গগন মিয়া
বাকেরগঞ্জ জেলার মঠবাড়িয়া ও ভান্ডারিয়া নিয়ে গঠিত সৈয়দপুর পরগণার এক তালুকদার গগন মিয়া ও তার ভাই মোহন মিয়া জমিদার বিরোধী আন্দোলনে কৃষকদের নেতৃত্ব দিয়ে ইংরেজ শক্তির সম্মুখে ত্রাস রূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন।
পরিচ্ছেদসমূহ
পরিচয়
সৈয়দপুর পরগণার দশ আনার মালিক ছিল ঢাকার মিত্রজিত সিং এবং দু’আনার মালিক ছিল বিরজা রতন দাস। ফরিদপুর জেলার গেরদা নিবাসী শেখ দৌলত মিত্রজিতদের অধীনে তালুক লাভ করে ভান্ডারিয়ার সিংখালী গ্রামে জঙ্গল আবাদ করে বসতি স্থাপন করেন। শেখ দৌলতের পুত্র শেখ গগন মিয়া ও মোহন মিয়া। খালের পশ্চিম পাড়ে গগন ও পূর্ব পাড়ে মোহন ১৭ হাত পরিখা খনন করে ৪০ একর ভূমির ওপর বসতবাড়ী নির্মাণ করেছিলেন।
জমিদারের সাথে বিরোধের সূত্রপাত
গগন ও মোহন অনেক কৃষক পরিবারকে নিয়ে সুন্দরবন আবাদ করেন। কিন্তু মিত্রজিত গগন, মোহন ও কৃষকদের নামে ভূমি কবলিয়াত দিতে অস্বীকার করলেন। তখন গগন ও মোহনের নির্দেশে কৃষকরা মিত্রজিতদের খাজনা দেয়া বন্ধ করে দেয়। মিত্রজিত তখন তার তালুক মদন ঘোষকে বন্দোবস্ত দেয়। গগন ও মোহন মদন ঘোষের লম্বা টিকি কেটে দেয় এবং তাকে সিংখালী নিয়ে যায়। মদন ঘোষের টিকি কাটা হতে মঠবাড়িয়ার ঘোষের টিকিকাটা গ্রামের নামকরণ হয়েছে। গগন ও মোহনের নেতৃত্বে মদন ঘোষকে টুকরা টুকরা করে কেটে হত্যা করা হয়।
মদন ঘোষের খুন মামলায় গগন ও মোহনের যাবজ্জীবন সাজা হয় এবং আন্দামানে দ্বীপান্তর হয়। সেখানে জেল সুপারের স্ত্রী সর্পাঘাতে মরণাপন্ন হলে গগন তাকে ওঝালি করে ভাল করে তোলে এবং পুরস্কারস্বরূপ ৫ বছর পরে উভয় ভ্রাতা মুক্তি লাভ করেন। দেশে ফিরে বিরজা রতন দাসের অনুগ্রহ লাভ করে গগন ও মোহন তাদের তালুক উদ্ধার করেন। তাদের বাড়ির পার্শ্ববর্তী লুফা, কাজী, মৃধা ও চোকদারদের পূর্বপুরুষ গগন ও মোহনদের বাহিনীর বিভিন্ন দায়িত্বে নিয়োজিত ছিল। অনন্যোপায় হয়ে মিত্রজিত সিং কোম্পানির সাহায্য কামনা করেন। পুলিশ কয়েকবার গগন ও মোহনকে গ্রেফতার করতে আসে। কিন্তু তারা ব্যর্থ হয়ে ফিরে যায়। গগন ও মোহন মিত্রজিতদের সৈয়দপুর পরগণার দশ আনা দখল করে নেয়। তারা কৃষকদের নিকট হতে লুফা বা টর্চ সালামী আদায় করে একটি শক্তিশালী বাহিনী গঠন ও সুরক্ষিত দুর্গ নির্মাণ করেন। জমিদার ইংরেজ সরকারের সৈন্য ও পুলিশ নিয়ে প্রজাদের ওপর নির্যাতন চালাত। গগন ও মোহনকে কৃষকরা ইংরেজ অত্যাচার থেকে বাঁচার এক আশ্রয়স্থল রূপে জ্ঞান করতে লাগলো।
ইংরেজ বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ
১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারিতে বাকেরগঞ্জের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মিঃ হ্যারিসন দেশীয় পুলিশ ও একদল ইংরেজ সৈন্য নিয়ে সিংখালী গমন করেন। তারা পারেরহাটের অপর পাড়ে তেলিখালী অবতরণ করেন। ঘোড়ায় চড়ে ম্যাজিস্ট্রেট সিংখালী চলছেন। ইতিমধ্যে গগন, মোহন জঙ্গল হতে গুলি করে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের মাথার টুপি উড়িয়ে দেন। উভয়পক্ষে তীব্র লড়াই হয়। গগন ও মোহন তাদের বাড়ি ছেড়ে দিয়ে জঙ্গলে আশ্রয় নিয়ে যুদ্ধ করেন। মিঃ হ্যারিসন গগন ও মোহনের পরিত্যক্ত বাড়ি দেখতে পান। যুদ্ধ করার জন্য গগন ও মোহনের বাড়ি যেভাবে সুরক্ষিত করা হয়েছে তা দেখে হ্যারিসন বিস্মিত হয়েছেন। ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দের ২৮ ফেব্রুয়ারি লিখিত পত্রে হ্যারিসন সিংখালী গমন ও সংঘর্ষের বিবরণ দিয়েছেন।
হ্যারিসনের পর মিঃ আলেকজান্ডার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হয়ে আসেন। তিনি গগন ও মোহনকে গ্রেফতার করার জন্য তিন থানার পুলিশ ও শত শত চৌকিদার প্রেরণ করেন। তারা পরাজিত হয়ে ফিরে আসে। এ সংবাদে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আলেকজান্ডার ক্ষিপ্ত হয়ে পড়েন। তিনি নিজে অনেক পুলিশ ও ইংরেজ সৈন্য নিয়ে সিংখালী গমন করেন। তাকে সমর্থন করতে এগিয়ে আসেন মোরেলগঞ্জের মি. মোরেল ভ্রাতৃদ্বয় ও তাদের বাহিনী। আলেকজান্ডার তার ১৯ ডিসেম্বর তারিখে লিখিত পত্রে সিংখালীর ঘটনার বিবরণ দিয়েছেন। তিনি তার বাহিনী নিয়ে দু’মাইল হেঁটে খাল অতিক্রম করে মোহনের বাড়ি পৌঁছেন। হঠাৎ ঢাল, লেজা নিয়ে গগন ও মোহন মিঃ আলেকজান্ডারকে আক্রমণ করেন। উভয়পক্ষে সংঘর্ষ শুরু হয়। ঘটনাস্থলে ১৭ জন বিদ্রোহী কৃষক নিহত হয়। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোহনের বাড়ি দখল করার চেষ্টা করলে বিদ্রোহীরা ভিতর হতে গুলিবর্ষণ করে। তখন পুলিশ বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট তাড়াতাড়ি মোহনের বাড়ি ত্যাগ করে পালিয়ে যান। পালিয়ে যাবার সময় তিনি পুলিশ বাহিনীকে মৃতদেহগুলো আনার নির্দেশ দেন। কিন্তু পুলিশ প্রাণভয়ে পলায়ন করে। গগন, মোহন ১৭ জন বিদ্রোহী কৃষকের মৃতদেহ উদ্ধার করে মোহনের বাড়ির দরজায় কবর দেয়। তাদের কবরগুলো বাঁধানো আছে এবং কবরে নামফলক আছে।
আত্মসমর্পণ ও বিচার
ইংরেজ প্রশাসন জমিদারদের সাথে একত্র হয়ে কৃষকদের ওপর অমানুষিক অত্যাচার চালাতে থাকে। শেষ পর্যন্ত গগন ও মোহন কোর্টে উপস্থিত হয়। সরকার তাদেরকে ৮টি মিথ্যা মামলায় অভিযুক্ত করে। বাকেরগঞ্জের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মি. স্টিয়ার ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দের ১৪ সেপ্টেম্বর এবং ১৮৫৫ খ্রিস্টাবেদর ৫ জানুয়ারি গগন ও মোহনের বিরুদ্ধে আনীত মামলার রায় দেয় এবং উভয় ভ্রাতাকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড প্রদান করে। এরপর তারা ৬০ বছর বেঁচে ছিল এবং ৩০ বছর কারাগারে ছিল। শেষ জীবনে মুক্তি পেয়ে সিংখালী ফিরে আসে। তাদের বংশধররা সিংখালী গ্রামের মিয়াবাড়িতে বাস করছে।
তথ্যসূত্র: ১। সিরাজ উদ্দীন আহমেদ। বরিশাল বিভাগের ইতিহাস (১ম খন্ড)। ভাস্কর প্রকাশনী, ঢাকা। ২০১০।