অমরেন্দ্র ঘোষ

Barisalpedia থেকে

পূর্ব বাংলার বিখ্যাত ঔপন্যাসিক অমরেন্দ্র ঘোষের পূর্ণ নাম শ্রী অমরেন্দ্রনাথ ঘোষ। পূর্বপুরুষের পদবী ছিল ঘোষ রায়। তার আগে পূর্বপুরুষরাই এই রায় ফেলে দিয়ে শুধু ঘোষ লিখতে শুরু করেন। ১৯৫০ সালের পরে কোনো এক সময় তিনি তার নিজের নামের ‘শ্রী’ ও ‘নাথ’টুকু ছেঁটে দিয়ে অমরেন্দ্র ঘোষ নামে আত্মপ্রকাশ করেন। তাঁর জন্মতারিখ ৫ ফেব্রুয়ারি, মঙ্গলবার, ১৯০৭।

পূর্বপুরুষ ও পরিবার পরিচয়

পিতৃসূত্রে তাঁদের বাড়ি তৎকালীন বরিশাল জেলাধীন রাজাপুর থানার শুক্তাগড় গ্রামে। ড. হাজরা উল্লেখ করেছেন চার-পাঁচ পুরুষ পূর্বে তার পূর্বপুরুষের একজন তাদের আদি বাড়ি বর্তমান বানারীপাড়া থানার নরোত্তমপুর ছেড়ে রাজাপুর থানার শুক্তাগড় গ্রামে তালুক কিনে বসবাস শুরু করেন। ড. হাজরা আরো উল্লেখ করেছেন যে অমরেন্দ্রের জন্ম হয়েছিলো বর্তমান পিরোজপুর জেলার মঠবাড়িয়া থানায়। এ তথ্যের উৎস জানতে চাইলে তিনি বলেন তার মনে হচ্ছে তিনি এ তথ্য অমরেন্দ্র ঘোষের স্ত্রীর কাছ থেকে শুনেছেন। এ কথা সত্য যে, বাগেরহাট জেলার বর্তমান রামপাল থানায় মল্লিকের বেড় গ্রামে তাদের জমি ছিল, ক্ষেত ছিল, যাকে তারা পারিবারিকভাবে দক্ষিণের বিল বলতো। এই দক্ষিণের বিলকে কেন্দ্র করেই তার তিন পর্বের উপন্যাস ‘দক্ষিণের বিল’। কিন্তু মঠবাড়িয়ায় তাদের জমি ও বাড়ি থাকা কিংবা সেখানে অমরেন্দ্রর জন্ম হওয়া বিষয়ে স্মৃতিকথা ‘জবানবন্দী’ থেকে কোনো তথ্য জানা যায় না। স্মৃতিকথায় প্রদত্ত বিভিন্ন তথ্যনিরিখে বরং অনুমিত হয় তাঁর জন্মস্থান মেঘালয়ের রাজধানী শিলংয়ের কাছাকাছি কোনো থানা শহরে যেখানে তাঁর পিতা জানকীকুমার ঘোষ তখন পুলিশের কনস্টেবল পদে সাড়ে তিন টাকা বেতনে চাকুরি করতেন। ‘জবানবন্দী’র তথ্যমতে অমরেন্দ্রের পিতা জানকীকুমার ঘোষ ছাত্রবৃত্তি ক্লাস পর্যন্ত পড়েছিলেন। মা শিবসুন্দরী কোনোমতে নাম দস্তখত করতে পারতেন। জানকীকুমার ঘোষ ও শিবসুন্দরীর মোট আট ছেলেমেয়ে। তিন পুত্র ও পাঁচ কন্যা। অমরেন্দ্রের আট ভাইবোন যথাক্রমে: শ্রীমতী মৃণালিনী বসু রায়, শ্রীমতী হেমনলিনী গুহঠাকুরতা, শ্রী অমরেন্দ্র ঘোষ, শ্রীমতী কমলিনী বসু নারায়ণ, শ্রী নারায়ণ ঘোষ, শ্রী জনার্দন ঘোষ, শ্রীমতী নীলিমা গুহ রায় ও শ্রীমতী বেলা রাণী বসু নারায়ণ। সবার বড় বোন মৃণালিনী ১৯৪৭ এর পূর্বেই এক মেয়ে নিয়ে বিধবা হন। এই মেয়ে ও তার জামাইকে নিয়ে তিনি কোলকাতা বিধানপল্লীতে একটি মাথা গোঁজার ঠাঁই করেছিলেন। সম্ভবত দ্বিতীয় বোন হেমনলিনীর স্বামীর বাড়ি ছিল বরিশালের নথুল্লাবাদে। তার এক দিদির বাড়ি ছিল নথুল্লাবাদে- এমনটা অমরেন্দ্র ঘোষের স্মৃতিকথায় উল্লেখ আছে। স্মৃতিকথা ‘জবানবন্দী’ ঘেঁটে আরো জানা যায় যে ১৯৫৭ সালের পূর্বেই মৃণালিনীসহ আরো তিন বোন গতায়ু হন। ১৯৫৭ সালে বেঁচে থাকা একমাত্র বোনের নাম ছিল বেলা। বেলার স্বামীর নাম মিনু বাবু (অবশ্যই এটি পূর্ণ নাম নয়)। ‘জবানবন্দী’ লেখার সময় ১৯৫৭ সালে অমরেন্দ্রের অপর দুই ভাই নারায়ণ ও জনার্দন জীবিত ছিলেন এবং কোলকাতায় বাস করছিলেন। তবে নারায়ণ তখন টিবি ও ডায়াবেটিসে ভুগছেন এবং অমরেন্দ্র ভুগছেন ইনসমনিয়া, ডিউডেনাল আলসার, এ্যাজমা, রাইটারস ক্র্যাম্পস ইত্যাকার অনেক কঠিন রোগে। অমরেন্দ্রের স্ত্রীর নাম পঙ্কজিনী ঘোষ। বাড়ি ফরিদপুরের অধীন বর্তমান গোপালগঞ্জের উলপুর। পঙ্কজিনীর পিতার নাম কেদারেশ্বর রায় চৌধুরী এবং মাতার নাম জীবনতোষিনী দেবী। অমরেন্দ্র ঘোষ ও পঙ্কজিনী ঘেষের ছয় সন্তান: হেনা, ছায়া, গীতা, বাসুদেব, রেবা ও অশোক। হেনার স্বামী অনিল, ছায়ার স্বামী সন্তোষ ও গীতার স্বামী গোপাল। ‘জবানবন্দী’ থেকে জানা যায় পঙ্কজিনী ঘোষের এক বোনের নাম হেমলতা দত্ত ও আরেক বোন শৈবালিনী ঘোষ দস্তিদার। শৈবালিনী ঘোষ দস্তিদারের এক ছেলে অমরেশ একজন স্থিতধী ডাক্তার ছিলেন এবং একসময় তিনি অমরেন্দ্র ঘোষের চিকিৎসকও ছিলেন। পঙ্কজিনী ঘোষের এক মামা নগেন্দ্রনাথ ঘোষ দস্তিদার পাটনা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের প্রিন্সিপাল ছিলেন। ‘জবানবন্দী’ থেকে পঙ্কজিনী ঘোষের এক ভাইয়ের নাম জানা যায় রবীন্দ্র রায়চৌধুরী, তবে তিনি পঙ্কজিনী ঘোষের সহোদর কিনা প্রমাণিত নয়।

ছেলেবেলা

‘জবানবন্দী’ থেকে জানা যায় অমরেন্দ্র ঘোষের ছেলেবেলা ১৯১২-১৩ পর্যন্ত কেটেছে বাবার কর্মস্থল শিলংয়ে। এখানে পাহাড়ি স্বচ্ছ পানির সোঁতায় একবার মাছ দেখে ধরার জন্য নেমে পড়েন ছয়-সাত বছরের অমরেন্দ্র এবং মাছের পেছনে দৌড়াতে দৌড়াতে একসময় মাছও হারিয়ে যায় এবং অমরেন্দ্রের ফেরার পথও হারিয়ে যায়। এক পাহাড়ি খাসিয়া এমন পথহারা শিশুটিকে তার থাপায় করে থানায় বাবুর কাছে দিয়ে যায়। আট থেকে দশ-এগার বছর কাল পর্যন্ত কেটেছে আসামের কামাখ্যায়, বাবার পরবর্তী কর্মস্থলে। এরপর বাবার বদলি বগুড়ার ধুনট থানায়। তখন বাবা জানকী কুমার ঘোষ পুলিশের সাব ইনস্পেক্টর। ড. হাজরা অবশ্য লিখেছেন অমরেন্দ্রের পিতা পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া থেকে ধুনটে বদলী হন। কিন্তু ‘জবানবন্দী’ এই তথ্যের পক্ষে সায় দেয় না। বার-তের বছরের অমরেন্দ্র ধুনটে প্রথম ঘোড়ায় চড়তে শিখেন। ঘোড়ায় চড়ে চলে এসেছিলেন এক মুসলমান কলুর বাড়িতে। কলু লোকটির সাথে তার বেশ ভাব হয় এবং এই কলু তাকে মিতা ডাকতো। এক পয়সার বাতাসা এনে খাওয়াতো। এই লোককে ছুঁয়ে পানি খেয়ে প্রথম অমরেন্দ্র তার জাত বিসর্জন দিয়েছিলেন। ধুনট থেকে বাবা জানকীকুমার ঘোষের বদলী রাজশাহীর আদমদীঘিতে। বাবা রাজশাহী আসার শুরুতে অথবা ধুনট থাকাকালীনই অমরেন্দ্রকে মায়ের কোল ছেড়ে কোলকাতায় পাড়ি দিতে হয়। সম্ভবত ১৯১৬ সালে তিনি কোলকাতা কালীঘাট স্কুলে পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি হন। সাহানগর রোডে বোন মৃণালিনীর বাসায় থেকে এই স্কুলে পড়াশুনা করেন। কালীঘাট স্কুলে পড়াকালীন স্বদেশী আন্দোলনে মেতে ওঠা। বছরের শেষে কোনোরকমে হাত পা ধরে প্রমোশন পান। এভাবে ক্লাশ এইট-নাইন পর্যন্ত ওঠা। এই এইট-নাইনের সময়কালেই অমরেন্দ্রের সৃষ্টিসত্তার উদ্ভব। অমরেন্দ্রের নিজের ভাষায়- ‘বয়স তখন অনুমান ষোল সতের।. . তেরশ একত্রিশ কি বত্রিশ।. . কবি এবং কাব্যের আদর্শ রবীন্দ্রনাথ, তাঁর চলন-বলন সাজ-সজ্জারও অক্ষম অনুকরণ চলছে।. . এই সময় তাঁর ‘শিশু’ কবিতার বইখানা আমার হাতে আসে। মনে হয়, এমন কবিতা বুঝি আমিও লিখতে পারি। একলব্যের মত দ্রোণাচার্যকে ধ্যান করতে লাগলাম। বসে গেলাম কাগজ কলম নিয়ে। দেখলাম মহৎ কথা সহজ কথায় লেখা বড় সুকঠিন।. . লিখতে হলে তার ব্যাকরণ জানা চাই।’ (জবানবন্দী ১২০)।

সাহিত্যিক জীবনের সূচনা

কিছুদিন চোখকান বুজে পড়াশোনা করে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাস ১৯২৫ সালে (জবানবন্দী ১৫২)। এটি অবশ্যই অনুমেয় ১৯২৫ সালে ১ম বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করা কত কঠিন একটি বিষয় ছিল। মাত্র কয়েক মাসের পড়াশোনায় এই অর্জন অমরেন্দ্রের অসাধারণ প্রতিভাকে আমাদের সামনে উপস্থাপন করে। ম্যাট্রিকের ফলাফল প্রকাশের পূর্বেই বিয়ের পিড়িতে বসা। বিয়ের তারিখ ১৩৩২ সালের ১২ই বৈশাখ শনিবার (হাজরা ১৯)। অমরেন্দ্র ১৮ আর কনে পঙ্কজিনী ১৩। অমরেন্দ্রর গৌরব সে গল্প কবিতা লেখে, আর পঙ্কজিনীর গৌরব সে এই বয়সেই বঙ্কিম, শরৎ অনেকখানি পড়ে ফেলেছে। ঘর সামলাতে পুত্রবধূ দরকার, তাই জানকী ও শিবসুন্দরীরও আনন্দ। তবে এ আনন্দ বেশিদিন টিকলো না। প্রথমত অমরেন্দ্র গল্প-কবিতার জগতের মানুষ, সে কেন বিজ্ঞান পড়বে। কিন্তু বাবা মায়ের আশা ছেলে ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হবে। সুতরাং বাবা মায়ের ইচ্ছাপূরণে ছেলেকে ভর্তি হতে হলো কোলকাতা সাউথ সুবারবন কলেজে আইএসসিতে। এই মনোযন্ত্রণার মধ্যে আবার জাগলো সেই সৃষ্টিচেতনা যা একবার জেগেছিল স্কুল জীবনে ষোল-সতেরতে। এবার সে চেতনা জাগলো পুরো বাঁধ ভেঙ্গে। ক্লাসমেট নীতুর সাথে একদিন কলেজের পর অচিন্ত্যকুমারের বাড়ি গিয়ে উপস্থিত হলেন। এই অচিন্ত্যই তাকে বিশ্বসাহিত্যের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। প্রথম গল্প ‘কলের নৌকা’ ১৩৩৪ বঙ্গাব্দে কল্লোলে ছাপা হলো। অবশ্য ‘কলের নৌকা’ই অমরেন্দ্রের প্রকাশিত প্রথম লেখা নয়। এর অল্প আগে কবিশেখর কালিদাস রায়ের হাতে সামান্য শুদ্ধির মধ্য দিয়ে তাঁর প্রথম কবিতা ‘শ্মশানে বসন্ত’ মাসিক ‘বঙ্গবাণী’তে ছাপা হয়েছিল ১৩৩৪ এর আষাঢ় সংখ্যায়। (জবানবন্দী ১৫২)। ড. হাজরার গবেষণা তথ্যমতে এর দু মাস পরে ১৩৩৪ ভাদ্র সংখ্যায় ‘বঙ্গবাণী’তে প্রকাশিত হলো কবিতা ‘মরুভূমি’ এবং কল্লোলে ছাপা হলো গল্প ‘কলের নৌকা’। কিছুদিন পরে ১৩৩৪ সালেই ‘মানসী ও মর্মবাণী’ নামে এক পত্রিকায় ‘শ্মশানে বসন্ত’ কবিতার এক রসজ্ঞ আলোচনাও বের হলো। কিছুদিন পরে প্রবাসীতে ‘একটুখানি নুন’ নামে আরো একটি গল্প ছাপা হলো।


কঠিন কর্মজীবনের কষাঘাত

অমরেন্দ্র তাঁর ‘জবানবন্দী’র ১৮৮ পৃষ্ঠায় ১৭/৫/৫৮ তারিখে লিখেছেন ‘প্রায় ত্রিশ বছর আগের গ্রাম-জীবনের কাহিনী সুরু করে এলাম’। এই বাক্য থেকে অনুমিত হয় ১৯২৮ সালে অমরেন্দ্র পারিবারিক প্রয়োজনে আইএসসি পরীক্ষা না দিয়েই কলকাতা ছেড়ে রাজাপুরে এসে উঠেছিলেন। গ্রামে এসে কিছু পাণ্ডুলিপি এবং দু’একখানা বই বান্ডিল করে পঙ্কজিনীর কাছে দিলেন। তিনি কি করলেন তার আর সংবাদ নেয়ার অবকাশ নেই। এযাবৎ লেখক হিসেবে শুধুমাত্র পাঁচটি টাকা পেয়েছিলেন প্রবাসীতে ‘একটুখানি নুন’ গল্পটি লিখে। এবার লেখা নয়, অন্য দায়িত্ব। বাবার চাকরি নেই, অথচ যৌথ পরিবারের দায়িত্ব রয়েছে পাহাড়ের মত কাঁধে চেপে। একটু অদল-বদল হলে ঘাড়, অমনি টের পেয়ে যাবে সাত গাঁয়ের মানুষ- ঘোষ বংশ ছন্নছাড়া হয়ে যাচ্ছে।তাঁর ভাবনার চৌহদ্দিতেও তখন নেই যে তিনি জীবনে আবার লিখবেন এবং এসব নিয়েই লিখবেন। অমরেন্দ্রের তখনকার জীবনের বর্ণনা- ‘কেত্তায় কেত্তায় মামলা- ফৌজদারী আদালত। তার সঙ্গে যোগ হল বকেয়া খাজনার নালিশ। আঘাতে আঘাতে বাবা যেন ক্ষেপে গেলেন। ছিলেন ধর্মভীরু, হয়ে উঠলেন হিংস্র। আয়ের সঙ্গে এখন আর ব্যয়ের সঙ্গতি নেই। অথচ বজায় রাখত হবে মস্ত মান মর্যাদা সামাজিক ক্রিয়াকাণ্ড, দোলদুর্গোৎসব। এতগুলো মুখের জোগাতে হবে দানা- এমন একটি পরিবারের দূর করতে হবে হতাশা। এরই মধ্যে ছুটে বেড়িয়েছেন ঢপ কীর্তনের দলের সঙ্গে। সন্ধ্যার নদীতে শুনেছেন খাঁটি ভাটিয়ালি গান। ফৌজদারী মামলার তারিখ নিয়ে জারী-কবির পালা শুনতে যেতেন। তখন ১৯৪৩ এর দুর্ভিক্ষ আগাচ্ছে। আর অমরেন্দ্রের কাছে আগাচ্ছে একটি প্রশ্ন- এই পূর্ববাঙলার মাটিতে মাথা গুঁজে শেষ পর্যন্ত থাকা যাবে তো? অনেক জিনিস নষ্ট হয়েছে, অনেক বস্তু আত্মসাৎ হয়েছে, শুধু একটি বস্তু সকলের দাঁত বাঁচিয়ে রক্ষা করেছিলেন পঙ্কজিনী, সেটি হল কল্লোল যুগের ছাপা লেখা ও দেওঘরের নন্দবাবুর বোন রানীর হাতের নকল করা কিছু গল্প বা কবিতার পাণ্ডুলিপি। এ ঘটনা ১৯৪৬ এর শেষ দিকের। ১৯২৭-২৮ সালে লেখা ছেড়ে দেয়ার দীর্ঘ সতের-আঠার বছর পরে তিনি আবার লিখতে বসার দুর্নিবার তাগিদ অনুভব করছেন। তার অভিজ্ঞতা এমন কঠিন চিৎকার রূপে তার ভেতরে জমা হয়েছে যে, এ চিৎকার ভিতরে আটকে থাকলে তিনি দম বন্ধ হয়ে মারা যাবেন। তাই তাকে লিখতে হবে, বুকের চিৎকারকে বুক থেকে বের করে কাগজের জমিনে আটকে দিতে হবে। কিন্তু কাগজ কোথায় পাওয়া যাবে? কালি কলম কোথায় পাওয়া যাবে? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়। সমস্তই গেছে কালোকারবারীদের হাতে। ভাল দু’দিস্তা কাগজ তখন শুক্তাগড় থেকে রাজাপুর সর্বত্র দুর্লভ। এমন পরিস্থিতিতে অমরেন্দ্র একটা কলম আনতে ছুটলেন একদিন এক রাত্তিরের পথ দিদির কাছে, ঝালকাঠির নথুল্লাবাদে- নাও ভাড়া করে। মাঝখানে ঝালকাঠি শহরে নেবে একখানা চিঠি ছাড়লেন কলকাতায় বড় শালীর কাছে। দিদি দিলেন একটা আধভাঙ্গা ব্ল্যাকবার্ড কলম, শালী পাঠালেন ছোট ছোট খান কয়েক রাইটং প্যাড। সব গুছিয়ে লিখতে বসা। কিন্তু কি লিখবেন- কবিতা, গল্প না প্রবন্ধ? ঠিক করে উঠতে পারছেন না। মেজো মেয়ের বিয়েতে একখানা বই উপহার পেয়েছিলেন। একবার খুলেও দেখা হয়নি। যে-মন নিয়ে বইখানা কোলকাতা থেকে রাজাপুরে নিয়ে এসেছিলেন, সে-মন শতধা হয়ে গেছে পথে। স্ত্রী বললেন- ‘আমি পড়েছি, তুমি পড়ে দেখো- লেখিকা নোবেল প্রাইজ পেয়েছেন, নাম পার্ল বাক’। স্ত্রীলোকের লেখা হলেও অমরেন্দ্র আগ্রহ নিয়ে পড়লেন ‘গুড আর্থ’। পড়ে মনে হলো- চীন দেশের এই কি প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র? পূর্ববঙ্গের পল্লীজীবনের উপকরণ নিয়ে তো এর চাইতেও ভালো বই লেখা যায়। এই হলো ‘দক্ষিণের বিল’-এর সূত্রপাত।


সাহিত্য সাধনা

শুরু হলো ‘দক্ষিণের বিল’ লেখা। কিন্তু লেখক জানেন না কোথায় থামবেন। বর্ষার ধারা স্রোতের মত আসতে লাগলো তার কাহিনী, এ ঢল সামাল দেয়া দায়। ঊনিশ শ’ সাতচল্লিশের মাঝামাঝি, অমরেন্দ্র বরিশাল টাউনে এসে উঠলেন। বাড়ি-বেচা টাকা চারশ একজনের কাছে একটা প্যাঁচে আটকে গেল। অমরেন্দ্র স্বামী স্ত্রীতে এক পরিবারের নিকট প্রায় দাসত্ব বরণ করলেন। সেই পরিবারের নামটা অবশ্য অমরেন্দ্র কোথাও বলেননি। তবে একটি করুণ বর্ণনা দিয়েছেন- ‘এবার সময়মত জোটেনা ছেলেমেয়ের দানাপানি। স্বাধীনতাহীনতা যে কী জিনিস এই প্রথম টের পেলাম। এটুকু আমার সাহিত্য জীবন নয়, দুর্বিষহ অপমান ও লাঞ্ছনার কাল। সারা দিন রাত এক দোকান সামলানোর কর্মচারী- সকাল পাঁচটা থেকে রাত একটা পর্যন্ত বেচাকেনা। কোনোদিন ছেলেমেয়ে স্ত্রীর সাথে দেখা হয়, কোনোদিন হয় না। এ দোকান আমার হাতেই প্রতিষ্ঠিত, শরিক হয়েও এখন আর তা নই, গ্রহদোষে করুণার পাত্র। ভয় আছে সামান্য ত্রুটিতে জবাবদিহি করার। মাথা নুয়েই খাটছি। কিন্তু রাত জেগে আবার ‘দক্ষিণের বিল’ সেজে ঢেলে লিখছি। এবার টের পেলাম কাহিনীর সাথে ভাষার সঙ্গতি হচ্ছে। টাইট হচ্ছে ঢিলা নাট বলটু স্ক্রু।’ (জবানবন্দী ২১৮) ‘দক্ষিণের বিল’ দ্বিতীয় পর্যায় লেখা সারা হল। অমরেন্দ্রের মনে হলো কি লিখেছেন তা তো বিদগ্ধ কারোর কাছ থেকে সঠিক জানা হল না। এই ভাবনা নিয়ে ব্রজমোহন কলেজের বাঙলার অধ্যাপক সুধাংশু চৌধুরীর কাছে ছুটলেন সাইকেলে চড়ে। অধ্যাপকের কৌতূহল হল। তিনি একা এলেন না। আরো চার পাঁচ জনকে সঙ্গে নিয়ে এলেন। তার মধ্যে একজন যুবক, শামসুদ্দীন আবুল কালাম, যার মধ্যে প্রথম দর্শনেই অমরেন্দ্র নব জাগৃতির বিদ্যুৎ শিখার সন্ধান পেলেন। একজনের নাম কিরণময় রাহা, ইনকাম ট্যাক্স অফিসার, যিনি পরবর্তীতে কোলকাতার জীবনে লেখকের অনেক উপকারে এসেছেন। প্যাকিং বাক্স, পুরাণ কাগজ, নস্যর ভাঙ্গা ফাইল সরিয়ে এই বিদগ্ধ শ্রোতাদেরকে দোকানের একটা গুদাম খোপে বসতে দিলেন। একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে পাণ্ডুলিপি খুলে পড়তে বসলেন। প্রায় তিন ফর্মা পড়ে গেলেন একটানা। এঁরা কেউ ওঠার নাম করলেন না, সকলের কৌতূহল যেন বিস্ময়ে পরিণত হয়েছে। শামসুদ্দিন বললেন, বাঙলা সাহিত্যে এ লেখার স্বীকৃতি অনিবার্য। শ্রীযুক্ত রাহা বললেন, আপনি তারাশঙ্করকে চেনেন? অমরেন্দ্র বললেন, না। মানিককে চেনেন? অমরেন্দ্র বললেন, না। আরো কদিন এঁরা এলেন। পরিচয় আরো একটু নিবিড় হল। অধ্যাপক চৌধুরী অমরেন্দ্রের হয়ে সিগনেট প্রেসের মালিক আধুনিক প্রকাশনা শিল্পের পথিকৃৎ দিলীপ গুপ্তের কাছে চিঠি লিখবেন বললেন। এঁরা যেন দায়িত্ব নিতে চাইলেন অমরেন্দ্রের অদৃষ্ট গড়ার। একদিন শামসুদ্দিন আবুল কালামকে একান্তে ডেকে অমরেন্দ্র গোটা পা-ুলিপিটা হাতে দিয়ে অনুরোধ জানালেন, ‘ভাই একটু পড়ে দেখো, এই সাম্প্রদায়িক ঘনঘটায় আমি কিছু ভুল করেছি কিনা’। যত্ন করে শামসুদ্দিন পড়ে ফেরত দিলেন পাণ্ডুলিপি। বললেন, ‘আপনার রাজনৈতিক চেতনা সহজ সরল প্রগতিশীল। কোনো ত্রুটি পেলাম না আমি।’ কোলকাতা থেকে চিঠি এলো দিলীপ গুপ্ত নাকি এখানে নেই। আপাতত অমরেন্দ্রের সাহিত্যজীবন নতুন কোনো চেহারা নিলো না। ক্রমে পার্টিশানের চাপ অনিবার্য হয়ে এলো। সাহিত্য গেল তলিয়ে। এমন সময় একদিন অমরেন্দ্রের সাথে দেখা হলো সুবারবন কলেজের সেই ১৯২৭ সালের প্রাক্তন বন্ধু ক্যাপ্টেন হ্যারি অর্থাৎ মাস্টার ব্যানার্জির সঙ্গে। এই হ্যারির সঙ্গেই শেষ পর্যন্ত একদিন অমরেন্দ্র তার অনেক ভালবাসার দেশ পূর্ববাংলা ছাড়লেন। সুমুখে সাহিত্যের কোনো স্বপ্ন নেই।


কোলকাতার কঠিন জীবন ও সাহিত্যসাধনা

দেশ ছাড়ার পূর্বে অমরেন্দ্রর প্যাঁচেপড়া বাড়িবেচা টাকা কিছু উদ্ধার হয়েছিল। দেশ ছেড়ে কোলকাতার উদ্বাস্তু জীবনে তিন সন্তান ও স্ত্রীসহ পাঁচজনের পরিবার নিয়ে প্রথম দিন-পনর এক আত্মীয়ের রান্না ঘরে কাটালেন। কিন্তু লেখা বন্ধ করেননি ‘দক্ষিণের বিল’। ধুয়ে ধুয়ে খাচ্ছেন হাতের জমা টাকা কটি। স্ত্রীর তাড়ায় ঠিক পনর দিন বাদেই ৩৮ প্রিন্স বক্তিয়ার শা রোডে একটি কোঠায় এসে উঠলেন। ছোট্ট একটি পায়রার খোপ। কল পায়খানা থাকলেও রান্নাঘর নেই। এরই মধ্যে লেখককে হাত দেড়েক চওড়া জায়গায় বসিয়ে দিয়ে স্ত্রী বললেন, ‘তুমি লেখো’। স্ত্রী দেখেন, তার হাতে আর অবশিষ্ট জমা আছে মাত্র পঞ্চাশটি টাকা। একবোরে বেকার বসে আছেন। ‘দক্ষিণের বিল’ লেখা শেষ হয়ে গেছে তিনবারের মত। একদিন সংবাদ পেলেন শামসুদ্দীন আবুল কালাম এসেছেন কোলকাতা। লেখক দেখা করলেন। সব শুনে জিজ্ঞাসা করলেন- ‘দক্ষিণের বিল’ কোথায়? চলুন দিলীপ গুপ্তের কাছে নিয়ে যাব’। কথামত কাজ। কিন্তু দিলীপ গুপ্ত এখানে নেই। চললেন ‘বসুমতী’ মাসিক পত্রিকার অফিসে। ধারাবাহিক ছাপা হলে কিছু টাকা পওয়া যাবে। মাসিক ‘বসুমতী’র সম্পাদক প্রাণতোষ ঘটকের সঙ্গে অমরেন্দ্রর এই প্রথম সাক্ষাৎ। প্রাণতোষ কথা বলছিলেন শামসুদ্দীনের সাথে- ‘লেখা আমাদের পছন্দ হলে ছাপব বই কী! মাসখানেক তো সময় দিতে হবে’। হঠাৎ মাঝখান থেকে অমরেন্দ্র বললেন, ‘অত দেরি করা আমার পক্ষে অসম্ভব’। প্রাণতোষ আড়াইশ টাকার ব্যবস্থা করে দিলেন। এমাসে দেড়শ, পরের মাসে একশ। অমরেন্দ্র আবার লিখতে বসলেন। দুমাসে ‘পদ্মদীঘির বেদেনী’ রচনা সারা হল। দুমাস পরে আবার অভাব। আবার শামসুদ্দীনের সাথে দেখা। এবার ‘পদ্মদীঘির বেদেনী’কে নিয়ে ছোটাছুটি। শামসুদ্দীন এবার ‘অগ্রণী’ মাসিকে ব্যবস্থা করে দিলেন ‘পদ্মদীঘির বেদেনী’। প্রতি মাসে পনর টাকা করে পাওয়া যাবে। ঘর ভাড়াটা অন্তত কুলিয়ে যাবে। ‘পদ্মদীঘির বেদেনী’র পরের প্রয়াস ‘মন্থন’ উপন্যাসের জন্য। সাতচল্লিশের শেষ কিংবা আটচল্লিশের শুরুর দিকে একদিন ‘মন্থন’ উপন্যাসখানা নিয়ে ঘুরছেন অমরেন্দ্র। ভাবছেন, দশ টাকায়ও বিক্রি করে যদি রেশনটা আনা যায়! অনেক সাহস করে একা একাই গেলেন দিলীপকুমার গুপ্তের কাছে। দিলীপ বললেন, ‘মন্থন’ আমরা ছাপলে বাইশ ইম্প্রেশন দেব- দাম হবে আনুমানিক তিন টাকা পার কপি- আপিন পাবেন ন’শো- এডিশন হলে আবার ন’শো। অমরেন্দ্রের কাছে মনে হলো- এ তো টাকা নয়, টাকার পাহাড়। শ্রীগুপ্ত এক রাত্তিরে পা-ুলিপিখানা পড়ে শেষ করলেন। পরের দিন অমরেন্দ্র উপস্থিত। শ্রীগুপ্তের প্রশ্ন- আপাতত কত টাকা চাই? অমরেন্দ্রের যথারীতি উত্তর- ‘দু’শ- দু’মাস বাদে আবার একখানা উপন্যাস নিয়ে আসব।’ দিলীপ গুপ্তের বৈঠকখানায় বসেই দুমাস পরের সে উপন্যাস ‘চরকাশেম’-এর বহিরেখা নির্দিষ্ট হলো। দুমাসও লাগলো না ‘চরকাশেম’ লিখতে। কিন্তু এবার আর কিছুতেই সময় করে উঠতে পারেন না শ্রীগুপ্ত। পরে দেখা গেল শ্রীগুপ্ত ‘মন্থন’ও ছাপতে পারছেন না। সমস্ত পরিবারকে উপোসের মুখে রেখে, রক্ত বমি করতে করতে অমরেন্দ্র ধ্যানস্থ হলেন এবং শুরু করলেন ‘ভাঙছে শুধু ভাঙছে’। ‘পদ্মদীঘির বেদেনী’ প্রকাশের চুক্তি করে বেঙ্গল পাবলিসার ৫০টি টাকা অগ্রিম দিল। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের মাধ্যমেই পরবর্তীতে ‘চরকাশেম’ প্রকাশিত হলো বুকওয়ার্ল্ড থেকে। ‘পদ্মদীঘির বেদেনী’ ও ‘চরকাশেম’ একই তারিখে প্রকাশিত হল জমজ ভাইবোনের মত। বিনয় ঘোষ যোগাযোগ করিয়ে দিলেন কমলা বুক ডিপোর সঙ্গে। কমলা বুক ডিপো ‘ভাঙছে শুধু ভাঙছে’ ও ‘বেআইনি জনতা’ প্রকাশের দায়িত্ব নিল। মাসিক একশ করে দেড় হাজার টাকা দিয়ে গেলেন। ‘চরকাশেম’ ও ‘পদ্মদীঘির বেদেনী’ প্রকাশের ছমাস পর একটা লাল সালুতে মীরা কেমিকেলসের গেটে লেখা হলো ‘অমরেন্দ্র ঘোষ সংবর্ধনা’। একুশে শ্রাবণ ১৩৫৭ (১৯৫১?) অমরেন্দ্র ঘোষের সংবর্ধনা সভা। সভাপতি শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রধান অতিথি মনোজ বসু। ১৯৫০ সালে সজনীকান্ত দাস, বাণী রায়, দেবপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, সাগরময় ঘোষ প্রমুখ গুণী ব্যক্তিবর্র্গ যৌথভাবে পার্লামেন্টারি সেক্রেটারি নিশাপাতি মাঝির নিকট সুপারিশ করেন অমরেন্দ্রের একটি চাকুরির জন্য। ফলশ্রুতিতে অমরেন্দ্র ১৯৫০ সালে গভর্নমেন্ট রেশন স্টোরের ম্যানেজার পদে চাকরি লাভ করেন। রেশন স্টোরের ফার্স্ট গ্রেড আদিত্য চক্রবর্তীর ওপর স্টোরের ভার দিয়ে তিনি লিখে চলেন উপন্যাস ‘কনকপুরের কবি’। নায়িকা জয়ন্তীরাণী। কবি বিমলচন্দ্র ঘোষের একটি বিখ্যাত কবিতার নির্যাস রয়েছে এ উপন্যাসের আদিগন্ত জোড়া।

১৯৫৩ সালে অসুস্থতার কারণে অমরেন্দ্র রেশন স্টোরের ম্যানেজারের চাকুরি থেকে বিদায় নিতে বাধ্য হন। ১৯৫৪ সাল থেকেই অমরেন্দ্র মরণাপন্ন রকমের অসুস্থ। ১৯৫৪ই বা বলি কেন, অমরেন্দ্র অসুস্থ তো আরো অনেক কাল আগে থেকেই। ১৯৫০ সালে অমরেন্দ্রের করুণ দারিদ্র্যের দিনে ডা. সন্তোষ পাল চিকিৎসা চালিয়েছেন বাকিতে। ৭/২ ডব্লিউ জামির লেনের ডা. প্রফুল্ল কুমার চৌধুরী একইভাবে চিকিৎসা দিয়েছেন, টাকাপয়সা নেননি। ১৯৫৬-৫৭ সালে যখন তিনি ভয়াবহ রকম অসুস্থ, তখন এগিয়ে আসলেন কোলকাতা ট্রপিকাল স্কুল অব মেডিসিনের ডিরেক্টর ডা. আর. এন. চৌধুরী। সাথে আসলেন অনেক সুশীলজন- অধ্যাপক দিলীপ গুপ্ত, মাকালপুরের ভবানী সিংহ, রানাঘাটের অরবিন্দ ঘোষ, রমেশ চন্দ্র, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, বুদ্ধদেব বসু, মুজাফফর আহমদসহ আরো অনেকে। চিকিৎসার জন্য খোলা হলো ‘অমরেন্দ্র ঘোষ তহবিল’। আশীর্বাদ এমন বহুল পথে যত বহুই হোক তা দ্বারা আশীর্বাদিত অমরেন্দ্রের যন্ত্রণার বহুত্ব বিমোচন সম্ভব হয় না। কীর্তিতে অমর হলেও কায়ায় মরণশীল অমরেন্দ্র দিন দিন আগাতে থাকেন গন্তব্য মরণধামের দিকে। শেষ পর্যন্ত ১৯৬২ সালের ১৪ জানুয়ারি ‘ভাঙছে শুধু ভাঙছে’র লেখক অমরেন্দ্র বাঁচার তীব্র লড়াইয়ের রণে ভঙ্গ দিয়ে ভেঙ্গে পড়লেন মৃত্যুর কোলে।

গ্রন্থপরিচিতি

উপন্যাস

১. চরকাশেম (বুকওয়ার্ল্ড, ৫ হেস্টিংস স্ট্রিট, কোলকাতা, আশ্বিন ১৩৫৬) ‘চরকাশেম’-এর বহিরেখা নির্দিষ্ট হয় সিগনেট প্রেসের মালিক দিলীপ গুপ্তের সম্মুখে যেদিন শ্রীগুপ্ত ‘মন্থন’ উপন্যাসখানা ছাপার জন্য কবুল করেন এবং অমরেন্দ্রকে সে-বাবদ দু’শ টাকা অগ্রিম দেন। অমরেন্দ্র বললেন, শ্রীগুপ্ত একান্ত হয়ে শুনলেন। ভূমিহীন একদল হিন্দুমুসলমান জেলেকৃষাণের অভিযান। রূপক কিন্তু ইতিহাস আশ্রয়ী। এ অন্ধকারের ইতিবৃত্ত নয়, জীবন্ত বলিষ্ঠ মানুষের সংগ্রামের কাহিনি। ওরা যুগযুগ ধরে বাঁচতে চায়, কিন্তু সে বাঁচার সংগ্রামে এ্যাটম বমের মত অন্তরায় সৃষ্টি করে দুর্ভিক্ষ। ওরা প্রতিবাদ করে বাঁচে। ছিয়াত্তর, তেরশ পঞ্চাশের মন্বন্তর নির্মূল করতে পারে না ওদের প্রাণকামনাকে। এই হলো ‘চরকাশেম’-এর বক্তব্যের সারাৎসার। ১৯৪৯ সালে এটি লিখিত হয় (দীপংকর ঘোষ ৮)। সরোজ দত্ত ‘পরিচয়’তে লিখেছিলেন ‘চরকাশেম’ পড়ে কোথায় যেন পুরো জনতা দাঙ্গা বিরোধী মনোভাবে জাগ্রত হয়েছিল। ‘চরকাশেম’ ও ‘পদ্মদীঘির বেদেনী’ প্রকাশিত হওয়ার পরে সাহিত্যাঙ্গনে লেখক অমরেন্দ্রের যে মূল্যায়ন বহুমুখে উচ্চারিত হয় তার ভিত্তিতে বিজয় ব্যানার্জী এনসাইক্লোপিডিয়া অব ইনফরমেশন গন্থে ‘লিটারেচার ইন ১৯৫০’ এনিট্রতে নিচের কথাগুলো লেখেন: : But most powerful and objective type of fiction, and yet romantic, produced in the recent time in Bengali are those of Amarendra Ghosh. His outstanding works are ‘Charkashem’ and Padmadighir Bedidni’. His ‘Dakshiner Bil’ which is being published in Basumati has the qualities of an epic and yet different in treatment compared with the other two books.

২. পদ্মদীঘির বেদেনী (বেঙ্গল পাবলিশার্স, ১৪ বঙ্কিম চাটুজ্যে স্ট্রীট, কোলকাতা, আশ্বিন ১৩৫৬) ১৯৪৮ সালে ‘পদ্মদীঘির বেদেনী’ কেবলমাত্র একটি অধ্যায় মাসিক ‘অগ্রণী’তে প্রকাশিত হলে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় অমরেন্দ্রকে বুকে জড়িয়ে ধরে স্বাগতম জানিয়েছিলেন বাংলা সাহিত্যে। বলেছিলেন ‘আপনার ‘পদ্মদীঘির বেদেনী’ পড়ে আশ্চর্য হলাম’।

৩. দক্ষিণের বিল (১ম খণ্ড: গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় এ্যন্ড সন্স, ২০৩/১/১ কর্ণওয়লিস স্ট্রীট, কোলকাতা, ১৩৫৭; ২য় খণ্ড: গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় এ্যন্ড সন্স, আশ্বিন ১৩৬০; ৩য় খণ্ড: অপ্রকাশিত) ‘দক্ষিণের বিল’ অমরেন্দ্রের লিখিত প্রথম উপন্যাস, তবে বই আকারে প্রকাশিত প্রথম উপন্যাস নয়। এ উপন্যাস কৃষক অমরেন্দ্রের প্রজন্ম পরম্পরার ইতিহাস এবং একই সাথে বাংলা সাহিত্যে দক্ষিণ বাংলার কাদা মাটি জলের মাটির-মানুষগুলোর প্রথম উপন্যাসীকৃত রূপ। ১৯৫১ সালে এই গ্রন্থ ছাপানোর জন্য গেলে স্বনামধন্য প্রকাশক বলেছিলেন- ‘এত মোটা এক নামে কি একখানা কেউ বই লেখে, যার আছে ন্যূনতম কমার্শিয়াল কা-জ্ঞান!’ (জবানবন্দী ৭)। ৪. ভাঙছে শুধু ভাঙছে (কমলা বুক ডিপো, ১৫ বঙ্কিম চাটুজ্যে স্ট্রিট, কোলকাতা, জ্যৈণ্ঠ ১৩৫৮) পূর্ববাংলার ভাঙনের উপকরণে তৈরী উপন্যাস ‘ভাঙছে শুধু ভাঙছে’। ৫. একটি সঙ্গীতের জন্ম কাহিনী (ডি.এম. লাইব্রেরি, ৪২ কর্ণওয়ালিস স্ট্রিট, কোলকাতা, ১৯৫১) ৬. বেআইনি জনতা (কমলা বুক ডিপো, ১৫ বঙ্কিম চাটুজ্যে স্ট্রিট, কোলকাতা, ১৩৫৮) ৭. কনকপুরের কবি (ডি.এম. লাইব্রেরি, ৪২ কর্ণওয়ালিস স্ট্রিট, কোলকাতা, ১৩৬০) ৮. জোটের মহল (ডি.এম. লাইব্রেরি, ৪২ কর্ণওয়ালিস স্ট্রিট, কোলকাতা, ১৩৬১) ‘জোটের মহল’এর নায়ক দিবাকর এক বিপ্লবী বিদ্রোহী নেতা। জোটের মহল এর বিদ্রোহিনী মুক্তা লেখকের দেখা একটি বলিষ্ঠ নারী চরিত্রের রূপ। ৯. মন্থন (নবভারতী, ৫ শ্যামাচরণ দে স্ট্রিট, কোলকাতা, ১৯৫৪) ‘পদ্মদীঘির বেদেনী’র পরে লেখকের প্রয়াস মন্থন উপন্যাস। ১০. অহল্যাকন্যা (এস ব্যানার্জি এ্যান্ড কোং, ৬ রমানাথ মজুমদার স্ট্রিট, কোলকাতা, ১৩৬২) ১১. কলেজ স্ট্রীটে অশ্রু (শ্রীগুরু লাইব্রেরি, ২০৪ কর্ণওয়ালিস স্ট্রিট, কোলকাতা, ১৩৬৪) ১২. ঠিকানা বদল (বাকসাহিত্য, ৩৩ কলেজ রো কোলকাতা, ১৩৬৪) ১৩. রোদন ভরা এ বসন্ত (ক্যালকাটা বুক ক্লাব, কোলকাতা, ১৯৫৮) নাটক ‘এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জ’ মঞ্চায়িত হচ্ছে না দেখে লেখক নাটকটিকে রূপান্তর করলেন ‘রোদন ভরা এ বসন্ত’ উপন্যাসে। ১৪. নাগিনীমুদ্রা (বিদ্যোদয় লাইব্রেরি, ৭২ মহাত্মা গান্ধী রোড, ১৩৬৬) ১৫. মন দেয়া নেয়া (সাহিত্য, ৯ শ্যামাচরণ দে স্ট্রিট, ১৩৬৮ ) ১৬. মৃগসৌরভ (সারস্বত লাইব্রেরি, ২০৬ বিধান সরণি, কোলকাতা, ১৩৯৭) ১৭. একটি স্মরণীয় রাত্রি (দে’জ পাবলিশিং, ১৩ বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রিট, কোলকাতা, ১৯৯১) [ড. হাজরা অবশ্য উল্লেখ করেছেন এ উপন্যাসের প্রকাশক ‘বাকসাহিত্য’ এবং প্রকাশকাল ১৯৯৬, তথ্যটি সম্ভবত সঠিক নয়] ‘জবানবন্দী’ থেকে জানা যায় এ উপন্যাসটি ১৯৫৫ সালে লেখা। এই উপন্যাস লেখার সময় প্রতি রাতে সত্যেন সরকার ইনসমনিয়ার রোগী অমরেন্দ্রকে সামলাতে আসতেন। এ উপন্যাসের নায়ক অনেকটাই সত্যেন সরকার।

দে’জ পাবলিশিং কর্তৃক প্রকাশিত ‘একটি স্মরণীয় রাত্রি’ উপন্যাসের ইনার অংশে অমরেন্দ্রের বইয়ের তালিকায় নিম্নলিখিত ১৮ থেকে ২৩ নম্বরভুক্ত গ্রন্থগুলোর নাম রয়েছে। আমরা নিশ্চিত নই এগুলো কোন্ ধর্মী গ্রন্থ- উপন্যাস নাকি অন্য কিছু । এগুলো কখনো গ্রন্থ আকারে প্রকাশিত হয়েছিল কিনা তাও আমরা জানি না। ১৮. জি-হুজৌর ১৯. এপার ওপার ২০. অনাস্বাদিত চুম্বন ২১. অথচ সিঁড়িটা একদিন এমন ছিল না ২২. ধূসর রাগিনী ২৩. সমুদ্র পোত ২৪. ব্যাঙ্গাচি শুধু ব্যাঙ্গাচি (বাকেরগঞ্জ গেজেটিয়ারে এই নামে অমরেন্দ্রের একটি বই আছে বলে উল্লেখিত হয়েছে। আমরা অবশ্য অন্য কোথাও এই নামে অমরেন্দ্রের কোনো বইয়ের উল্লেখ দেখিনি।) দীপংকর ঘোষ তার ‘উপেক্ষিত অমরেন্দ্র ঘোষ, অবহেলিত চরকাশেম’ শীর্ষক প্রবন্ধে নিচে ২৫ ও ২৬ নম্বরে লিখিত নামদুটোকে অমরেন্দ্রের গ্রন্থ বলে উল্লেখ করেছেন। আমরা এ দুটোরও কোনো সন্ধান পাইনি।

২৫. রাজভোগ ২৬. বলেছিলেম এসো


নাটক

২৭. এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জ এটি লেখকের একটি সিরিও কমিক লেখার প্রয়াস। সম্ভবত কখনো গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়নি। পা-ুলিপিরও কোনো সন্ধান আমরা পাইনি। ২৮. ফসল এটি অমরেন্দ্রের একমাত্র গীতিনাট্য। সম্ভবত এটিও কখনো গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়নি। পা-ুলিপিরও কোনো সন্ধান আমরা পাইনি।


গল্পগ্রন্থ

২৯. কুসুমের স্মৃতি (সাহিত্য প্রকাশ, ৫ শ্যামাচরণ দে স্ট্রিট, কোলকাতা, ১৯৫০) এ গ্রন্থের গল্পগুলো হলো: ১. কুসুমের স্মৃতি; ২. বাঁদী; ৩. সারোঙ্গীর সুর; ৪. ভেজাল; ৫. একটুখানি নুন; ৬. ফেরারী; ৭. কসাই; ৮. বনলতা সোম; ৯. সূর্যমুখীর মৃত্যু; ১০. একটি স্মরণীয় রাত্রি; ও ১১. কল্যাণ স্বাক্ষর। ৩০. স্ব-নির্বাচিত গল্প (প্রকাশক: শ্রী গদাই চাঁদ দে, ১৭ ডি শম্ভুবাবু লেন, কোলকাতা, ১৯৫৬) ড. হাজরার প্রদত্ত তথ্যমতে এটি ছোটদের জন্য লিখিত একটি গল্পগ্রন্থ। এ গ্রন্থের গল্পগুলো হলো: ১. পোড়ো বাড়ির ছেলে; ২. জন্মদিন; ৩. মা; ৪. কালশত্রু; ৫. মেনকা মালিনী; ৬. দাঙ্গা; ও ৮. জবাব। ৩১. অমরেন্দ্র ঘোষের সেরা গল্প (দে’জ পাবলিশিং কর্তৃক প্রকাশিত ‘একটি স্মরণীয় রাত্রি’ উপন্যাসের ইনার অংশে অমরেন্দ্রের বইয়ের তালিকায় এই গ্রন্থটির নাম রয়েছে। আমরা গ্রন্থটির কোনো হদিস কোথাও পাইনি। অমরেন্দ্রের অগ্রন্থিত গল্পসমূহ: ১. পথিক বন্ধু; ২. কুলায় প্রত্যাশী; ৩. শুভার্থী; ৪. স্ফুলিঙ্গ; ৫. পুনর্বাসন; ৬. অপরিচিত; ৭. ইন্ধন; ৮. এ নাকি অনিবার্য এবং অনস্বীকার্য; ৯. আহ্বান; ১০. শহরতলীর আশেপাশে; ১১. দহন; ১২. ডালিয়া; ১৩. স্বপ্নবাস্তব; ১৪. প্রেমের কবিতা; ১৫. মুখোমুখি; ১৬. স্বরভঙ্গ; ১৭. চলনদার; ১৮. অসমাপ্ত চুম্বন (দীপংকর ঘোষ এটিকে বইয়ের নাম হিসেবে উল্লেখ করেছেন); ১৯. মৃগমদ; ২০. বাণী দিন বাণী দিন; ২১. ঠিকানা; ২২. আত্মসাৎ; ২৩. সাহিত্য পাড়া; ২৪. গড়িয়ে দিলাম; ও ২৫. ডিউটি। উল্লেখ্য এ তালিকা ড. হাজরার বইয়ের ভিত্তিতে প্রণীত। ড. হাজরা অমরেন্দ্রের স্ত্রী পঙ্কজিনী ঘোষের বরাত দিয়ে বলেছেন অমরেন্দ্রের গল্পসংখ্যা ১২৯। আমরা দেখছি তার মধ্যে বইয়ে প্রকাশিত মাত্র ১৯টি। আর সব মিলিয়ে ৪৪টি গল্পের নাম আমরা ড. হাজরার মাধ্যমে খুঁজে পেয়েিেছ। বাকিগুলো সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না।


শিশুগ্রন্থ

৩২. চারি আনার পারিজাত (এ গ্রন্থটির নামও দীপংকর ঘোষের ‘উপেক্ষিত অমরেন্দ্র ঘোষ, অবহেলিত চরকাশেম’ শীর্ষক প্রবন্ধে পাওয়া যায়। আমরা এটিরও কোনো সন্ধান কোথাও পাইনি। স্মৃতিকথা ৩৩. জবানবন্দী (শ্রীগুরু লাইব্রেরি, ২০৪ কর্ণওয়ালিস স্ট্রিট, কোলকাতা, ১৩৭০)

ওপরে অমরেন্দ্রের ৩৩খানা গ্রন্থের যে তালিকা প্রদান করা হলো এ তালিকায় ভুলভ্রান্তি থাকার যথেষ্ট আশঙ্কা রয়েছে। এগুলোর দুয়েকটি এমনও থাকতে পারে যা আদপে কোনো বইয়ের নামই নয়, কিংবা হয়তো কোনো ছোটগল্পের নাম। অমরেন্দ্রের সাহিত্যকর্ম সম্পর্কে আজকেই তথ্যের এই দুষ্প্রাপ্যতা আমাদেরকে তাঁর উত্তরসূরী হিসেবে এতটাই অযোগ্য বলে প্রমাণ করে যে আমাদের লজ্জিত হওয়া ছাড়া উপায় থাকে না।


তথ্যসূত্র: মুহম্মদ মুহসিন [সম্পা.]। ধানসিড়ি। সংখ্যা: ৬। প্রকাশক: ধানসিড়ি সাহিত্য সৈকত, রাজাপুর, ঝালকাঠি। ২০১৪