয়। এ অনুষ্ঠানে দুর্ভিক্ষ নৃত্য প্রদর্শন ও ল্যাবরেটরি নাটক অভিনীত হয়। বংশী বাদক বিনয় বসু, খোল বাদক শৈলেন সেন, কিষান দাশগুপ্ত (যাত্রা) গান রচনায় ফনী চক্রবর্তী, তৃপ্তি দাশগুপ্তা, ইতু ব্যানার্জী, দীপ্তি দাশগুপ্তা প্রমুখ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতেন। বরিশালে কমিউনিষ্ট পার্টি প্রথম গণসঙ্গীত প্রচলন করে। সাংস্কৃতিক ফ্রন্টের নেতা ছিলেন নাণ্টু ব্যানার্জী। বরিশাল শহরে কমিউনিষ্ট পার্টির রিক্সা শ্রমিক ইউনিয়ন, প্রেস শ্রমিক ইউনিয়ন, বিড়ি শ্রমিক ও মেথর ইউনিয়ন ছিল। নরেন রায়, বাণী রায়, অশোক দাশগুপ্ত, সন্তোষ দাশগুপ্ত, ফনী চক্রবর্তী, অমৃত নাগ, বেনু দাশগুপ্ত ট্রেড ইউনিয়নের কাজ করতেন। পার্টির নির্দেশে অনেক কর্মী স্কুলের শিক্ষকতা ও দলের কাজ করে সুনাম অর্জন করেছেন। শিক্ষকদের মধ্যে ছিলেন মুকুল সেন, মেদাকুল ও কালকিনি স্কুল; হীরালাল দাশগুপ্ত, গলাচিপা স্কুল; হিরন ভট্টাচার্য গাভা ও গুঠিয়া স্কুল; সুধীর সেন, শিশির গুপ্ত, ননী গোপাল ভট্টাচার্য, ব্রজ গোপাল ভট্টাচার্য, অজয় সেন, অরুণ দাশগুপ্ত, সুধাংশু দাশগুপ্ত, রফিকুল ইসলাম, জগদীশ আইচ, অজিত বিশ্বাস, অমল গাঙ্গুলী, বীণা সেন, বীণা দাশ, অসিত রঞ্জন ভট্টাচার্য, দেব কুমার চক্রবর্তী প্রমুখ।


উপসংহার

ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ও স্বাধীনতা আন্দোলনে কমিউনিষ্ট পার্টির অনেক কর্মী নির্যাতিত হয়েছেন। মুকুল সেন, জ্যোতি ব্যানার্জী, ফনী রায়, নুটু ব্যানার্জী, অমিয় কুমার দাশগুপ্ত প্রমুখ অনেকদিন অন্তরীণ ছিলেন। প্রশান্ত দাশগুপ্ত, স্বদেশ বসু, শান্তি গোপাল ব্যানার্জী, রফিকুল ইসলাম, কল্পনা দত্ত প্রমুখ গ্রেফতার হয়েছিলেন। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত কমিউনিষ্ট পার্টি ও ছাত্র ফেডারেশন ব্রিটিশবিরোধী অবিরাম আন্দোলন ও কর্মতৎপরতার যে কৃতিত্ব দেখিয়েছে তা বরিশালের রাজনীতির ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে থাকবে।



তথ্যসূত্র: ১। সিরাজ উদ্দীন আহমেদ। বরিশাল বিভাগের ইতিহাস (১ম খন্ড)। ভাস্কর প্রকাশনী, ঢাকা। ২০১০।