আলতাফ উদ্দীন

Barisalpedia থেকে

রাজনীতিবিদ ও বৃটিশবিরোধী কর্মী আলতাফ উদ্দীনের জন্ম ১৯০৭ সালে বাবুগঞ্জ থানার আগরপুর গ্রামে। তাঁর পিতার নাম ফয়েজ উদ্দীন আহম্মদ।

রাজনৈতিক নেতৃত্বের উন্মেষ

আলতাফ উদ্দীন যখন দশম শ্রেণির ছাত্র, তখন পটুয়াখালীতে এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের সূত্রপাত ঘটে। এ সময় তিনি তাঁর বলিষ্ঠ নেতৃত্বের দ্বারা স্থানীয় উচ্ছৃঙ্খল জনতাকে সুনিয়ন্ত্রিত ও সুসংগঠিত করতে সক্ষম হন। ১৯২৭ সালে পোনাবালীর কুলকাঠি গ্রামে মসজিদের সম্মুখ দিয়ে গানবাদ্যসহ পূজার শোভাযাত্রা নিয়ে যাওয়ার ঘটনায় এক সংঘর্ষ বাঁধে। বিল্পবী সতীন সেন ঘটনার পুরো ভাগে ছিলেন বলে আবুল মনসুর আহমদের ‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়। সতীন সেনের প্ররোচনায় জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট মিঃ ব্লান্ডির আদেশে মুসলমানদের ওপর গুলি বর্ষণ করা হয় এবং এতে ঊনিশ জন মুসলমান নিহত হয়। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে সারা ভারতে মুসলমানদের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। ১৯২৭ সালে বরিশাল কুলকাঠি হত্যার প্রতিবাদে এক বিরাট সম্মেলন হয়। এ সম্মেলনে স্যার আবদুর রহিম, শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী প্রমুখ নেতৃবৃন্দ যোগ দেন। এ সম্মেলনকে সাফল্যমন্ডিত করার জন্য আলতাফ উদ্দীন কঠোর পরিশ্রম করেন।

দলীয় রাজনীতিক কর্মকাণ্ড

১৯৩০ সালের পর আলতাফ উদ্দীন প্রজা আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। এ সময়ে তিনি খেপুপাড়া কলেরা ইনজেকশন অফিসে চাকুরী গ্রহণ করেন। রাজনীতি থেকে দুরে সরে রাখার জন্য তাকে এই চাকুরী গ্রহণ করতে বাধ্য করা হয়। খেপুপাড়ায় চাকুরীরত অবস্থায় তিনি ফরিদপুর জেলার কালকিনী থানার গোপালপুর নিবাসী লুৎফুর রহমানের কন্যা হুরুন্নাহার বেগমকে বিয়ে করেন। ১৯৩৬ সালে পটুয়াখালীতে শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক ও খাজা নাজিম উদ্দীন নির্বাচনে অবতীর্ণ হন। আলতাফ উদ্দীন ইংরেজ সৃষ্ট জমিদার প্রথার উচ্ছেদ ও কৃষকদের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হকের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারাভিযান চালান। নির্বাচনে ফজলুল হক জয়লাভ করে বাংলার প্রধানমন্ত্রী হন।

সমাজসেবা ও মানবসেবা

১৯৩৭ সালে আগরপুরে ম্যালেরিয়া মহামারী আকার ধারণ করলে তারই অক্লান্ত প্রচেষ্টায় আগরপুরে একটি দাতব্য চিকিৎসালয় স্থাপিত হয়। আলতাফ উদ্দীন ১৯৩৮ সালে চাকুরী ত্যাগ করে নিজ গ্রাম আগরপুরে চলে আসেন এবং পল্লী সেবায় নিয়োজিত হন। সকল বাধা উপক্ষো করে তিনি ১৯৩৯ সালে বাবুগঞ্জের আগরপুরে মডেল একাডেমী প্রতিষ্ঠা করেন। গ্রামের সর্বাঙ্গীন উন্নতির জন্য তিনি সর্বদা চেষ্টা করতেন। জনগণের অনুরোধে তিনি আগরপুর ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট হন। প্রেসিডেন্ট থাকাকালে তিনি রাস্তাঘাট নির্মাণ, শিক্ষাবিস্তারে আত্মনিয়োগ করেন। ১৯৪১ সালে শ্যামা-হক মন্ত্রীসভা গঠনের পর তিনি মুসলীম লীগে যোগ দেন এবং পাকিস্তান দাবী সমর্থন করেন। তিনি জেলা বোর্ড নির্বাচনেও অংশগ্রহণ করেন। পটুয়াখালী সত্যাগ্রহ আন্দোলন, কুলকাঠি হত্যা, কলকাতা ও নোয়াখালীর দাঙ্গা আলতাফ উদ্দীনের রাজনৈতিক চিন্তাধারার পরিবর্তন আনে।

সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা রোধে অবদান

১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর তিনি উপলব্ধি করলেন একদল সুবিধাবাদী সরকারের ছত্রছায়ায় হিন্দুদের পরিত্যক্ত জমি, সরকারী দফতর ও ব্যবসা-বাণিজ্য দখল করছে এবং জনসাধারণকে শোষণ করছে। ১৯৫০ সালে ফেব্রুয়ারী মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে তৎকালীন সরকারের একজন উর্ধ্বতন নেতা বরিশালে আগমন করেন। বরিশাল কীর্তনখোলা নদীর বুকে লঞ্চে ষড়যন্ত্রের অন্যতম নায়ক ছিলেন তৎকালীন অবাঙ্গালী জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট জি. এ. ফারুক, এস. পি মোহাম্মদ আলি বশির ও সাম্প্রদায়িক দলের কয়েকজন নেতা। একদল সমাজ বিরোধীদের হাতে অস্ত্র তুলে দেয়া হয়। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে নিস্ক্রিয় করে রাখা হয়। বরিশাল শহরে ১৪ ফেব্রুয়ারী দাঙ্গা শুরু হলে এই দাঙ্গা রোধ করার মানসে আলতাফ উদ্দীন এগিয়ে আসেন এবং হিন্দু সম্প্রদায়কে আশ্বাস প্রদান করেন যে, তার দেহে এক বিন্দু রক্ত থাকতে কেউ তাদের ক্ষতি সাধন করতে পারবে না। তিনি উচ্ছৃঙ্খল দিশাহারা জনতাকে ফিরে যেতে অনুরোধ করেন। কিন্তু সেদিন সেই উচ্ছৃঙ্খল জনতা তার কথায় কর্ণপাত না করে তাকেই নির্মমভাবে হত্যা করে। নিজের জীবন দিয়েও তারই দেওয়া ওয়াদা রক্ষা করে হাজার হাজার হিন্দুদেরকে অকাল মৃত্যুর হাত হতে রক্ষা করেছিলেন। তাই তিনি বরিশালের ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবেন।

মৃত্যু

এভাবে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গারোধের প্রয়াসে ১৯৫০ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি জনাব আলতাফ উদ্দীন তাঁর জীবন উৎসর্গ করলেন। ১৯৫২ সালে তাঁর স্মৃতিরক্ষার্থে রায় বাহাদুর আর.পি. সাহার বিদ্যালয়টি ‘আলতাফ মেমোরিয়াল উচ্চ বিদ্যালয়” নামকরণ করা হয়। তা ছাড়া মরহুমের স্মৃতিকে বহন করে দাঁড়িয়ে রয়েছে বরিশাল শহরে একটি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়।


তথ্যসূত্র: রুসেলি রহমান চৌধুরী। বরিশালের প্রয়াত গুণীজন। ইউনিভার্সিটি বুক পাবলিশার্স, ঢাকা। ২০০৬।