কমলা দেবী/ রানী

Barisalpedia থেকে

কমলা দেবী তথা কমলা রানী মহিলা হিসেবে বাংলার প্রথম এক স্বাধীন রাজ্য শাসক। তিনি চন্দ্রদ্বীপ রাজ্যের রাষ্ট্র পরিচালক তথা রানী ছিলেন। তিনি চন্দ্রদ্বীপ রাজা জয়দেবের কন্যা ছিলেন। পিতার মৃত্যুর পর ১৪৯০ সালে তিনি চন্দ্রদ্বীপের সিংহাসনে আরোহণ করেন।


প্রাথমিক জীবন

রাজা জয়দেবের কোন পুত্রসন্তান ছিল না। কমলা ও বিদ্যাসুন্দরী নামে তার দুই কন্যা ছিল। কন্যাদ্বয়ের মধ্যে কমলা ছিলেন প্রতিভাময়ী। পিতার নির্দেশে তিনি রাষ্ট্র পরিচালনা ও অস্ত্রচালনা শিক্ষা লাভ করেন। রাজ্যের শ্রেষ্ঠ পন্ডিতদের নিকট তিনি সংস্কৃত ও বাংলা ভাষায় জ্ঞান লাভ করেন। বিভিন্ন শাস্ত্রেও তিনি অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। রাজা জয়দেব কমলা দেবীকে বাবুগঞ্জ থানার দেহেরগতির গ্রামে উষাপতির পুত্র বলভদ্র বসুর সাথে বিয়ে দেন। উল্লেখ্য দেহেরগতির বসু, কাকরদা ও গাভার ঘোষ এবং বানারীপাড়ার গুহ পরিবার বাকলা রাজদরবারে দায়িত্বপূর্ণ পদে আসীন ছিলেন।


প্রাথমিক দাম্পত্য জীবন

বলভদ্র বসু বিদ্যোৎসাহী ছিলেন। তিনি বিভিন্ন শাস্ত্রে পন্ডিত ছিলেন। যুদ্ধবিদ্যায় তিনি বাকলা রাজ্যের মধ্যে অতুলনীয় ছিলেন। বলভদ্র বসুর গুণে মুদ্ধ হয়ে রাজা জয়দেব তাকে জামাতা হিসেবে গ্রহণ করেন। কথিত আছে বলভদ্র বসু দেখতে কালো ছিলেন। তাই প্রজারা তাকে কালা রাজা বলত। গলাচিপা থানার কালা রাজার বিল তার নামে হয়েছে বলে মনে করা হয়। বলভদ্র বসু ও কমলা বিয়ের পর গলাচিপা থানার এই এলাকায় বাস করতেন। রাজা জয়দবে জামাতা ও কন্যার জন্য এখানে রাজবাড়ি নির্মাণ করে দেন। জয়দেবের মৃত্যুর পর কমলা স্বামীকে নিয়ে বাকলার রাজবাড়িতে আসেন (তৎকালীন কচুয়ায়?)। ১৯ শতকের প্রথমভগে কালা রাজার বিলে আবাদ করার সময় প্রাচীন দালানের ইট ও দীঘি আবিষ্কৃত হয়। স্থানীয় নমঃশূদ্ররা দাবি করে যে তাদের রাজা এখানে বাস করত। ১৭৬৩ খ্রিস্টাব্দের ভূমিকম্পের সময় কালা রাজার বাড়িসহ গ্রামটি নিচে দেবে যায় এবং বিলে পরিণত হয়।

রাজকুমারী কমলা বিয়ের পর দেহেরগতি চলে যান। সেখানে কিছুদিন অবস্থানের পর স্বামী বলভদ্র বসুসহ বাকলার রাজধানীতে ফিরে আসেন। পরে তারা পিতার নির্দেশে তাদের জন্য নির্মিত বাড়িতে (কালা বাজার বাড়ি) বসবাস করেন।


রানীর সিংহাসনে আরোহণ

মুত্যুর পূর্বে রাজা জয়দেব কমলাকে সিংহাসনের উত্তরাধিকারিণী ঘোষণা করেন। খুব সম্ভব রাজকুমরী কমলা ১৪৯০ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে আরোহণ করেন। স্বামী বলভদ্র বসু তাকে রাজকার্যে সহায়তা করতেন। রাজ্য শাসন ও প্রজা পালনে কমলা অসামান্য কৃতিত্বের পরিচয় দেন। তার সমসাময়িক গৌড়ের সুলতান ছিলেন আলাউদ্দিন হোসেন শাহ। জনগণের কল্যাণের জন্য কমলা পুকুর ও দীঘি খনন করেন। তিনি অনেক রাস্তা ও সেতু নির্মাণ করেন। তখন বাকলার জল খুব লবণাক্ত ছিল। পানীয়জলের অভাব নিবারণের জন্য রাজ্যের মধ্যে তিনি অনেক বড় বড় দীঘি খনন করেন। দীঘিগুলোর মধ্যে কমলা ও বিদ্যাসুন্দরীর দীঘি অন্যতম। তেঁতুলিয়া নদীর পূর্ব পড়ে বিদ্যাসুন্দরী দীঘি এবং পশ্চিম পাড়ে কালাইয়া গ্রামে কমলার দীঘি। তখন তেঁতুলিয়া নদী একটি খালের মতো ছিল।


কমলার দীঘি খনন

রাণী কমলা রাজ্যের মধ্যে বৃহত্তম দীঘি খনন করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। স্বামী বলভদ্র বসু ও মন্ত্রীসভা প্রস্তাবে সম্মত হন। প্রবাদ আছে রাণী কমলা যতদূর একবারে ঘুরে আসতে পারেন ততদূর নিয়ে একটি দীঘি খনন করা হবে। রাণী কমলা ভোরে অর্চনা শেষ করে হাঁটা শুরু করলেন। পিছনে স্বামী বলভদ্র বসু ও সভাসদগণ। তারা দেখলেন রানী ক্লান্ত না হয়ে হেঁটে চলেছেন। রানী আরও অগ্রসর হলে দীঘির আয়তন বেশি হবে এবং দীঘি খনন করা সম্ভব হবে না। তাই সভাসদদের পরামর্শে বলভদ্র বসু কমলার পায়ে কবুতরের রক্ত ছিটিয়ে দেন। কমলা দেখলেন দেখলেন তার পা দিয়ে রক্ত ঝরছে। তিনি হাঁটা বন্ধ করে রাজপ্রাসাদে ফিরে গেলেন। জরিপ করে দেখা গেল রানী ৩ দরুন ১৩ কানি অর্থাৎ ১০০ একর ভূমি ঘুরেছেন। দীঘি খনন করার জন্য রানী কমলা সভাসদদের নির্দেশ দেন।

দীঘি খনন করার সংবাদ রাজ্যের মধ্যে প্রচারিত হলে হাজার হাজার লোক রানীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে রাজধানী অভিমুখে যাত্র করেন। ভোলার দেউলী নিবাসী কালাভদ্র নাথ কর্মকার দীঘি খনন করার জন্য প্রয়োজনীয় কোদাল সরবরাহ করার দায়িত্ব নেন। কালাভদ্র নাথের ২৭ পুত্র ও ১৩ জন নাতি ছিল। তিনি পুুত্র ও নাতিদের নিয়ে কোদাল তৈরি করলেন। হাজার হাজার ঝুড়ি তৈরি হলো। দীঘির কাজ যথাসময় শুরু হল। রানী শ্রমিকদের খাওয়া-থাকার সুবন্দোবস্ত করেন। কয়েক মাস মাটি কাটা চলল। একদিন দীঘি কাটা শেষ হলো। বিরাট উঁচু পাড়। এত বড় দীঘি বাকলা রজ্যে বা দক্ষিণবঙ্গে কেউ কোনদিন খনন করেনি। দীঘি খননে সর্বমোট নয় লক্ষ টাকা খরচ হয়।


কমলার দীঘি বিষয়ক উপাখ্যান

খননের পরে দীঘিতে পানি উঠছে না দেখে রানী ব্যাকুল হয়ে পড়লেন। তিনি ব্রাহ্মণদের দিয়ে পূজা করালেন। কাঙ্গালী ভোজ দিলেন। কিন্তু তবু দীঘিতে পানি উঠল না। প্রজার অনেকে রানীকে দোষারোপ করছে যে, দেবতারা তার ওপর অসন্তুষ্ট। রানী অত্যন্ত চিন্তিত হয়ে পড়লেন। কথিত আছে একদিন রাতে রানী স্বপ্নে দেখলেন, তিনি যদি দীঘিতে নেমে গঙ্গাদেবীকে পূজা করেন এবং এক পাড় থেকে আর এক পাড়ে হেঁটে যান তাহলে দীঘি পানিতে ভরে যাবে। রানী দীঘিতে অবতরণ করে গঙ্গাদেবীকে পূজা দিয়ে এক পাড় থেকে আর এক পাড় অতিক্রম করছেন। ব্রাহ্মণকুল, স্বামী ও প্রজারা একদৃষ্টিতে কমলার দিকে চেয়ে আছেন। রানী যখন দীঘির মাঝখানে তখন চারদিক থেকে পানি আসছে। পানি দেখে রানী নিশ্চল দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি জলমগ্ন হয়ে যাচ্ছেন দেখে স্বামী ও আত্মীয়রা তাকে উপরে উঠে আসার জন্য বার বার অনুরোধ করল। কিন্তু রানী উঠতে পারছে না। কমলা স্বামীকে বললেন, তিনি গঙ্গাদেবীর সাথে নিরাপদ আশ্রয়ে যাচ্ছেন। তবে তিনি প্রতিশ্রুতি দিলেন প্রতিদিন এসে তিনি তার শিশুপুত্রকে দুগ্ধ পান করাবেন। এই বলে রানী আস্তে আস্তে দীঘির গভীর পানিতে ডুবে গেলেন। রানীর অকাল মৃত্যুতে স্বামী, আত্মীয়স্বজন ও সভাসদগণ খুব দুঃখ পেলেন। ধাত্রী শিশুপুত্রকে নিয়ে দীঘির ঘাটে আসতেন। রানী কমলা দীঘি থেকে উঠে সন্তানকে দুধ পান করাতেন। স্বামী একদিন আড়াল থেকে কমলাকে দেখলেন। দীঘিতে ডুবে যাওয়ার পূর্বে কমলা স্বামীকে নিষেধ করে দিয়েছিলেন যে, তিনি যেন কোন সময় তাকে স্পর্শ না করেন। তাকে স্পর্শ করলে তিনি আর কোনদিন আসবেন না। নিষেধ অমান্য করে রাজা কমলাকে ধরতে গেলেন। রানী পুত্রকে রেখে দীঘিতে ঝাঁপ দিলেন। রানী আর কোনদিন ফিরে আসেননি। দীঘির এক পাড় ভেঙ্গে তিনি গঙ্গাদেবীর সাথে সাগরে চলে যান।

আবার কেউ চলেন রানী কমলা এই ঘটনার পর পদ্মফুল হয়ে অমরত্ব লাভ করেন। দীঘির মাঝে পদ্মফুল জন্মিল। এই পদ্মফুলই নাকি রানী কমলা। রানী কমলার মৃত্যু কাহিনী অবশ্যই নিছক উপাখ্যান। তবে এ কথা ঠিক যে, তিনি ঐ দীঘিতে ডুবে মারা যান। রানী কমলা সে দিনের ব্রাহ্মণ ও জ্যোতিষীদের অন্ধ বিশ্বাসের শিকার হয়েছিলেন অথবা কোনো গভীর চক্রান্তের শিকার হয়েছিলেন।


কমলার গান

রানী কমলার করুণ মৃত্যুকাহিনী বাকলার রাজ্যে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ল। সবাই তার মৃত্যুতে গভীরভাবে অভিভূত হয়ে পড়ে। কমলার মৃত্যুকে নিয়ে কবি-সাহিত্যিকগণ গল্প ও গান রচনা করল। শত শত বছর ধরে ‘কমলার গান’ এ অঞ্চলে গীত হতো। কমলার কহিনী মুখে মুখে শোনা যেত। কমলার গানগুলো সংগ্রহের অভাবে হারিয়ে যাচ্ছে। বাউফল-গলাচিপায় এখনও অনেকে কমলার গান মুখস্থ বলতে পারে। অদূর ভবিষ্যতে হয়ত এ গান শোনা যাবে না। কিন্তু কমলার দীঘি ও প্রজাদের জন্য তার আত্মত্যাগ যুগ যুগ ঘরে মানুষ স্মরন করবে।


কমলার দীঘির বর্তমান চিত্র

কমলার দীঘি ভরে গেছে। দীঘির পূর্বপাড় তেঁতুলিয়া নদীতে বিলীন হয়েছিল। বর্তমানে চর পড়েছে। দীঘির পাড়গুলো এখনও ২০ থেকে ২৫ ফুট উঁচু। পাড়ের ওপর গড়ে উঠছে জনবহুল গ্রাম। গ্রামের নাম শৈলা। ১৮৭৪ খ্রিস্টাব্দে বাকেরগঞ্জের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মিঃ বেভারিজ বাউফল থানার কালাইয়া গ্রমে অবস্থিত কমলার দীঘি পরিদর্শন করেন। তখন তিনি ভরে যাওয়া দীঘিতে ধান চাষ করতে দেখেছেন। মিঃ বেভারিজ রানী কমলার বিষয়ে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন।


কৃতিত্ব

রানী কমলাদেবী ১৫ শতকের শেষভাগে স্বাধীনভাবে চন্দ্রদ্বীপ রাজ্য শাসন করেন। তার পূর্বে বা পরে কোন বাঙালী মহিলা রাজ্য শাসন করেননি। রাজকুমরী কমলাই প্রথম এবং শেষ মহিলা যিনি রাজ্য শাসন করে চন্দ্রদ্বীপ তথা বাংলার ইতিহাসে নারী সমাজের মুখোজ্জ্বল করেছেন। মহিলা হয়ে মধ্যযুুগে রাজ্য শাসন করা অকল্পনীয় ছিল। আজ ভাবতে অবাক লাগে সুলতানী আমলে চন্দ্রদ্বীপ রাজপরিবারের এক রাজকুমারী রাজ্য শাসন করে অদ্ভুত দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। তিনি অসামান্য প্রতিভার অধিকারিণী ছিলেন। তিনি বাংলার ইতিহাসে এক তুলনাহীন চরিত্র। মানব কল্যাণে নিজের প্রাণ বিসর্জন দিয়ে তিনি যে দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছেন তার দ্বিতীয় উদাহরণ আমাদের জানা নেই। তাই রাজকুমারী কমলা অনন্য ও অতুলনীয়।



তথ্যসূত্র: ১। সিরাজ উদ্দীন আহমেদ। বরিশাল বিভাগের ইতিহাস (প্রথম খণ্ড)। ভাস্কর প্রকাশনী, ঢাকা। ২০১০।