আশু আকন্দ

Barisalpedia থেকে

ইংরেজ তথা তাদের তাবেদার জমিদার বিরোধী কৃষক বিদ্রোহে মেহেন্দিগঞ্জের আশু আকন্দ একটি কিংবদন্তিতুল্য নাম। ১২৮৬ সন বা ১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দে আশু আকন্দের নেতৃত্বে মেহেন্দিগঞ্জ থানায় কৃষক বিদ্রোহ ঘটে। বাংলাদেশে কৃষক আন্দোলনে আশু আকন্দের অবদান ও আত্মত্যাগ অতুলনীয়।


বংশ পরিচয়

মেহেন্দিগঞ্জ থানার চাঁদপুর গ্রামে আশু আকন্দের জন্ম। আশু আকন্দের পূর্বপুরুষ শেখ কুতুবউদ্দিন একজন প-িত ও ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি ছিলেন। শেখ কুতুবউদ্দিনের পুত্র শেখ মোহন বিশ্বস্ত হিসেবে খ্যাত ছিলেন। লোকে তাকে মোহন শেখ বিশ্বাস বলত। শেখ মোহনের পুত্র জহিরুদ্দিন আকন। তার পুত্র আশু আকন্দ একজন উচ্চ শিক্ষিত যুবক ছিলেন।


বিদ্রোহের প্রেক্ষাপট ও সম্প্রসারণ

উনিশ শতকের মধ্যভাগে উলানিয়ার জমিদারদের কৃষক নির্যাতন ও শোষণ চরমে পৌঁছে। আশু আকন্দ জমিদারদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। ১২৮৬ সনে (১৮৭৯ খৃৃস্টাব্দে) আশু আকন্দ উলানিয়া ও পার্শ্ববর্তী ২২টি গ্রামের কৃষকদের সংঘবদ্ধ করেন। তার আহবানে কৃষকরা উলানিয়া জমিদারদের খাজনা দেয়া বন্ধ করে দেয়। আশু আকন্দের চাঁনপুর গ্রামকে কেন্দ্র করে আন্দোলন তুঙ্গে ওঠে। এ কারণে চাঁদপুরের অপর নাম জোট চাঁনপুর। ২২টি গ্রামের কৃষক নেতাদের সভা আহবান করেন এবং ১০ সদস্যের কমিটি গঠন করেন। তারা মসজিদে প্রতিজ্ঞা করে যে, তারা অত্যাচারী জমিদারদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার জন্য ঐক্যবদ্ধ থাকবে। জমিদারদের নায়েব, পেয়াদা ও লাঠিয়ালদের আক্রমণ আশু আকন্দের নেতৃত্বে বিদ্রোহী কৃষক সমাজ প্রতিহত করে। উলানিয়ার জমিদাররা আশু আকন্দকে ২২ মৌজার তালুক প্রদানের প্রস্তাব দিলে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। জমিদার বিদ্রোহী প্রজাদের জমি নিলামে দেয়। প্রজারা ঐক্যবদ্ধ থাকায় নিলামী জমি ক্রয়ের কোন ক্রেতা পাওয়া যায়নি।

নিলাম বিক্রি কার্যকর করার জন্য সরকার ১০ জন শিখ সৈন্য প্রেরণ করে। জমিদার প্রথমে নাপিতের বাড়ি আক্রমণ করে। পূর্বের সিদ্ধান্ত অনুসারে নন্দবাসী পাল সঙ্কেত দিলে হাজার হাজার লোক নাপিতের বাড়ি আসে। জমিদারের বাহিনী গুলি করে কয়েকজন কৃষককে হত্যা করে। কিন্তু জনতার কাছে জমিদারদের বাহিনী পরাজিত হয়ে শিখ সৈন্যসহ পালিয়ে যায়। জমিদার মামলা করে। কিন্তু কোন প্রজা আশু আকন্দের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেয়নি।


আশু আকন্দের বন্দিত্ব ও মৃত্যু

জমিদার অবশেষে আশু আকন্দের বন্ধু ভবতোষ তরফদারকে তালুক প্রদানের লোভ দেখিয়ে বশীভূত করে। ভবতোষ আশু আকন্দকে তার বাড়িতে দাওয়াত দেয়। ১২৮৬ সনের ১৫ ফাল্গুন আশু আকন্দ ২ জন সাথী নিয়ে ভবতোষের বাড়ি যায়। সংবাদ পেয়ে জমিদার সৈন্য ও কুকুর নিয়ে আশু আকন্দকে আক্রমণ করে। ভবতোষের স্ত্রী ষড়যন্ত্রের কথা আশু আকন্দকে জানিয়ে দিলে তিনি ঘোড়ায় উঠে পালিয়ে যান। কিন্তু পথে খেজুর গাছে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যান। জমিদার ও কুকুর তাকে ঘিরে ফেলে। জমিদার তাকে বন্দী করে বাড়ি নিয়ে যায়। সংবাদ শুনে হাজার হাজার লোক জমিদার বাড়ি আক্রমণ করে। জমিদার বাহিনী গুলি করলে তারা পিছু হাটতে বাধ্য হয়। তারা থানায় মামলা করে। পুলিশ আসে ৭ দিন পর। পুলিশ তৎক্ষণাৎ আশু আকন্দকে উদ্ধারে কোন চেষ্টা করেনি।

আশু আকন্দকে বন্দী করে জমিদারের লোকেরা তার ওপর অমানুষিক নির্যাতন করে। প্রথমে তার পায়ের আঙ্গুল কেটে ফেলা হয়, শরীরে চামড়া উঠিয়ে লবণ দেয়, চোখ উপড়ে ফেলে। অবশেষে গরম তেলের কড়াইতে তাকে ছেড়ে দেয়। কই মাছের মতো তাকে ভাজা হয়। তার মৃতদেহের কোন সন্ধান পাওয়া যায়নি।


উপসংহার

আশু আকন্দের স্ত্রী আতরজান বিবি মামলা করে। মামলায় কিছু হয়নি। তবে জমিদারী কোর্ট অব ওয়ার্ডের নিকট অর্পণ করে প্রজাদের সান্ত¦না দেয়া হয়। আশু আকন্দের এক কন্যা ছিল। নাম হোসেন আরা। কন্যার বংশধর জীবিত আছে। আশু আকন্দের ভাই নছরউদ্দীনের পৌত্র জসিম উদ্দিন এখনো জীবিত আছে। জমিদারদের নির্যাতনের প্রতিবাদ করায় আশু আকন্দকে প্রাণ দিতে হলো। সরকার এ নির্মম হত্যার কোন বিচার করেনি। বিদ্রোহী কৃষক সমাজ নীরবে নিভৃতে আশু আকন্দের জন্য কেঁদেছে। আজও এ অঞ্চলের মানুষ আশু আকন্দের বীরত্বের কথা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে।



তথ্যসূত্র: ১। সিরাজ উদ্দীন আহমেদ। বরিশাল বিভাগের ইতিহাস (১ম খন্ড)। ভাস্কর প্রকাশনী, ঢাকা। ২০১০।