আবদুর রহমান চৌধুরী

Barisalpedia থেকে

বিচারপতি আবদুর রহমার চৌধুরীর পিতার নাম আবদুল লতিফ চৌধুরী। জন্ম: ২৫ নভেম্বর ১৯২৬ সাল। মৃত্যু: ১১ জানুয়ারি ১৯৯৪ সাল। গ্রাম: উলানিয়া। থানা: মেহেন্দীগঞ্জ। জেলা: বরিশাল। বিচারপতি আবদুর রহমার চৌধুরী মেহেন্দিগঞ্জের তথা বরিশালের অন্যতম কৃতী সন্তান।

লেখাপড়া

ঢাকার সেন্ট ফ্রান্সিস জেভিয়ার্স থেকে বিচারপতি চৌধুরীর ছাত্র জীবনের সূচনা। তিনি ১৯৪০ সালে বরিশাল জেলা স্কুল থেকে স্টার মার্কসসহ প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাশ করেন এবং ইংরেজিতে সর্বোচ্চ নাম্বার পাওয়ার জন্য ‘ডি সিলভা স্বর্ণপদক’ লাভ করেন। এরপর তিনি কলকাতায় পড়াশোনা করেন। ১৯৪৭ সালের দিকে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং এম.এ এবং এল.এল.বি ডিগ্রি লাভ করেন।

রাজনীতি

বিচারপতি চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ছাত্র নেতৃত্বর সূচনা থেকে ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহন করেন। তিনি ১৯৪৮-৮৯ সালে সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে ছাত্র সংসদের ভিপি ছিলেন। ১৯৪৭ সালের ৬ই ডিসেম্বর পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মাত্র ৪ মাসের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সচেতন ছাত্র সমাজ রাষ্ট্রভাষা বাংলা দাবীতে ভাষা আন্দোলনের স্থপতি অধ্যাপক আবুল কাসেমের সভাপতিত্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের বেলতলায় এক প্রতিবাদ সভায় মিলিত হয়। ছাত্র নেতৃবৃন্দের মধ্যে এ সভার অন্যতম বক্তা ছিলেন আবদুর রহমান চৌধুরী। ১৯৪৮ সালের মার্চে পাকিস্তানের তৎকালীন গভর্ণর জেনারেল কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ পূর্ব পাকিস্তান সফরে এলে তাঁর সঙ্গে ছাত্র নেতৃবৃন্দের যে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়, সে বৈঠকে আবদুর রহমান চৌধুরী পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগের নেতৃত্ব দেন। উক্ত বৈঠকে ছাত্রদের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবীটাও গুরুত্বের সাথে উত্থাপিত হয়। তিনি পুনর্গঠিত ও সম্প্রসারিত প্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন। ১৯৪৮ সালের নভেম্বও মাসে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান পূর্ব পাকিস্তান সফরে এলে তাঁকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সমাজের পক্ষ হতে রাষ্ট্রভাষা বাংলা ও পূর্ব পাকিস্তানের অন্যান্য দাবী সম্বলিত যে ঐতিহাসিক স্মারকলিপি প্রদান করা হয়, তা প্রণয়নের দায়িত্ব অর্পিত হয়েছিল আবদুর রহমান চৌধুরী উপর। তিনি যথার্থভাবে দায়িত্ব পালন করে উক্ত স্মারকলিপি প্রণয়ন করেন। তিনি ১৯৪৮ সালে ভারতে অনুষ্ঠিত দক্ষিণ-র্পূব এশিয়ার ছাত্র যুব সম্মেলনের তৎকালীন পাকিস্তান প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন। উক্ত সম্মেলনে তিনি আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে বাংলা ভাষায় ভাষণ দেন। কোন আন্তর্জাতিক সম্মেলনে সম্ভবতঃ এটাই প্রথম বাংলায় ভাষণের দৃষ্টান্ত। ১৯৫৫ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসিতে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক যুব সম্মেলনে তিনি পাকিস্তান প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে সাহিত্য-সংস্কৃতি অঙ্গনেও উজ্জল কর্মতৎপরতার স্বাক্ষর রাখেন। ১৯৪৮ সালে অকফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ডিবেটিং টিম ঢাকা সফরে এলে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ডিবেটিং টিমের নেতৃত্ব দেন।

কর্মজীবন

বিচারপতি চৌধুরী ১৯৫৫ সালে ঢাকা হাইকোর্টে আইনজীবী হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৫৮ সাল থেকে ১৯৭৩ সাল পযর্ন্ত তিনি সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী হিসেবে যথেষ্ট সুনাম অজর্ন করেন। তিনি ১৯৬৬-১৯৬৮ সালে র্পূব পাকিস্তান হাইকোর্ট বার এসোসিয়েশনের সেক্রেটারী জেনারেল এবং ১৯৬৯ সালে ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ১৯৬৯ সালে তিনি ন্যাশনাল শিপিং কর্পোরেশনের পরিচালক নিবার্চিত হন। শিপিং কর্পোরেশনের সম্প্রসারণ ও শেয়ার হোল্ডারদের স্বার্থ সংরক্ষণে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭৩ সালে তিনি সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি হিসেবে শপথ গ্রহন করেন এবং ১৯৮৩ সারের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ঐ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। একজন ন্যায়পরায়ণ, নির্ভীক এবং তীক্ষè বুদ্ধিসম্পন্ন বিচারপতি হিসেবে তিনি বহু স্মরণীয় রায় প্রদান করেন।

বিচারপতি চৗধুরী ১৯৭৭-৭৮ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। তখন বাংলাদেশের প্রথমবারের মত নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য নিবার্চিত হয়। জাপানের মত একটি শক্তিশালী পরাজিত করে নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হওয়ার ক্ষেত্রে বিচারপতি চৌধুরী অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। দেশের আদর্শ সচেতন বুদ্ধিজীবী, কূটনীতিক, সাংবাদিক, সাহিত্যিকসহ বিভিন্ন পেশাজীবীদের নিয়ে তিনি ‘লিবার্টি ফোরাম’ প্রতিষ্ঠা করেন এবং প্রথম চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এই ফোরাম সামরিক শাসক থেকে গণতন্ত্রে উরত্তণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। বিচারপতি চৌধুরী ইনস্টিটিউট অফ হিউম্যান রাইটস এ্যান্ড লিগ্যাল এ্যাফেয়ার্সের প্রতিষ্ঠানের ইন্টারন্যাশনাল কমিশন অফ জুরিস্টের সাথে সংযুক্ত ছিলেন। তিনি বাংলাদেশ বসনিয়া সলিডারিটি ফ্রন্টের প্রথম চেয়ারম্যান হিসেবে নির্বাচিত হন। তিনি আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলামের প্রেসিডেন্ট ও বাংলা একাডেমীর চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি, জাতীয় যক্ষা সমিতি (নাটাব)-এর আজীবন সদস্য ছিলেন। তিনি ১৯৯৩ সালে ফ্রান্সের প্যারিসে অবস্থিত ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব অরবিট্রেশনে আরবিট্রেটর হিসেবে নিযুক্ত হন এবং মৃত্যুকাল পর্যন্ত ঐ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন।

বিচারপতি চৌধুরী ১৯৯৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘কামিনী কুমার দত্ত স্মারক বক্তৃতা’ প্রদান করেন। আইন ও আইনের শাসন, গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও সমাজবিজ্ঞানের উপর তিনি অনেক প্রবন্ধ লিখেছেন। তাঁর লেখা বই ‘ডেমোক্রাসি, হিউম্যান রাইটস এ্যান্ড রুল অফ ল’ ১৯৯৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশ করে। ভাষা আন্দোলনের অসামান্য অবদানের জন্য বিচারপতি চৌধুরীকে ‘প্রিন্সিপাল আবুল কাসেম স্বর্ণপদক’ প্রদান করা হয়। আইন, গণতন্ত্র, মানবাধিকার প্রভৃতি বিষয়ের উপর বিচারপতি চৌধুরী এশিয়া, ইউরোপ, আমেরিকা, আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে বহু সম্মেলনে অংশগ্রহণ ও সভাপতিত্ব করেছেন।


মৃত্যু

বিচারপতি আবদুর রহমান চৌধুরী ১৯৯৪ সালের ১১ জানুয়ারি ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ৬৭ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।



তথ্যসূত্র: রুসেলি রহমান চৌধুরী। বরিশালের প্রয়াত গুণীজন। ইউনিভার্সিটি বুক পাবলিশার্স: ঢাকা। ২০০৬।